১৯শে ডিসেম্বর যারা আমাকে বাসা থেকে পাকড়াও করে নিয়ে যায়, তারা ছিলো সব ছাত্র। এর মধ্যে ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্রও ছিলো। তবে আমার ডিপার্টমেন্টের নয় এবং এদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো পরিচয় ছিলো না। আমাকে নিয়ে জিপ যখন বকশীবাজারের দিকে রওয়ানা হয় তখন শুনলাম এরা পরস্পরকে জিজ্ঞাসা করছে ইনিই ডক্টর সাজ্জাদ হোসায়েন কিনা। আমি ওদের আশ্বস্ত করে বললাম যে তাদের সংশয়ের কারণ নেই, আমিই ঐ ব্যক্তি। মিথ্যা পরিচয় দেওয়ার কোন প্রবণতা আমার ছিলো না। মিথ্যা পরিচয়ে মৃত্যূবরণ করে কি হবে? কারণ আমার বিশ্বাস ছিল যে আমাকে নিয়েই তো ওরা মেরে ফেলবে।

জিপটা বকশী বাজারের অলিগলি ঘুরে ক্যাম্পাস এলাকায় প্রবেশ করে এবং এটাকে ল” ফ্যাকালটির বিল্ডিং প্রাঙ্গণে দাঁড় করানো হয়। ছাত্ররা আমাকে টেনে তেতলার একটা কামরায় নিয়ে আসে। খুব সম্ভব সেখানে আরো দু”একটি ছেলে উপস্থিত ছিলো। কামড়ার দরজা বন্ধ করেই ওরা আমাকে মারধোর করতে শুরু করে। এক ঘুষিতে আমার চশমা ছুটে পড়ে যায়। মারের মধ্যে একজন আমার গায়ের কাপড় চোপড় খুলে নেয় এবং হাতের ঘড়িও ছিনিয়ে নেয়। আমার পরনে যে প্যান্ট ছিলো তার বেল্ট খুলে নিয়ে সেটা দিয়ে আমার বুকে পিঠে হাতে আঘাত করতে শুরু করে। লক্ষ্য করে দেখলাম ডান হাতের আঙ্গুলের গোড়ার চামড়া ফেটে রক্ত বেরুচ্ছে। আমি চুপ করে এসব সহ্য করছিলাম। কারণ জানতাম এদের সাথে তর্ক করতে গেলে নিপীড়ন বৃদ্ধি পাবে। মারের সঙ্গে আমাকে গালাগালিও করা হচ্ছিলো। পাকিস্তান আর্মির দালাল হিসাবে আমি নাকি বহু হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত। আমি শুধু একবার বলেছিলাম যে আমার অপরাধ হয়ে থাকলে তার বিচার হোক। বলাবাহুল্য এতে যেনো ওদের ক্রোধ আরো বৃদ্ধি পেলো।

বেশ কিছুক্ষণ মারধোর করার পর ওরা পিঠমোড়া করে আমার দু”হাত বেঁধে দিলো এবং চোখও রুমাল দিয়ে বাঁধা হলো। এরপর বন্দুকধারী এক যুবকের জিম্মায় আমাকে রেখে বাকী সবাই ঐ কামরা থেকে চলে যায়। এই ছেলেটি ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে আমাকে পাহারা দিতে থাকে।

আমি ঐ ছেলেটিকে বললাম তোমরা বিচার না করেই আমার উপর নিপীড়ন চালাচ্ছো কেনো? আমাকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করতে পারো বিন্তু তার আগে বিচার হওয়া উচিত। ছেলেটি বললো আমাকে কেনো ধরে নিয়ে আসা হয়েছে সে সম্বন্ধে সে কিছুই জানে না। সে গফরগাঁও কলেজের ছাত্র; গেরিলা বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলো। দল নেতার নির্দেশে সে আজকের অপারেশনে শরীক হয়। তবে কোথায় অপারেশন হতে যাচ্ছে সেটা তাকে আগে জানানো হয়নি। তারপর সে বললো যে দলের নির্দেশ পেলেও সে আমাকে গুলি করতে পারবে না। এতে সান্ত্বনা লাভ করার আমার কিছু ছিলো না। কারণ গুলি করার লোকের অভাব হতো না। তারপর ছেলেটি যে সমস্ত কথা বললো সেগুলো মনে রাখবার মতো। সে বললো, নভেম্বরের শেষের দিকে আমরা হতাশ হয়ে যুদ্ধ বন্ধ করে দিয়ে দেশে ফিরবার কথা ভাবছিলাম। কারণ আমাদের বিশ্বাস হয়েছিলো, দশ বছর এভাবে যুদ্ধ করেও পাকিস্তান, আর্মিকে হারাতে পারবো না। ভারতের হস্তক্ষেপে অবস্থা নটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়। আমরা শুধু ভারতীয় আর্মির সঙ্গে সঙ্গে চলে আসি।

ঐ ছেলেটির নাম আমার এখন মনে নেই। সে এখন বেঁচে আছে কিনা, তাও জানি না। কিন্তু যুদ্ধের অবস্থা সম্পর্কে তার মুখে যে স্বীকৃতি শুনেছিলাম তার মধ্যে আমাদের অভিমতেরই সমর্থন ছিলো। ১৬ই ডিসেম্বরে পাকিস্তান আর্মির যে পরাজয় ঘটে তার মধ্যে গেরিলা বাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত নগণ্য। এটা ছিলো ভারতীয় বাহিনীর বিজয়। এরপর এ ছেলেটির সঙ্গে আর বিশেষ কথা হয়নি। মনে আছে একবার আমি একটু পানি খেতে চেয়েছিলাম, ছেলেটি এক কাপে করে পানি আমার ঠোটের কাছে ধরে বললো, আমার চোখ খুলে দিলে ও নিজে বিপদে পড়বে। আমি চুপচাপ পাকিস্তানের ভাগ্যের কথা ভাবতে লাগলাম এবং বারবার যাদের ফেলে এসেছি তাদের কথা মনে হলো। এদের সঙ্গে আর কখনো দেখা হবে, এ আশা ছিলো না। কালেমা শাহাদত পড়ে নিজেকে মৃত্যূর জন্য প্রস্তুত করতে লাগলাম। ধারণা হয়েছিলো যে যারা ঐ ছেলেটির কাছে জিম্মায় আমাকে রেখে গেছে তারা কিছুক্ষণ বাদেই ফিরে এসে আমাকে মেরে ফেলবে। ঐ ছেলেটি আমাকে জানিয়েছিলো যে আরো অনেক লোককে ধরে এনে ইউনিভার্সিটি বিল্ডিং এ আটক করে রাখা হতো এবং সেখানেই ওদের গুলি করা হতো।

