আমার এই স্মৃতিকথা সাহিত্য সংস্কৃতি জনকল্যাণ সংস্থা সেবা’র চেয়ারম্যান আশরাফ হোসেইনের অনুরোধে, তাগিদে এবং অনূপ্রেরণায় লিখতে শুরু করি। আসলে লিখতে নয় আমি মুখে মুখে কথাগুলো বলে যেতাম, আশরাফ হোসেইন ওগুলো লিখে নিতো এবং এ রচনা তারই বিভিন্ন সংকলনে এবং পরে মাসিক নতুন সফরে ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছে। কেনো এ স্মৃতিচারণা করতে রাজী হয়েছি সে কথা একটু বলা দরকার। ৭১ এর পর আমরা যারা বিচ্ছিন্নতাবাদের সমর্থন করিনি তারা কলাবোরেটর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলাম। আমি ৭১ এর ডিসেম্বর থেকে ৭৩ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত জেলে ছিলাম এবং তখন থেকে পাকিস্তান আন্দোলন ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের ইতিহাস সম্বন্ধে এমনসব কথা শুনেছি যা শুধু উদ্ভটই নয়, সম্পূর্ণ কাল্পনিক। আমাদের কথা বলার সুযোগই ছিল না। আমরা যে, একটা আদর্শে বিশ্বাস করতাম সে স্বীকৃতি পর্যন্ত আমাদের বিরুদ্ধে উত্থিত অভিযোগের মধ্যে ছিল না।

৪০ সাল থেকে ৪৭ সাল পর্যন্ত যে অসংখ্য তরুণ পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছিল, আমি তাদের অন্যতম। কৃতিত্বের জন্য একথা বলছি না, নিজের পরিচয় দেবার জন্য কথাটি উল্লেখ করছি। ৪১-৪২ সালে আমি যখন ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের ছাত্র, তখন আমাকে সভাপতি করে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ গঠিত হয়। সৈয়দ আলী আহসান ছিল এ সংসদের সেক্রেটারী। আমাদের লক্ষ্য ছিল, বাংলা ভাষায় মুসলিম কালচারের পরিচয় থাকে এমন সাহিত্য সৃষ্টিতে লেখকদের উদ্বুদ্ধ করা। ১৯৪৪ সালে কলকাতা ইষ্ট পাকিস্তান রেনেসাঁস সোসাইটি (এর সভাপতি ছিলেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন) যে সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে তাতে ২৪ বৎসর বয়সে সাহিত্য শাখার সভাপতির দুর্লভ সম্মান লাভ করেছিলাম। এরপর সে বছর জুলাই মাসে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে লেকচারার হিসাবে যোগ দেই।


আবুল কালাম শামসুদ্দীনের অনূরোধে, দৈনিক আজাদে সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখতাম। ১৯৪৬ সালে যখন মাওলানা আকরম খাঁ ইংরেজি সাপ্তাহিক কমরেডের স্বত্ব খরিদ করে পত্রিকাটি পুনঃপ্রকাশের ব্যবস্হা করেন, নেপথ্যে থেকে সেটা সস্পাদনার ভারও আমি গ্রহণ করেছিলাম। তখন দু-একঢি ব্যতিক্রমের কথা বাদ দিলে সমগ্র মুসলিম সমাজ এই পাকিস্তান আন্দোলনের জন্য দিনরাত খেটেছে। আমরা এ স্বপ্নে বিভোর হয়েছিলাম যে, ভারতের পূর্বাঞ্চল যদি পাকিস্তানে যোগ দিতে পারে, তাহলে প্রায় দু’শ বছরের গ্লানি এবং অত্যাচার থেকে তারা রক্ষা পাবে।


আমি এ ইতিহাসের উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, পাকিস্তানের প্রতি আমার এবং আমার মতো আরো অনেকের যে অনুভূতি সেটা সন্তানের প্রতি জনকের অনুভূতির মতো। এ রাষ্ট্র আমরাই সৃষ্টি করেছিলাম, কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলার মুসলিম জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন না পেলে, এ অঞ্চল কখনও পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে পারত না।