কতক্ষণ এভাবে কাটে, আমার খেয়াল নেই। ঐ স্বাভাবিক পরিবেশে খালি গায়ে আমি কোনো শীত অনূভব করছিলাম না। ক্রমে ক্রমে মনে হলো-রাস্তায় গাড়ির আওয়াজ কমে এসেছে। ভাবলাম এখন নিশ্চয়ই রাত এগারটা সাড়ে এগারটা হবে। হঠাৎ দরজায় একটা ধাক্কার শব্দ শুনলাম। আমার পাহারাদার দরজা খুলে দিলে দু”জন ছেলে ঢুকলো। আমি তাদের দেখভে পাচ্ছিলাম না। কথাবার্তায় মনে হলো এরাও ইউনিভার্সিটির ছাত্র। আমাকে আরো কিছু কিলচাপ্পড় মেরে ওরা আরো মজবুত রশি দিয়ে আমার হাত বেঁধে চোখের বাঁধুনি আরো শক্ত করে দেয়। এবং মুখে রুমাল ঢুকিয়ে দিয়ে আমার কথা বলা বন্ধ করে। আমি তখনো আস্তে আস্তে কালেমা শাহাদত পড়ছি। ওরা ঠাট্টা করে বললো এসব মন্ত্রে কোনো কাজ হবে না। মুখ বন্ধ হওয়ার আগে আমি আবারো একবার জিজ্ঞাসা করলাম, আমার অপরাধ কি? ওদের একজন ইংরেজীতে জবাব দিলো, Mr Vice Chancellor, you have lived too long. আমি নাকি ইউনিভার্সিটি এলাকায় যতো হত্যাকান্ড ঘটেছে তার জন্য দায়ী। সেগুলি mastermind করেছি। আমি তর্কে নিবৃত্ত হলাম। কারণ মনে হচ্ছিলো এদের চোখ মুখ থেকে ক্রোধের আগুন ঠিকরে পড়ছে। ভাবলাম ওরা এখনই হয়তো আমাকে তুলে নিয়ে গুলি করবে। সে জন্য অন্য সব চিন্তা বাদ দিয়ে ঈমানের সঙ্গে যাতে মরতে পারি সে কথাই ভাবতে লাগলাম।

ছাত্র দু”টি রশি টেনে অন্য এক কামরায় নিয়ে গেলো, তারপর ঐ রশির এক মাথা মনে হলো কোনো টেবিল বা বেঞ্চের সঙ্গে এমনভাবে বেঁধে দিলো যাতে আমি ভালো করে নড়াচড়া করতে না পারি। দু”জনের একজন কামরা থেকে বেরিয়ে যায়। তার সঙ্গী ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে একটা বেঞ্চের উপর শুয়ে পড়ে। আমি এসব কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। শুধু নড়াচড়ার শব্দে টের পাচ্ছিলাম যে ছাত্রটি নিশ্চয়ই শুয়ে পড়েছে। কারণ কিছুক্ষণ পরই তার নাক ডাকার শব্দ আমার কানে আসে।

এদিকে আমি বসে থেকেও কোনো স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। হাতের কবজি এমনভাবে বাঁধা ছিলো যে একটু নড়াচড়া করা মাত্র হাত কেটে যেতে শুরু করে। সামনের দিকে পা ছড়িয়ে দিয়ে বসে বসে মৃত্যূর প্রতীক্ষা, করছিলাম। এবার বিশ্বাস হলো যে ভোরে কোথাও ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। সারারাত কালেমা পড়ে কাটিয়ে দিলাম। মাঝে মাঝে নানা কথাও মনে হচ্ছিলোঃ ফ্যামেলির কথা, আত্মীয়-স্বজনের কথা এবং দেশের কথা। ১৯৪০ সালে যে স্বপ্নে আমরা তরুণরা মেতে উঠেছিলাম তার এ মর্মান্তিক পরিসমাপ্তির কথা কখনো কল্পনা করতে পারিনি।

ঘুমের কোনো প্রশ্নই ওঠেনি। ক্ষুধা-তৃষ্ণাও ছিলো না। মনে হলো ফাঁসির আসামীর মৃত্যূর পূর্বে এ রকমই কিছু অভিজ্ঞতা হয়। যখন মসজিদে ফজরের আজান হয়, তার কিছুক্ষণ পর আবার দরজায় শব্দ হলো। যে ছাত্রটি ভেতরে ছিলো সে জেগে উঠে দরজা খুলে দিলে একজন বা দু”জন ছেলে প্রবেশ করে। এবং আমাকে বলে গেটআপ। আমি উঠে দাঁড়ালাম। পায়ের স্যান্ডেল কোথায় সরে গিয়েছিলো, টের পেলাম না। আর এখন এই মুহুর্তে স্যান্ডেল দিয়ে আমার কি হবে। আমি যাচ্ছি তো বধ্যভূমিতে।

ওরা আমাকে টেনে নিচে নামিয়ে আনলো। মনে হলো ওখানে একটা গাড়ি। প্রথমে আমাকে গাড়ির সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বসানো হয়। পরক্ষণেই ওখান থেকে নামিয়ে এনে পেছনে ফ্লোরের উপর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তখন বুঝলাম এটা খোলা জিপ। আমার দু”পাশে অস্ত্রধারী কতগুলি লোক পা ঝুলিয়ে বসা ছিলো সেটা টের পেলাম বিভিন্ন সাড়া শব্দে।

জিপ আমাকে নিয়ে কোথায় এলো টের পাচ্ছিলাম না মোটেই। রাস্তায় যানবাহনের কোনো শব্দ ছিলো না। আর জিপ অনেক রাস্তা ঘুরে চলছিলো। তাই প্রথমে মনে হয় আমাকে শহরের উপকন্ঠে নিয়ে আসা হচ্ছে। ঢেছ। জিপ থামলে ওরা আমাকে টেনে বের করে এবং সোজা হয়ে দাড়াতে বলে। আমি  ভাবলামঅআর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমাকে গুলি খেতে হবে। মুখে গ্যাগ থাকা সত্ত্বেও আমি একটু জোরেই কালেমা শাহাদত পড়লাম। একজন বিদ্রুপ করে বললোঃ পড়ো, তোমার মন্ত্র পড়ো। সেই মুহুর্তে শেক্সপিয়ারের হেমলেট নাটকের একটা লাইনও মনে উদিত হলোঃ The undiscovered country from whose bourne no traveller returns.

নির্যাতন ও প্রাণনাশের চেষ্টা


এরপর ধারালো কোনো অস্ত্র দিয়ে আমার বুকে চার জায়গায় এবং পিঠে দুই জায়গায় খোঁচা দেওয়া হয়। অনুভব করলাম যে রক্ত বেরুচ্ছে। ভাবলাম ওরা আমাকে এভাবে একটু একটু করে মারবে। আমি তখন মনে প্রাণে শুধু কালেমা পড়বার চেষ্টা করেছি। হঠাৎ আমার মেরুদন্ডের উপর প্রচন্ড একটা আঘাত অনুভব করলাম।  সেটা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য। মুহু্র্তেই আমি জ্ঞান হারিয়ে নিঃসাড় হয়ে পড়ি।