আমি পাকিস্তানের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত – কর্মী হিসেবে। আমি রাজনীতিক নই, কোনকালে মুসলিম লীগের সদস্যও ছিলাম না। কিন্তু যে আদর্শের ওপর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়, তার প্রতি ছিল আমার অকুণ্ঠ সমর্থন। অথচ লক্ষ্য করলাম ৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট এ নতুন রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এক বছর না যেতেই পূর্ব পাকিস্তানিদের বুঝানো হল যে, তাদের অর্থনীতি এবং তামুদ্দনিক দুর্গতির কারণ পাকিস্তান।

৪৮ সাল থেকে ৭১ পর্যন্ত লক্ষ্য করেছি ষড়যন্ত্রের এ অঙ্কূর কিভাবে বিরাট মহীরুহে পরিণত হয়েছে। এর প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আমার মত ব্যক্তির ছিল না। কিন্তু তা করবার যথা সাধ্য চেষ্টা করতাম। কিন্তু নসিবের এমন পরিহাস যে, ১৯৫৯ থেকে আইয়ুব খানের আমলে আমরাই চিহ্নিত হলাম পাকিস্তানের প্রধান শক্র হিসাবে। ঐ সালে যখন রাইটার্স গিল্ড গঠনের আলোচনা হচ্ছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য অধিকারের কথা বলায় আইয়ুব খানের সেক্রেটারী কূদরত উল্লাহ শাহাব চিৎকার করে আমাকে শাসিয়েছিলেন প্যরিটি বা সমতার কথা যেন উচ্চারণ না করি।

আমি যেটা দুঃখ্য ও ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি সে ঘটনা হলো এই যে, একদিকে পূর্ব পাকিস্তানে যেমন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটা গভীর ষড়যন্ত্র ঘনীভূত হয়ে উঠছিল, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে কতিপয় রাজনীতিবিদ এবং বুদ্ধিজীবীর অদূরদর্শিতার কারণে পাকিস্তানের ভিত্তি ক্রমশঃ দূর্বল হতে আরম্ভ করে। একবার করাচীতে ডক্টর কোরায়শীর মত ব্যক্তিত্বকে আমি প্রকাশ্য সভায় এই বলে ভর্তসনা করি যে, তিনি অকারণে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে হতাশা ব্যক্ত করতে শুরু করেছেন।

গোলাম মুহাম্মদ যেদিন খাজা নাজিম উদ্দীনকে বরখাস্ত করেন এবং তার কিছু কাল পর গণপরিষদ ভেঙ্গে দেন তখন থেকেই অবক্ষয়ের স্রোত আরো দ্রুত গতিতে প্রবাহিত হতে থাকে। এরপর আসে মিলিটারী শাসন। তখন ক্রমান্বয়ে পাকিস্তানের মৌলিক আদর্শ এবং লক্ষ্য চাপা পড়ে যায়। পাকিস্তানের রাজনীতি পরিণত হয় নিছক একটা ক্ষমতার দ্বন্ধে। এদিকে বিরোধী দলের চাপের মুখে ক্রমশঃ কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক, সরকার এমন কতগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করে যার পরিণতিতে বিচ্ছিন্নতাবাদ আরো মজবুত হয়ে দাড়ায়। প্রতিবেশী ভারতের কোন অঙ্গ রাজ্যের যে সমস্ত ক্ষমতা ছির না, সে সমস্ত ক্ষমতাই পূর্ব পাকিস্তানকে প্রদান করা হয়। রেলওয়ে, সিভিল সার্ভিস সব ব্যাপারেই পূর্ব পাকিস্তানের স্বাতন্ত্র্য স্বীকৃতি হয়েছিল। কিন্তু অর্বাচীন, নির্বোধ রাজনীতিকদের আচরণে বিরোধী দল পাকিস্তানের জনসাধারণকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে, তাদের কোন অধিকার নেই। তারা হিন্দু সমাজের অচ্ছুতদের চেয়েও এক নিকৃষ্ট জাতে পরিণত হয়েছে।

সমাজের বহুলোক সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, পাকিস্তানে আমরা স্বাধীন হতে পারিনি। ১৯৪৭ সালে নাকি শুধু শাসক বদলের ঘটনা ঘটে। ব্রিটিশের পরিবর্তে আসে পাকিস্তানীরা। এই যে, শত সহস্র লোকজন রাজনীতিবিদ, উকিল, ডাক্তার, মোক্তার, ইন্জিনিয়ার, ছাত্র যারা ৪৬ সালে ভোট দিয়ে মুসলিম লীগকে জয়ী করেছিল, বেঙ্গল এসেম্বলির যে মুসলিম সদস্যদের ভোটে মাউন্ট ব্যাটেন প্ল্যান গৃহীত হয়, তারা রাতারাতি হয়ে গেলেন বিদেশীদের অনুচর। এখনও এসব কথা শুনি আর ইতিহাসের পরিহাস সম্পর্কে ভাবি।

আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করে চিরকালই অত্যন্ত পীড়িতবোধ করি। আমাদের লোকজন অত্যন্ত অস্থিরচিত্ত। যে ফজলূল হক সাহেব ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব পেশ করেন, ১৯৪৬ সালের ইলেকশনে তিনি মুসলিম লীগের বিরোধিতা করেন। যে ভাসানী সাহেব সিলেটের গণভোটের সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, তিনি ১৯৫৪ সালে কাগমারীতে এক সম্মেলনের অনুষ্ঠান করে প্রায় প্রকাশ্যেই পাকিস্তানের আদর্শের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। যে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ১৯৪৬ সালে ইলেকশনে মুসলিম লীগের পক্ষে জয়লাভ করা সস্তব হয়েছিল, তিনি গোস্বা করে মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ইউনিভার্সিটির যে সমস্ত মুসলিম শিক্ষকের উৎসাহ এবং অনূপ্রেরণায় ৪০ এর দশকে আমরা ছাত্ররা, পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছিলাম, কয়েক বছরের মধ্যে তাদের দু’-একজনের মতামতের একটা আমূল পরিবর্তন ঘটে। বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জানান ডঃ শহীদুল্লাহ। কার্জন হলের এক সভায় ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে তিনি ঘোষণা করেন, আমরা প্রথমে বাঙালী পরে মুসলমান। অথচ ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এত ধার্মিক ছিলেন যে, একটা সময় ছিল যখন তিনি ছবি তোলাকেও নাজায়েজ মনে করতেন। আবুল মনসুর আহমদের মতো তীক্ষ্ণবুদ্ধির লেখক, যিনি লাহোর প্রস্তাব এবং পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাস জানতেন, তিনি বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেন যে, প্রথমাবধি ভারতের উত্তর-পূর্বে এবং উত্তর-পশ্চিম দু’টো আলাদা রাষ্ট্র হলেই ভাল হতো। ৭১ সালে বাংলাদেশ আবির্ভূত হওয়ার পর তিনি ইত্তেফাকে প্রবন্ধ লিখে দেশবাসীকে জানান যে, বাংলাদেশের অভ্যূদয় আসলে লাহোর প্রস্তাবের চূড়ান্ত বাস্তবায়ন। অথচ, তিনি অবশ্যই জানতেন যে, ৪৭ এর ১৪ই আগস্টের আগে আমাদের যে অবস্থা ছিল তাতে, স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম করার মতো কোন সামর্থ্য এ অঞ্চলের ছিল না।

এসব অসংগতির কথা যতই মনে হয় ততই এ বিশ্বাস জন্মে যে, চরিত্রগত কারণেই হয়তো আমরা কোন বিশ্বাসকে বেশীদিন অকড়ে ধরে রাখতে পারি না। চারিত্রিক দূর্বলতার কারণে ইতিহাসে বহুবার আমাদের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটেছে। ৭১ সালে শুরু হয়েছিল স্বাধীন রাষ্ট্রকে নতুন করে স্বাধীন করার এক অদ্ভুত নাটক। স্মৃতিকথায় আমি বলেছি, যে সমস্ত ঐতিহাসিক কারণে পাকিস্তান অনিবার্য হয়ে ওঠে, তার কথা স্মরণ থাকলে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতা বন্টনের সমস্যা আমরা অনায়াসে সমাধান করতে পারতাম। আমি আরো দেখিয়েছি যে, ৭১ সালের ২৫শে মার্চ আর্মির যে ক্র্যাকডাউন শুরু হয়, তার পিছনে ছিল ষড়যন্ত্রকারীদের উস্কানি। আর নির্বোধ আর্মি অপরিকল্পিতভাবে জনসাধারণের ওপর হামলা করে ষড়যন্ত্রের এ ফাঁদে পা দেয়।