কতক্ষণ এভাবে ছিলাম, জানি না। যখন জ্ঞান ফিরে এলো তখন টের পেলাম যে আমি চিৎ হয়ে মাটিতে শোওয়া এবং আমার বুক থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। শরীরের নিম্নাংশে কোন অনুভূতিই ছিল না। মনে হলো রক্তপাতের ফলে ক্রমান্বয়ে আমার জীবণী শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসছে। কিন্তু কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পরও যখন মনে হলো যে আমি তখনও প্রাণ হারাইনি তখন কান পেতে শুনবার চেষ্টা করলাম কোন লোকজনের পায়ের আওয়াজ আসে কিনা। দু’একটা রিকশার টুংটাং কানে আসছিল।  আমি এবার সাহস করে জিহ্বা দিয়ে মুখের গ্যাগটা সরিয়ে ফেলে একটু জোরে বললাম, আমি কোথায়? মনে হলো আমার গলার আওয়াজে কয়েকজন লোক আমার দিকে এগিয়ে আসে। একজন বলে উঠলো এটাতো মরেনি। যেনো আমি একটা কুকুর বা বিড়াল। আমি ওদের আমার চোখের এবং হাতের বাঁধন খুলে দিতে অনুরোধ করলাম। ওরা জিজ্ঞেস করলো আপনাকে মেরেছে কে? আমি সত্য কথাই বললাম। জবাব দিলাম মুক্তিবাহিনী। এবার মহা ফ্যাসাদে পড়া গলো। আগন্তুকদের মধ্যে একব্যক্তি লেকচার শুরু করে দিলো। বললো যে আমার উচিৎ শাস্তি হয়েছে। আমার মতো ব্যক্তিদের জন্যই নাকি দেশের এই দুর্দশা। আমি কোনো সাহায্য বা সহানূভুতি পেতে পারি না। আমি বললাম, আমি ভো মরতেই চলেছি। আমার চোখটা খুলে দিন। তখন একজন এসে আমার চোখের ও হাতের বাঁধন খুলে দেয়। চোখ খুলবার পর দেখরাম যে আমার সামনে সতেরো আঠারো বছরের এক ছোকরা দাঁড়ানো এবং আমি গুলিস্তান সিনেমা হলের সামনে যেখানে কামানটা ছিলো-পড়ে আছি। কামানের পাশের রেলিং ধরে কোন রকমে উঠে বসলাম। পায়ে দাঁড়াবার শক্তি একেবারেই ছিলো না। শরীর থেকে তখনো রক্ত বরুচ্ছে। আমি আবার লোকজনকে বললাম, আমাকে একটু রিকশায় তুলে বায়তুল মোকাররম মসজিদে দিয়ে আসুন। এবারে ওরা বাধা দিয়ে কাউকে কিছু করতে দিলো না। আমাকে জানালো আমার মতো আরেকজন নাকি কামানের অন্যদিকে পড়া ছিলো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কে? জবাব এলো আমি হাসান জামান। বুঝলাম তাঁকেও ঐ জায়গায় এনে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

আমার পাশে ক্রমশঃই ভিড় জমে উঠতে লাগলে। কিন্তু চেষ্টা করেও কোনো রিকশা ডাকতে পারছিলাম না। রিকশা কাছে এলই লোকজন তাকে তাড়িয়ে দিতো। এক পর্যায়ে দেখলাম একট্রাক বোঝাই ইন্ডিয়ান সৈন্য গুলিস্তান সিনেমার পাশ দিয়ে যচ্ছে। আমি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। কারণ ওরা আমার গলার আওয়াজই শুনতে পলো না। আমি ক্রমশঃই হতাশ হয়ে পড়ছিলাম। ঠিক এই সময় নাজিমউদ্দিন রোডের এক ব্যক্তি, যে আমাকে চিনতো, আমাকে দেখেই এগিয়ে আসে এবং একটা রিকশা ডেকে তাতে তুলে আমাকে বাসায় নিয়ে আসে। এবার লোকজন আর বাধা দেয়নি। রিকশা যখন মোড় ঘুরছে তখন দেখলাম ডক্টর হাসান জামান নিজের পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে বায়তুল মোকাররমের দিকে যাবার চেষ্টা করছেন।

আমাকে যখন বাসায় নিয়ে আসে তখন বোধ হয় ভোর সাড়ে সাতটা। ধরাধরি করে রিকশা থেকে নামিয়ে সামনে একটা ঘরে মাদুরের উপর শুইয়ে দেওয়া হয়। দেখলাম বাড়ীতে কয়েকজন ইন্ডিয়ান সৈন্য। আমাকে ফার্স্ট এইড দেওয়ার জন্য মহল্লার ডাক্তার রইসউদ্দিনকে খবর দেওয়া হলো। তাঁর ক্লিনিক ছিলো রাস্তার ওপারেই। তিনি আসতে অস্বীকার করলেন। জানালেন যে মুক্তিবাহিনী যাকে শাস্তি দিয়েছে তাঁর চিকিৎসা করতে গেলে তিনি বিপদে পড়বেন। এরপর খবর দেওয়া হয় চক বাজারের ডাক্তার শামসুল আলমকে। এ ছিলো আমার এক ফুপাতো ভাইয়ের ছেলে। এও সোজা আসতে অস্বীকার করে। তখন গুলবদন শাহ সাহেবের জামাতা ডাক্তার মুনির উদ্দিনকেই ডাকা হয়। তিনি সঙ্গে সঙ্গে চলে আসেন। শুনেছি পরে তাকে সে জন্য মারধোরও খেতে হয়েছে।

ইতিমধ্যে আমার ফুপাতো ভাই সৈয়দ কামরুল আহসান, তিনি তখন আমাদের বাসায় ছিলেন, ইন্ডিয়ান আর্মি অফিসারদের খবর দেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই এক ইন্ডিয়ান মেজর ডাক্তার নিয়ে হাজির হন। আমাকে পরীক্ষা করে এরা বলেন যে একে অবিলম্বে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা দরকার এবং তারাই সমস্ত ব্যবস্থা করে ওদের গাড়িতে আমাকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমাকে রাখা হয় দোতলায় ৯ নাম্বার ভি আই পি ক্যাবিনে। কয়েকজন ইন্ডিয়ান সৈন্য সাতদিন পর্যন্ত এই ক্যাবিন পাহারা দিয়েছিলো।

একটু পেছনের কথা বলা দরকার। বাসার লোকজনের মুখে শুনেছি যে আমাকে পাকড়াও করে নিয়ে যাবার পর সৈয়দ কামরুল আহসান বুদ্ধি করে ইন্ডিয়ান আর্মিকে খবর দিয়েছিলেন। তারা সঙ্গে সঙ্গে বাসায় পাহারা বসায় এবং সারা ঢাকা তন্নতন্ন করে আমার খোঁজখবর করে। কিন্তু ইউনিভার্সিটি বিল্ডিংটার কথা মনে না হওয়ায় তারা সেদিকে যায়নি।

ইন্ডিয়ান আর্মি


যে কয়দিন ইন্ডিয়ান সৈন্যরা হাসপাতালে আমাকে এবং বাসায় আমার পরিবারকে পাহারা দিয়েছিলো তাদের ব্যবহারে আমরা সবাই মুগ্ধ হয়েছি। মেয়েদের মুখে শুনেছি ওদের মধ্যে যারা ছোট ছির তাদের ওরা কোলে করে আদর করতো এবং নানা খাবার-দাবারও এনে দিতো। এ কথা অবশ্যই স্বীকার কবরো যে ইন্ডিয়ান আর্মির সাহায্য না পেলে আমার কোনো চিকিৎসাই হতো না এবং বোধ হয় আমাকে আবার ধরে নিয়ে যেয়ে গেরিলারা মেরে ফেলতো। যারা আমাকে গুলিস্তান চত্বরে ফেলে যায় তারা ধরে নিয়েছিলো যে আমি মরেই গেছি। কিন্তু আমি মরিনি টের পেলে আমাকে আবার পাকড়াও করা হতো, সে ব্যাপারে আমার মনে কোন সন্দেহ নেই। বাসা থেকে ইন্ডিয়ান পাহারা উঠিয়ে দেবার পর ওরা আরো কয়েকবার আমার পরিবারের উপর হামলা চালায়,আমার গাড়িটা নিয়ে যায় এবং একদিন রাত-দুটোর সময় খবর দিয়ে এসে টাকা পয়সাও নিয়ে যায়। তখন ভয়ে আমার মেয়েরা প্রতিবেশীদের বাড়ীতে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়।