আমি জানি অনেকেই হয়তো আমার মতামত গ্রহণ করবেন না। কিন্তু আমাদের দিক থেকে যেভাবে সমস্যাটা দেখেছি, তার একটা রেকর্ড ভবিষ্যতের জন্য রেখে যাওয়া অত্যাবশ্যক। যে হারে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটছে তাতে আরো কত আজগুবি কাহিনী ৭১ সাল সম্পর্কে শুনতে হবে, তা কে বলবে?

আমার মনে আছে ১৯৭২ সালে আমরা যখন জেলে, তখন ইংরেজী অবজারভার পত্রিকার সম্পাদক মরহুম আবদুস সালাম নতুন বাংলাদেশ সরকারের বৈধতা (Legitimacy) সম্বন্ধে একটা প্রশ্ন তুলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, যে উপায়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলো, সেটা একটা বিপ্লব। কিন্তু এই বিপ্লবকে আইনের চোখে বৈধ করতে হলে আরও পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। সেদিনকার পত্রিকার সংখ্যা বের হবার সঙ্গে সঙ্গে সালাম সাহেবকে বরখাস্ত করা হয়। কারণ বাংলাদেশ সরকার কোন সমালোচনাই বরদাশত করতে রাজী ছিল না। আজও সে অসহিষ্ণুতার ভাব পুরোপুরি কাটেনি। সে জন্য আমি আশা করি না যে, সব পাঠক সহিষ্ণুভাবে আমার বক্তব্যকে গ্রহণ করবে।

বাঙালী জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে সালাম সাহেব পরোক্ষভাবে যে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন এবং যে কথা আমরা আগাগোড়াই বলে এসেছি, তার যথার্থতা প্রমাণিত হয় তখন, যখন – প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ঘোযণা করেন যে, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদই হবে এদেশের মূলনীতি। এ ঘোষণার মধ্যে এই স্বীকৃতিই ছিল যে, এ অঞ্চলে সংখ্যাগুরু সমাজের যে বিশ্বাস এবং জীবনধারা তার উপর নির্ভর করেই নতুন রাষ্ট্রকে এগুতে হবে। বাঙালী জাতীয়তাবাদ বললে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় স্বাতন্ত্র্যের কোন যৌক্তিকতা থাকে না। একথা ভারতীয় সাংবাদিক বসন্ত চ্যাটার্জী পর্যন্ত স্বীকার করে গেছেন। বাংলাদেশেরই একশ্রেণীর লোক এই দিব্য সত্যকেও মানবে না। তারা মনেপ্রাণে, ভাবাদর্শে এবং জীবনধারায় নিজেদের এক কাল্পণিক প্রাণীতে রুপান্তরিত করার স্বপ্নে মেতে আছেন।

আরো আশ্চর্য লাগে এই ভেবে, যারা পূর্বাঞ্চলের অধিকার এবং বাংলা ভাষার দাবী নিয়ে এ অঞ্চলকে বিচ্ছিনতার সংগ্রামে উদ্বূদ্ধ করেন তাদেরই একদল বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করতে নারাজ। এরা চাচ্ছে যত শীঘ্র এ অঞ্চলটা ভারতের অন্তর্ভূক্ত হয়, ততই যেন মঙ্গল। এসব প্রস্তাব তারা যখন তোলে তখন বাংলা ভাষার দাবীর কথা তাদের মনে থাকে না, মনে থাকে না, এ অঞ্চলের অধিবাসীদের বিভাগপূর্ব দুর্দশার কথা।