আর একটা রহস্য আমি এখনো বুঝতে পারিনি। আমি বলেছি পিঠে প্রচন্ড আঘাতে আমি বেহুশ হয়ে পড়ি। স্বভাবতই এ রকম অবস্থায় মানুষের উপুড় হয়ে পড়ার কথা। অথচ জ্ঞান ফিরে এলে আমি দেখেছি যে আমি চিৎ হয়ে আছি। এর কারণ এই হতে পারে যে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পরও ওরা আমার দেহের উপর অত্যাচার চালিয়েছে। তাছাড়া আমার বাম পায়ের হাঁটুটা তখন থেকে একেবারে বিকল হয়ে আছে। বিশ বছর পরও বাম পায়ে ভর দিয়ে আমি কোনো কিছু করতে পারি না।

আমার উপর হামলাকারীরা যে খুব পাকা লোক ছিলো সে সম্বন্ধেও কোনো সন্দেহ নেই। শরীরের কোন জায়গায় আঘাত করলে মানুষকে সহজে ঘায়েল করা যায়, সেটা তারা জানতো। ওরা নিশ্চয়ই মনে করেছিলো যে মেরুদন্ডের উপর আঘাতের ফলে আমার মৃত্যূ হবে। কিন্তু মৃত্যূর আগে আমি অসম্ভব যন্ত্রণা ভোগ করবো। এর মধ্যে একটা প্রতিশোধের ব্যাপারও ছিলো। ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের জ্বোতির্ময় গুহঠাকুরতা আর্মির গুলিতে আহত হয়ে চারদিন হাসপাতালে ছিলেন। তখন তার শরীরের নিম্নাংশ সম্পূর্ণ অবশ। আমার মনে হয় এই মৃত্যূর প্রতিশোধ আমার উপর নেওয়া হয়। এবং আমার মৃত্যূ যাতে একই প্রণালীতে হয়, হামলাকারীরা প্ল্যান করে তার ব্যবস্থা করেছিলো।

যাক, বিশে ডিসেম্বর যখন আমি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাই তখন আমার শরীরের ক্ষতি কতোটা হয়েছে তা বুঝবার উপায় আমার ছিলো না। এই যে বাম পা অচল হওয়ার কথা বললাম, এটা তখন টের পাচ্ছিলাম না। আমার দু” কাঁধে এখনো অসম্ভব ব্যথা অনুভব করি। সে ব্যথাও তখন বোধ করিনি। কারণ শরীরের নিম্নাংশ তো একেবারেই অবশ হয়েছিলো। উপরের অংশেও বোধ শক্তি বিশেষ ছিলো না।

হাসপাতালে আমার বুক এক্সরে করে দেখা হয়। কিন্তু পা এক্সরে করার কথা বলিনি। কারণ পায়ে কি হয়েছে সেটা মোটেই বুঝতে পারছিলাম না। হাসপাতাল বেডে ডাক্তাররা যখন আমাকে দেখতে আসেন, তারা আমাকে পা দু”টো উঁচু করতে বললেন। ডান পা অনেকটা উঁচু করতে পারলাম কিন্তু বাম পা মনে হলো অসম্ভব ভারি হয়ে গেছে। ওটা বিছানা থেকে ইঞ্চি দুয়ের বেশি উঁচু করা গেলো না।

সত্যিকারের যন্ত্রণা শুরু হলো যখন দেখলাম যে কিডনির উপর আঘাতের ফলে প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গেছে। উনিশ তারিখের তিনটার পর থেকে আর কোনো প্রস্রাব হয়নি। তখন বহু চেষ্টা করেও কিছু করতে পারছিলাম না। ডাক্তাররা বললেন যে ৩৬ ঘন্টা যদি প্রস্রাব বন্ধ হয়ে থাকে তারা ক্যাথিটার ব্যবহার করবেন। আমি আরো ঘাবড়ে গেলাম। শুনেছিলাম, ক্যাথিটারে নাকি অনেক যন্ত্রণা হয়। যাক শেষ পর্যন্ত ক্যাথিটার প্রয়োগ করতে হয়নি। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে প্রস্রাব করতে আমার তিন বছর সময় লাগে। এরমধ্যে প্রচুর জ্বালা-যন্ত্রণা ভোগ করেছি।

হাসপাতালে আমাকে রোজই পেনিসিলিন ইনজেকশন দেওয়া হতো। আর প্রস্রাবের জন্য এক প্রকার মিক্সচার খেতে দিয়েছিলো। এটায় কিছুটা উপকার পেয়েছি। কিন্তু মাঝে মাঝে মূত্রাশয়ের মধ্যে প্রচন্ড যন্ত্রণা অনুভব করতাম। হাসপাতাল থেকে সুস্থ্য হয়ে ফিরতে পারবে, সে আশা করিনি। বলা নিষ্প্রয়োজন আমি একেবারেই চলৎশক্তি রহিত হয়ে গিয়েছিলাম। দু”জন লোক ধরে আমাকে বাথরুমে নিয়ে যেতো। বিছানায় এপাশ ওপাশ করার শক্তি ছিলো না। বোধ হতো, দুটো পায়ের সঙ্গেই ভারি ওজনের কিছু বাঁধা। রক্ত চলাচলের অভাবে এ অনুভূতির সৃষ্টি হয়।

ডিসেম্বরের ২০ থেকে ১৫-১৬ জানুয়ারী পর্যন্ত বিছানা থেকে উঠবার কথা ভাবতে পারিনি। এরপর লাঠি ভর দিয়ে অন্য লোকের সাহায্যে আস্তে আস্তে হাঁটা শিখতে হয়। ধরে না রাখলে পড়ে যেতাম। দুপায়ের উপর দাঁড়িয়ে মানুষ যেভাবে দাঁড়ায় সে শক্তি আমার ছিলো না।

হাসপাতালে আমার বাসার লোকজন রোজই দেখতে আসতো। আরো এসেছিলো আমার দু” খালাতো বোন। কিন্তু আর কেউ ভয়ে এদিকে পা বাড়াতো না। পুরানো সহকর্মীদের মধ্যে ঢাকা ইউনিভার্সিটির ম্যাথামেটিকস ডিপার্টমেন্টের ডক্টর আজিজুল হক একদিন এসেছিলেন। আরেক দিন প্রিন্সিপাল সাইদুর রহমান। ইনি ছিলেন কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজে আমার সহকর্মী।

মাঝে মাঝে দু” একজন গেরিলা হঠাৎ করে আমার ক্যাবিনে এসে ঢ়ুকে পড়তো। বলতো আমার কথা তারা শুনেছে তাই চেহারা দেখতে এসেছে। একদিন আসে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের পুরানো এক ছাত্র। সেও গেরিলা বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলো। সে বললো, স্যার আপনাকে হত্যা করার ভার আমার উপর দেওয়া হয়েছিলো। আমি একদিন আপনার বাসা ভালো করে দেখে আসি এবং কোন কামরায় আপনার শোবার জায়গা তাও লক্ষ্য করে আসি। তবে শেষ পর্যন্ত স্থির করি যে যুদ্ধ শেষ হলেই যা করার দরকার তা করবো। এই ছেলেটিকে আমি বললাম, তোমরা বাংলাদেশ কায়েম করেছো, ভালো কথা, এখন অন্তত দেশে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করো।

আরেক দিনের কথা মনে আছে। ভয়ঙ্কর চেহারার এক ব্যক্তি হুড়মুড় করে আমার কেবিনে ঢুকে পড়ে। মুখে তার বড় বড় দাড়ি। মাথায় লম্বা চুল, হাতে বন্দুক। মনে হচ্ছিলো ও তখনই আমাকে গুলি করবে। লোকটা দাঁড়িয়ে আমাকে বললো, আপনার চেহারাটা এক নজর দেখতে এসেছি। এসব কিছুই ঘটে ইন্ডিয়ান আর্মির পাহারা উঠে যাবার। যে সাতদিন ইন্ডিয়ান আর্মির লোক আমাকে পাহারা দেয় তদ্দিন বাইরের কোন অপরিচিত লোককে আসতে দেওয়া হয়নি। সাতদিন পর স্থানীয় পুলিশের উপর দায়িত্ব দিয়ে ইন্ডিয়ান আর্মির লোকেরা সরে যায়। তখন থেকে শুরু হয় নানা উপদ্রব।

ইন্ডিয়ান আর্মির কাছে অনেক কথা শুনতাম। তারা প্রায়ই বলতো, তুম লোগ ইয়ে বাগাওয়াত কিউ কিয়া? অর্থাৎ তোমরা এই বিদ্রোহ করলে কেনো? তোমাদের দেশে যা দেখলাম, এ তো ইন্ডিয়াতে নেই। তোমাদের ঘরে ঘরে টিভি, তোমাদের ইউনিভার্সিটি লেকচারারের গাড়ি এসব বিলাসের কথা আমরা ইন্ডিয়াতে ভাবতে পারি না। অথচ তোমরা এখানে এসব থাকা সত্ত্বে মুসলমান মুসলমানের সঙ্গে যুদ্ধ করে এতোসব কান্ড ঘটিয়েছো। আমাদের তো আসতে হয়েছে ইন্দিরা মাইজির হুকুমে। আমরা সাধারণ সৈনিক, উপর থেকে যে হুকুম আসবে তা মানতেই হবে। ওরা, আরো বলতো, তোমাদের সিপাহীরা একেবারে অপদার্থ। একজন ইন্ডিয়ান সৈনিক দশটা পাকিস্তানী সৈনিকের সমান। এ কথা শুনে আমি মনে মনে হেসেছিলাম। কারণ ঠিক উল্টো রকমের আষ্ফালনই পাকিস্তানের অফিসারদের কাছে আগে শুনেছিলাম।

ইন্ডিয়ান আর্মির লোকজন আমার সঙ্গে যে সদ্ব্যবহার করে তার কারণ এই নয় যে আমার মতো মুজিব বিরোধী একজন লোককে সাহায্য করতে তারা খুব আগ্রহী হয়ে উঠেছিলো। মানধিক কারণ ছাড়া এই ব্যবহারের প্রধান কারণ ছিলো এই যে ১৬ই ডিসেম্বরের পর ইন্ডিয়ান অধিকৃত এ অঞ্চলে কোন বিশিষ্ট ব্যক্তির উপর অত্যাচার হলে সে জন্য ইন্ডিয়ান আর্মিরই দূর্নাম হবে। তাছাড়া দেশ জয় করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আসল উদ্দেশ্য সাধিত হয়। অকারণে বেসামরিক লোকজনের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের কোন যৌক্তিকতা তাদের কাছে ছিল না।

অনুরূপ কারণে ১৬ই ডিসেম্বরের পর ইন্ডিয়ান আর্মি অনেক বিহারীকে গেরিলাদের হাত থেকে রক্ষা করে। একথাও শুনেছি যে হিন্দীভাষী ইন্ডিয়ান সৈন্যরা যখন দেখতে পায় যে উর্দুভাষী বিহারীদের উপর গেরিলারা নির্মম অত্যাচার চালিয়েছে তখন বিহারীদের সঙ্গে একটা আত্মীয়তার ভাবে উদ্বূদ্ধ হয়ে তাদের প্রাণ রক্ষার কাজে এগিয়ে আসে। ৯ই জানুয়ারী পর্যন্ত আমি ৯ নাম্বার ক্যাবিনে ছিলাম। সেদিন সন্ধ্যার পর হঠাৎ করে আমাকে জানানো হলো যে আমাকে অন্য ক্যাবিনে সরে যেতে হবে। এখানে আসবেন এক মিনিস্টার। রাত্রের মধ্যেই স্ট্রেচারে করে আমাকে উনিশ নাম্বার ক্যাবিনে স্থানান্তরিত করা হয়। হাসপাতালের প্রায় অপর প্রান্তে। আর ৯ নাম্বার ক্যাবিনে আসেন খন্দকার মুশতাক আহমদ। শুনলাম, আসলে তিনি অসুস্থ্য নন, তবে নতুন সরকারের সঙ্গে মতবিরোধ হয়েছে বলে কুটনৈতিক অসুস্থতার আশ্রয় নিয়েছেন।

১৯ নম্বর ক্যাবিন

১৯ নলূর ক্যাবিনে এসে শুনলাম যে আগামীকাল ১০ই জানুয়ারী শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরছেন। আমার এক আত্মীয় জনাব আবদুল মুঈদ (খান বাহাদুর আব্দুল মোমিন সাহেবের কনিষ্ঠ পুত্র), আমাকে সান্ত্বণা দিয়ে বলে গেলেন যে দেখবে ভাই শেখ মুজিব ফিরে এসে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করবে এবং সবাইকে নিয়ে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করতে বলবে। আমি কিন্তু এ কথায় আশ্বস্ত হতে পারিনি। তবুও মনে একটা ক্ষীণ আশা জাগ্রত হলো যে ১৬ই ডিসেম্বর থেকে যেভাবে অরাজকতা চলছে, তার বোধ হয় অবসান ঘটবে। বাসা থেকে একটা রেডিও আনার ব্যবস্থা করলাম যাতে শেখ মুজিবের আগমন বার্তা সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পাই।