৬০ এর দশক থেকে আমাদের অনবরত বলা হতো যে, পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের ঠেলায় এদেশের জনগণ নাকি মৃতপ্রায় হয়ে উঠেছিল। অনেকে বই লিখে এ শোষণের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছিলেন। পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের অর্থনৈতিক বৈষম্য সম্বন্ধে অভিযোগ ৬০ এর দশকের শেষদিকে এমন পর্যায়ে পৌছায় যে, পশ্চিম পাকিস্তানেও কেউ কেউ বলতে শুরু করেন যে, পূর্বাঞ্চলের লোকেরা যদি পাকিস্তানে থাকতে না চায়, তাদের বেরিয়ে যেতে দিলেই পাকিস্তানের মঙ্গল হবে। ৭০ সালে আমি যে ডেলিগেশনের নেতা হিসেবে তেহরান গিয়েছিলাম তার একজন সদস্য ছিলেন লয়ালপুর এগ্রিকালচার ইউনিভার্সিটির ভিসি। তিনি একদিন কথায় কথায় বললেন যে, ইষ্ট পাকিস্তান যদি সত্যিই বেরিয়ে যেতে চায় তাদের বাধা দেওয়া উচিত নয়। কারণ এই যে, অনবরত অভিযোগের ফলে রাষ্ট্রের কাঠামো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। ‘৭১ সালে যুদ্ধ করে আমরা সত্যিই বেরিয়ে এসেছি। আজ পাকিস্তান পারমাণবিক বোমা তৈরীর ক্ষমতা অর্জন করেছে। তাদের রুপীর মুল্য আমাদের প্রায় তিনগুণ। পাকিস্তান এক সমৃদ্ধ দেশ। কিন্তু আমরা এই বিশ বছরে কী পেয়েছি? আমাদের ভোগান্তির শেষ নেই। কল-কারখানা দুর্নীতির চাপে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দেশে স্রোতের মত ইন্ডিয়ার পণ্য আসছে, তা নিয়ে কেউ কেউ চিৎকারও করে। দেশের জনগণের অবস্থা ১৯৭০ সালের তুলনায় অনেক নেমে গেছে। বার্মার মত সর্বধিকৃত রাষ্ট্রের সঙ্গে মোকাবেলা করার শক্তিও আমাদের নেই। ওরা যখনই ইচ্ছা লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এর জোরালো প্রতিবাদ করার সাধ্য আমাদের নেই।

ইন্ডিয়ার কথা তো আলাদা ইন্ডিয়ায় মুসলমানদের উপর শত অত্যাচার হলেও আমাদের প্রতিবাদ করার সাহস হয় না। কাশ্মীরের অধিবাসী যারা ইন্ডিয়ার নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে তাদের বাংলাদেশী খবরের কাগজে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলতে আমাদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা হচ্ছে না। কাশ্মীর নিয়ে ‘৪৭ সালেই বিরোধ সৃষ্টি হয় এবং জাতিসংঘের সামনে প্রশ্নটা উপস্থাপিত হলে সর্বসম্মতিক্রমে স্থির হয় যে গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরবাসীরা তাদের ভবিষ্যত নির্ধারিত করবে। কিন্তু আজ আমাদের সরকার এ ব্যাপারে কোন উচ্চবাচ্য করতে সাহস পান না। কারণটা স্পষ্ট।

১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর যখন বিজেপি’র লোকেরা চারশত বছরের পুরানো ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ ধূলিসাৎ করে দেয়, তখন এর বিরুদ্ধে সরকার প্রবল প্রতিবাদ করতে পারেনি। সামান্য একটু কথা বলা হয়েছিল তাতেই ইন্ডিয়া উষ্মা প্রকাশ করে। এই তো আমাদের স্বাধীনতার স্বরূপ।

রাজনীতিতে যেমন অর্থনীতিতেও তেমনি আমরা সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি হয়ে আছি। প্রতিমাসে কয়েক হাজার লোককে বেতন দিতে হচ্ছে। তারা কোন মিলশ্রমিক নয় কিন্তু পে-রোলে তাদের নাম রয়েছে। এই দুর্নীতি বন্ধ করার ক্ষমতা সরকারের নেই। কারণ একদিকে তারা ভোটার অন্যদিকে এরা সন্ত্রাস সৃষ্টি করে আরো একটা কান্ড ঘটাতে পারে এই ভয়ে সরকার তাদের বেতন দিয়ে যাচ্ছেন এবং শুনেছি এক আদমজী মিলে মাসে কয়েক কোটি টাকা লোকসান হয়।

তবু শুনি সরকার আশা করেন, বিদেশীরা এদেশে মূলধন খাটিয়ে দেশের শিল্পায়নে সাহায্য করবে। এই মর্মে নেতারা অনবরত বক্তৃতা করে বেড়াচ্ছেন। তারা নিশ্চয়ই জানেন নর্দমায় টাকা ঢালবার উদ্দেশ্যে কোন দেশী বা বিদেশী পুঁজিপতি এগিয়ে আসবে না। পাকিস্তান আমলে যে শোষণ হতো বলে শুনেছি তখন তো এ রকম অবস্হা ছিল না। তাহলে ঘুরে ফিরে আবার প্রশ্ন করতে হয় কোন অর্থে ‘৭১ সালে আমরা শৃঙ্খলমুক্ত হতে পেরেছিলাম?

কিন্তু এসব কথা প্রকাশ্যে বলবার উপায় নেই। আর আমরা যারা ১৯৭১ সালে বিচ্ছিন্নতাবাদের সমর্থন করিনি তাদের সম্বন্ধে যদৃচ্ছা মিথ্যা কথা বলে বুক ফুরিয়ে চলা যায়। বছর ছয়েক আগে এক সাপ্তাহিক পত্রিকায় এক চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশ করা হয়। তারা লিখেছিল ‘৭১ এর গণহত্যার অন্যতম নায়ক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন সৌদী আরব থেকে ৭ দিনের ভিসা নিয়ে এসে পাকাপাকিভাবে ঢাকায় বাস করছে। আমি ১৯৮৫ সালে অবসর গ্রহণ করে দেশে ফিরে আসি। আগাগোড়াই বাংলাদেশি পাসপোর্টে চলাফেরা করেছি কিন্তু এ সত্ত্বেও যাচাই করার প্রয়োজন এরা বোধ করেনি।
“৭১ এর দালালরা কে কোথায়” নামক বইঢিতেও আমার নাম স্থান পেয়েছে। গত ২৯শে অক্টোবর ১৯৯৩ সালের এক কাগজে এক ব্যক্তি লিখেছেন তিনি নাকি আমাকে বাংলা একাডেমীতে দেখেছিলেন। কিন্তু ঘৃণায় আমার দিকে তাকাতে পারেননি। অথচ কথা হচ্ছে ১৯৭১ সালের পর আমি কোনদিনই বাংলা একাডেমীতে বা ইউনিভার্সিটিতে পা দেইনি। লেখক কাকে দেখেছিলেন জানি না কিন্তু এ রকম একটা মিথ্যা গল্প বানিয়ে প্রকাশ করতে তার এতটুকু বাধা হয়নি। আরো মজার কথা ঐ লেখকই অভিযোগ করেছেন যেহেতু আমি কর্মজীবনে স্যুট পরতাম সুতরাং আমার মত বিদেশী পোশাক পরিহিত লোকের পক্ষে ‘স্বাধীনতার বিরোধিতা করা মোটেই বিচিত্র নয়।’ যারা ইন্ডিয়ায় গিয়েছিল তাদের মধ্যে যে শত শত লোক স্যুট পরতেন সেটা এই যুক্তিতে গৌণ হয়ে গেল।