কাগজে দেখেছিলাম যে জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করার পর শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়েছিলেন। তাঁকে তখন লন্ডনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বৃটিশ বিমান বাহিনীর বিমানে দিল্লী হয়ে ঢাকা আসেন। দিল্লীতে কয়েক ঘন্টা ছিলেন এবং ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, একটা সভায়ও বক্তৃতা করেন। লন্ডনে তাকে রাখা হয়েছিলো ক্লারিজেস হোটেলে। এটা লন্ডনের সর্বোত্তম হোটেলগুলোর একটি। রাষ্ট্র প্রধানদের সাধারণত এ হোটেলে রাখা হয়। লন্ডন অবস্থানের সময় শেখ মুজিব এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে দাবী করেন যে বাংলাদেশে যুদ্ধে ৩ মিলিয়ন অর্থাৎ ৩০ লক্ষ লোক নিহত হয়েছে। এই আজগুবি সংখ্যার কথা আজো বাংলাদেশ সরকার এবং এখানকার রাজনৈতিক দলগুলি বলে বেড়াচ্ছে। নয় মাসের যুদ্ধে যেখানে কোন ভারি কামান ব্যবহার হয়নি, প্রচন্ড কোনো সংঘর্ষ হয়নি সেখানে ৩০ লক্ষ লোক কিভাবে নিহত হলো, তা কেউ বুঝাতে পারেনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও রাশিয়াকে বাদ দিলে অন্যান্য শক্তির মধ্যে মৃতের সংখ্যা ৩০ লক্ষ হবে না। কেউ কেউ বলে যে শেখ মুজিব তিন লাখের অর্থে ৩ মিলিয়ন বলেছিলেন। মিলিয়ন এবং লাখের তফাত তাঁর জানা ছিলো না। অনেক প্রবীণ ব্যক্তির কাছে শুনেছি যে মৃতের সংখ্যা দশ হাজারের বেশী নয়। কেউ কেউ বলে আসল সংখ্যা আরো কম। তবে এটা যে কোন রূপেই ৩০ লক্ষ হতে পারে না, সে কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। তবুও এই ৩০ লক্ষের কথা বলে বাংলাদেশের তরুণদের এখনো উত্তেজিত করা হয়। আর এই ভাবপ্রবণ দেশে এর বিরোধিতা করতে গেলেই স্বাধীনতার দুশমন বলে চিহ্নিত হতে হয়। চিন্তা-ভাবনা বা যুক্তি-তর্কের অবকাশ এখানে আছে বলে কেউ মনে করে না । বাস্তবিক পক্ষে মার্চ খেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ন” মাসে ক”জন নিহত হয় তার কোনো জরিপ হয়নি। একদিকে যেমন বলা হলো যে পাকিস্তান আর্মি ৩০ লক্ষ বাঙালীকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, অন্যদিকে শেখ মুজিব ঘোযণা করেন যে ৩ লক্ষ নারীর ইজ্জতও তারা নষ্ট করেছে। এবং প্রথম প্রথম এসব নির্যাতিত মেয়েদের পুনর্বাসন এবং বিবাহের ব্যবস্থা করা হবে এ আশ্বাস দেওয়া হয়। এসব বীরাঙ্গনাকে গ্রহণ করতে তরুণরা যাতে ইতস্ততঃ না করে সে পরামর্শ তারা পেয়েছিলো। একপর্যায়ে এদের জন্য ঢাকায় এক আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়। তখন শুনেছি শত খোঁজখবর করেও এ রকম বীরাঙ্গনার সন্ধান পাওয়া যায়নি। দেশের বিভিন্ন পতিতালয় থেকে দু”একজন মেয়েকে এখানে হাজির করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত যখন দেখা গেলো যে এরকম বীরাঙ্গনার সংখ্যা একশতেও উঠছে না তখন চুপচাপ করে এ প্রকল্প পরিত্যাগ করা হয়। এ সম্বন্ধে আর কোন উচ্চবাচ্য শুনিনি। তবে শেখ মুজিবের আমলে যেমন এখনও তেমন পঁচিশে মার্চ বা ১৬ই ডিসেম্বর সম্পর্কিত অনুষ্ঠানে তিন লক্ষ মা বোনের নির্যাতনের উল্লেখ থাকে।

আর্মির হাতে কেউ মারা পড়েনি বা কোন মেয়ে নির্যাতিত হয়নি, এ রকম উদ্ভট দাবী আমি করছি না। কিন্তু কথা হচ্ছে সংখ্যা নিয়ে। গ্রামে গ্রামে সুষ্ঠুভাবে জরিপ করলে নিহত এবং নির্যাতিতের সঠিক সংখ্যা অবশ্যই বের করা যেত। কিন্তু সরকার জরিপ করার সাহস পায়নি। কারণ কোনো জরিপ করলে তার মধ্যে নাম ধাম উল্লেখ করে ত্রিশ লাখের প্রমাণ পাওয়া যেতো না। ছয় বছর স্থায়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান বোমায় বৃটেনে ষাট হাজার নরনারী নিহত হয়। জার্মানীতে বেসামরিক লোকজন যারা মিত্র শক্তির বিমান অক্রমণে নিহত হয়েছিলো তাদের সংখ্যা তিন লাখ। এসব আমার মনগড়া কথা নয়। বইপত্রে যে সমস্ত তথ্য সরকারীভাবে স্বীকৃত হয়েছে তার মধ্যেই এসব হিসাব পাওয়া যাচ্ছে। তাই প্রশ্ন ওঠে যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মতো প্রলয়ংকরী একটা দুর্যোগে যেখানে মৃতের সংখ্যা এই সেখানে বাংলাদেশের গৃহযুদ্ধে ত্রিশ লাখ লোক নিহত হলো কি রূপে? আমি আগেই বলেছি যে এদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বিশেষ করে যারা পাকিস্তান বিরোধী কোনো ভূমিকায় জড়িত ছিলো তারা এ সম্বন্ধে কোনো পুনর্বিচার করতে রাজি নয়। ব্যক্তিগতভাবে অনেকে স্বীকার করেন যে ত্রিশ লাখের কথা একটা রাজনৈতিক চাল মাত্র। কিন্তু প্রকাশ্যে কেউ এর বিরোধিতা করতে এখনো সাহস পান না।

যে সমস্ত তরুণ-তরুণী ইতিহাস জানে না, ”৭১ সালে যাদের জন্মই হয়নি বা তখন যারা শৈশবাস্থা অতিক্রম করেনি তারা ধরে নিয়েছে যে ত্রিশ লক্ষ এবং তিন লক্ষ হিসাবের মধ্যে কোনো অতিরঞ্জন নেই। এর ফলে বিশ বছর পরও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারছে না। কারণ স্বাভাবিক করার কথা বললেই একদল লোক এদের স্মরণ করিয়ে দেয় ঐ ত্রিশ লক্ষ ও তিন লক্ষের কথা। আমরা এখনো একাত্তর সালের গৃহযুদ্ধের ফলে যে বিষবাষ্প সৃষ্টি হয়েছিলো তার ধকল কাটিয়ে উঠতে পারিনি। অথচ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যে জার্মানী এবং জাপানের সঙ্গে মিত্র শক্তিকে লড়াই করতে হয় তারা উভয়েই পশ্চিম ইউরোপ এবং আমেরিকার মিত্র। যুদ্ধের পর যে সমস্ত চুক্তি হয় তাতে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছিলো যে জার্মানী এবং জাপানকে ভবিষ্যতে সমরোপযোগী বাহিনী গঠন করতে দেওয়া হবে না। অথচ এখন আমেরিকাই জার্মানী এবং জাপানকে নিন্দা করছে এই বলে যে একানব্বই সালের মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে তারা সৈন্য পাঠাতে রাজী হয়নি কেনো?

কথা হচ্ছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চিরশত্রু ও চিরমিত্র বলে কোন কথা নেই। এর ব্যতিক্রম দেখছি শুধু বাংলাদেশে। পাকিস্তানের প্রতি হিংসা এবং বিদ্বেষ এক শ্রেণীর মধ্যে একটা কায়েমী স্বার্থে পরিণত হয়েছে, সে কথা আমি আগে একবার বলেছি। এর ফলে দেশের কি ক্ষতি হচ্ছে তা এরা ভাবছে না।

১০ই জানুয়ারী রেডিও খুলে শেখ মুজিবের ঢাকা আগমনের সংবাদের জন্য অপেক্ষা করে রইলাম। সংবাদ পরিবেশক বলতে লাগলেন কয়েক লক্ষ লোক নাকি তাঁকে অভ্যর্থনা করার জন্য এয়ারপোর্টে জমায়েত হয়েছিলো। এদের গলার আওয়াজও মাঝে মাঝে শোনানো হচ্ছিলো। শেখ মুজিবকে এয়ারপোর্ট থেকে মিছিল করে সোজা রমনা রেসকোর্সে নিয়ে আসা হয়। এখানেও লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয়েছিলো বলে শুনেছি। শেখ মুজিব আবেগজড়িত কণ্ঠে অনেক কথা বললেন। বাঙালী জাতির স্বাধীনতার কথা বললেন। আর বললেন ন”মাসে জাতির উপর যে অত্যাচার করা হয় তার কথা। কিন্তু কোথায়ও কোনো ক্ষমার কথা ছিলো না। ছিলো তথাকথিত দালালদের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার কথা, বিশেষ করে তাঁর নিজের বিরুদ্ধে মামলায় যারা সাক্ষী দিয়েছে তাদের শাস্তি দেওয়ার কথা।

আমি একটু নিরাশ হলাম। শেখ মুজিবের অবর্তমানে তাঁর দলীয় লোকেরা যে হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিলো তার ক্ষান্ত হওয়ার আশু সম্ভাবনা আমি দেখতে পেলাম না। শেখ মুজিব যদ্দিন পাকিস্তানে আটক ছিলেন ততদিন সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংরাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তাজুদ্দিন প্রধানমন্ত্রী। এঁরা শেখ মুজিবকে কোলকাতায় বসেই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট মনোনীত করেন। ২০ শে ডিসেম্বর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজুদ্দিন আহমদ এবং অন্য মন্ত্রীরা ঢাকায় এসে উপস্থিত হন। তার অর্থ যে অন্ততঃ ১৬ তারিখ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত এ অঞ্চলটি সরাসরি ইন্ডিয়ার অধীনে ছিলো। আইনের দিক থেকেও সেটা ঢাকা দেওয়া যেতো না। আরো একটা কথা এখানে উল্লেখ করা দরকার। ১৬ তারিখে পাকিস্তান আর্মির আত্মসমর্পণের দলিলেও বাংলাদেশ সরকারের কোন স্বাক্ষর নেই। কোলকাতা থেকে দাবী করা হতো যে বিদ্রোহীরা কর্ণেল ওসমানীর নেতৃত্বে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু আত্মসমর্পণের দলিলে কর্ণেল ওসমানীরও কোনো স্বাক্ষর ছিলো না। এটা ছিলো নিতান্তভাবে ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের যুদ্ধজনিত একটা ঘটনা মাত্র।

২০শে ডিসেম্বর আমাকে যখন হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় তখন দেশে কি হচ্ছে বা আমার বাসার লোকজনই বা কিভাবে দিন কাটাচ্ছে সে সম্পর্কে কৌতুহল প্রকাশ করার শক্তি আমার ছিলো না। মাথা থেকে পা পর্যন্ত সারা দেহে এবং দেহের অভ্যন্তরেও এতো যন্ত্রণায় ভুগছিলাম যে তিন চার দিন শুধু চুপ করে পড়ে থেকেছি। বাসার লোকজনও আমাকে কিছু বলেনি। এদের উপর যে অত্যাচার হয়েছিলো সে কাহিনী শুনেছি অনেক পরে। কিন্তু সেটা এখানে বিবৃত করা দরকার।

উনিশ তারিখে যেদিন গেরিলারা আমাকে পাকড়াও করতে আসে, তারা প্রথমেই বাড়ীর চাকর-চাকরাণীকে বন্দুক উঁচিয়ে সাবধান করে দেয়, তারা যেনো টু শব্দটি না করে। তারপর ওরা ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ে। সামনে আমার স্ত্রী এবং মেয়েদের পেয়ে তাদের চুল ধরে লাথি মেরে সরিয়ে দেয়। বয়সে যারা একেবারে ছোট তারাও রেহাই পায়নি। বড় মেয়ে উপরের কামরায় আমার সঙ্গেই ছিলো, সে কথা আগে উল্লেখ করেছি। মেঝো মেয়ের বয়স তখন সতেরো। তার উপরই বেশী জুলুম হয়। আমার কামরায় যখন গেরিলারা উঠে আসে তখন আমার বড় মেয়ে ছাড়াও দশ বছরের কাজের মেয়ে সেখানে উপস্থিত ছিলো। তার নাম ছিলো হোসনে আরা। সে চিৎকার করতে করতে কতক্ষণ গেরিলাদের জিপের পেছনে দৌড়াতে থাকে। তার গায়েও চড় চাপ্পড় লাগে। বাসার এক চাকর যার বয়স তখন চব্বিশ-পচিঁশ সেও প্রচন্ড মার খায়। আরো শুনেছি যে গেরিলাদের আমার বাসার সন্ধান দিয়েছিলো নাজিমউদ্দিন রোডের আওয়ামী লীগ শাখার এক ছোকরা। সে নিজে অবশ্য গেরিলাদের সঙ্গে বাসায় আসেনি, খুব সম্ভব চক্ষু লজ্জায়। কারণ এদের পরিবারকে আমরা বহুদিন যাবত চিনতাম। এবং এরা নাকি এখনো আওয়ামী লীগের প্রতি অনুগত। আমি এ ঘটনা উল্লেখ করছি এই কারণে যে ন”মাসের গৃহযুদ্ধের ফলে দেশে যে তিক্ততার সৃষ্টি হয় তার মধ্যে কে কোন দলের এ প্রশ্নটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। পুরানো পরিচয় বন্ধুত্ব সবই যেনো মুছে গিয়েছিলো। একদিকে ছিলো শেখ মুজিবের সমর্থকেরা, অন্যদিকে আমার মতো যারা পাকিস্তানে বিশ্বাস করতো তারা।

ডিসেম্বরের শেষে আমি আমার বেতনের চেকের জন্য ইউনিভার্সিটিতে লোক পাঠাই। ওরা আমাকে উনিশ তারিখ পর্যন্ত বেতন দিয়ে জানিয়ে দেয় যে আমার চাকরি নেই। এই আদেশ কখন জারী করা হলো তা আমাকে জানানো হয়নি। এবং আমার যদ্দুর মনে পড়ছে জানুয়ারীর আগে ভাইস চান্সেলরের পদে কাউকে নিযুক্ত করা হয়নি। খুব সম্ভব রেজিস্টার নিজের দায়িত্বে আমাকে চাকরি থেকে রেহাই দিয়েছিলেন। প্রথমে জাস্টিস আবু সাঈদ চৌধুরী এসে আবার ভাইস চান্সেলরের পদ অধিকার করেন। তিনি ১৫ই মার্চ থেকে লিখিতভাবে পদত্যাগ করেছিলেন, সে কথা আগে বলেছি। কিন্তু এখন যেভাবে তিনি এসে আবার ঐ চাকরিতে বহাল হলেন তাতে তাঁর পদত্যাগের কোনো উল্লেখ ছিলো না, যেনো বেআইনীভাবে ন”মাসে তাঁকে সরিয়ে রাখা হয়েছিলো। তবে তিনি ডিসেম্বরের শেষেই এসেছিলেন বা জানুয়ারীর প্রথম দিকে, সে কথা আমার স্মরণ নেই। যদ্দুর মনে পড়ে এটা জানুয়ারীর প্রথম দিকেই হবে। শেখ মুজিবুর রহমান দেশে প্রত্যাবর্তন করে স্থির করেন যে তিনি আবু সাঈদ চৌধুরীকে প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করে নিজে প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করবেন।