এ রকম অপবাদ আরো হয়তো বেরিয়েছে অথবা বেরুবে। আরেকটা উদাহরণ দিচ্ছি – কয় বছর আগে গণ-আদালত করে যখন নানা দাবী উত্থাপিত হয়, আমি অরাজকতার প্রতিবাদ করে মর্নিং সান পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেছিলাম। তার প্রতিবাদ করে আমারই পরিচিত এক ব্যক্তি বললেন যে, ‘৭১ এর যুদ্ধে সমর্থন যে করেনি তার পক্ষে এ রকম কথা বলার অধিকার নেই।’ এ রকম আরেকটা ঘটনা ঘটে যখন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের সমর্থনে এক বিবৃতিতে আমি স্বাক্ষর করি এখানেও, প্রতিবাদ করে বলা হলো যে এসব কথা বলার অধিকার আমার মতো ব্যক্তির থাকতে পারেনা।

আমি জন্মগতভাবে পূর্ব বাংলার সন্তান। এ অঞ্চলের স্বাধীনতা বা সার্বভৌমত্ব সম্বন্ধে কথা বলার অধিকার আমার নেই বলে শুনছি। অধিকার দখল করে বসছেন প্রধানতঃ এমন একদল যারা, ‘৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর রাতারাতি প্রমোশন এবং উন্নতি লাভের আশায় এ নতুন রাষ্ট্রে ছুটে এসেছিলেন। এদের মধ্যে কেউ ছিলেন উকিল, কেউ সাংবাদিক, কেউ লেখক, কেউ শিল্পী, কেউ ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার যারা কলকাতার জগতে প্রতিযোগিতায় বেশীদূর এগুতে পারতেন না, বিখ্যাত হওয়াতো দূরের কথা। অনেকে নিঃস্ব অবস্থায় এসে পাকিস্তানে বহু সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। যারা পাকিস্তান না হলে উচ্চ শিক্ষা লাভ করার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতেন তারাই বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতম পদগুলো দখল করতে পারলেন। কিন্তু আশ্চর্যের কথা এদের মুখেই শুনলাম শোষণ এবং বঞ্চনার কথা সবচেয়ে বেশী। এবং এদেরই একদল আজ বাংলাদেশকে আবার ভারতে প্রত্যাবর্তনের পরামর্শ দিচ্ছেন।

এই দুঃস্বপ্নের রহস্য আমরা কি করে বুঝবো?
বাংলাদেশ আজ একটা বাস্তব সত্য। এর স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব যদি রক্ষিত হয় তবে আমরা যে স্বকীয়তার কথা বলতাম সেটা কিছুটা রক্ষা পাবে বলে আমার বিশ্বাস। কারণ এ অঞ্চলকে পূর্ব বাংলা, পূর্ব পাকিস্তান, বাংলাদেশ যাই বলি না কেন এর মাটিতে কোন পরিবর্তন ঘটেনি এবং ঘটতে পারে না। সে আকাশ, সে বাতাস, সে গাছপালা, সে নদ-নদী সবই রয়ে গেছে। আমরা এর শুধূ ভৌগোলিক নাম বদলিয়েছি। তবে বর্তমানে যে অপচেষ্টা চলছে তার লক্ষ্য হলো, আমাদের শত শত বছরের ইতিহাস এবং সংস্কৃতিকে একেবারে মুছে ফেলা। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে এ বিপদের আশঙ্কায় খুবই শঙ্কিত হয়ে পড়তে হয়। আমার বক্তব্য তাই লিপিবদ্ধ করে গেলাম। কেনো পাকিস্তান চেয়েছিলাম, ৭১ সালে আমরা কেনো বিচ্ছিন্নতাবাদের সমর্থন করতে পারিনি এবং বর্তমানে কেন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের সম্বন্ধে আমাদের উৎকণ্ঠা সবচেয়ে বেশী তার কৈফিয়ত হিসাবে এই স্মৃতিচারণার মূল্য।

আমি আবার আশরাফ হোসেইনকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমার কথা শেষ করছি। সে অনবরত পেছনে না লেগে থাকলে এ বই লেখাই হতো না। যেহেতু আগাগোড়া সমস্ত বইটা ডিকটেশনে লেখা সেজন্য, কোন কোন ঘটনা বা কথার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। বর্ণনার স্বাভাবিকতা যাতে নষ্ট না হয় এই ভেবে, ওগুলোতে হস্তক্ষেপ করলাম না।


অক্টোবর – সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন
১৯৯৩
(বইটির pdf version download করুন এখানে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>