মুজাফ্ফর চৌধুরী

এরপর পলিটিক্যাল সায়ন্সের প্রফেসর মুজাফফর আহমদ চৌধুরীকে ভাইস চান্সেলর নিযুক্ত করা হয়। ইনি ছিলেন ভারত-প্রত্যাগত। আমার মনে আছে ষাটের দশকে ইনি ”সোনার বাংলা” পাকিস্তানে কিভাবে শ্মশানে পরিণত হয়েছে সে সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ইউনিভার্সিটিতে যে কয়েকজন শিক্ষক আওয়ামী লীগ আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন মুজাফফর আহমদ তাদেরই একজন। যদিও কর্মজীবনে একাত্তরের আগে তাঁর সঙ্গে আমার সদ্ভাব ছিলো, এখন পরিবর্তিত অবস্থায় তিনি আমাকে কতটা ঘৃণা করেন সেটা বুঝলাম আমার পরিবারের প্রতি তাঁর ব্যবহারে। আমি আগে বলেছি যে ১৫ই ডিসেম্বর আমরা তড়িঘড়ি করে কাপড়ের দু”টো সুটকেস নিয়ে ভাইস চান্সেলরের বাসা থেকে পুরনো ঢাকার বাসায় চলে এসেছিলাম। আমার বই, আসবাবপত্র, রান্নাঘরের সরঞ্জাম, বিছানার চাদর বালিশ, হাড়ি ডেকচি, শিলপাটা সবই ফেলে এসেছিলাম। মুজাফফর আহমদ চৌধুরী যখন ভাইস চান্সেলরের বাসায় পাকাপাকিভাবে অবস্থান গ্রহণ করেন, আমার মেয়েরা আমাদের মালপত্রণ্ডলো উদ্ধার করতে যায়। প্রথম দু”দিন ওদের গেট থেকেই বিদায় দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত যখন ওরা ভিতরে যেতে অনুমতি পায় তখন ওদের বলা হয় যে আমাদের মালপত্র ওখানে কিছুই নেই। বাসায় যা আছে তা ইউনিভার্সিটির সম্পত্তি। সেটা কিছুতেই দেওয়া যাবে না। আমার ব্যক্তিগত বই দু” কামরায় সাজানো ছিলো। এক কামরার কিছু বই মেয়েরা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। অন্য কামরায় ওদের যেতেই দেওয়া হয়নি। ফলে ছাত্র জীবন থেকে সংগৃহীত বহু মূল্যবান বইপত্র আমাকে হারাতে হয়েছে। যেসব জিনিস মেয়েদের চোখের সামনে পড়ে এবং যেগুলি তারা চিনতে পারছিলো সেগুলিও তাদের স্পর্শ করতে দেওয়া হয়নি। এর মধ্যে ছিল আমাদের পুরানো শিল পাটা এবং রান্না ঘরের হাড়িপাতিল। আমার বড় মেয়ে বিয়েতে একটা সুন্দর কার্পেট উপহার পেয়েছিলো, সেটা দেখতে পেয়ে মেয়েরা যখন বলে, ওটা বড় আপার কার্পেট, তখন ওদের এই বলে ধমকে দেওয়া হয় যে ওরা যেনো ফাঁকি দিয়ে নতুন ভাইস চান্সেলরের জিনিসপত্র হরণ করার চেষ্টা না করে।

আমাদের ব্যবহত প্লেট, পেয়ালা, চায়ের সেট, ছুরি-কাঁটা সবই এভাবে খোয়াতে হয়। আমি অনেক পরে ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বাসায় এসে এই ক্ষতির কথা শুনি। আশ্চর্য হয়ে ভাবি ভাইস চান্সেলর পদে অধিষ্ঠিত কোনো ব্যক্তির কাছে তো এই নোংরামী আশা করা যেতো না। কিন্তু একাত্তরে আমাদের সমস্ত মূল্যবোধ কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিলো।

এদিকে আমার বাসা থেকে আমার গাড়িটাও গেরিলারা নিয়ে যায়। এটা ছিলো একটা ছোট স্কোডা সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়ি, ৬৭ সালে কিনেছিলাম। আমি শুনেছি এই গাড়িতে করে অপহরণকারীরা ডাকাতিতে বের হতো। আমাদের ফ্যামিলি এতে আরো শঙ্কিত হয়ে ওঠে। কারণ শেষ পর্যন্ত ডাকাতির অপরাধে গাড়ীর মালিকই অভিযুক্ত হতে পারতো। গাড়ীটাকে ওরা যখন প্রায় অচল করে ফেলেছে তখন খোঁজ পাওয়া যায় যে ওটা একটা থানায় পড়ে আছে। সেখান থেকে অনেক তদবির করে গাড়ীটা ফেরৎ আনা হয়। এবং এটাকে আবার চালু করতে বেশ কিছু পয়সা খরচ হয়।

আমি বলেছি যে উনিশে ডিসেম্বর আমাকে যখন ওরা ধরে নিয়ে যায় তখন আমাদের বাসায় আমার ফুপাতো ভাই সৈয়দ কামরুল আহসান ছিলেন। তিনি সচরাচর থাকতেন হবিগঞ্জে। রাজনীতি করতেন। নেজামে ইসলাম পাটিঁর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ষাটের দশকে একবার প্রাদেশিক এসেমব্লিতে নির্বাচিত হন এবং পরে ন্যাশনাল এসেমব্লিরও সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। একাত্তরের অক্টোবরের দিকে আওয়ামী লীগের সিটে ইয়াহিয়া খান যে বাই ইলেকশনের হুকুম দিয়েছিলেন তাতে তিনি আবারও ন্যাশনাল এসেমব্লির সদস্য পদে নির্বাচিত হন। পিন্ডিতে যাবার পথে ঢাকা এসেছিলেন। কিন্তু তেসরা ডিসেম্বরে ইন্ডিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ায় তাঁর যাওয়া হয়নি। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরওয়ানা জারী হয় হবিগঞ্জে। হবিগঞ্জের পুলিশের নির্দেশ মতো তাঁকে খুঁজতে ঢাকার পুলিশ তার পৈত্রিক বাসা হাসিনা মঞ্জিলে যায়। কিন্তু তিনি ছিলেন আমাদের বাসায় জোহরা মঞ্জিলে, রাস্তার ঠিক উল্টো দিকে। পুলিশ যখন তাঁকে না পেয়ে ফেরত যাচ্ছে তখন তার আপন মেজো ভাইয়ের মেয়েরা বলে দেয় যে উনি আছেন বোনের বাসায় – জোহরা মঞ্জিলে। আমাদের বাসায় তল্লাশি শুরু হয়। এখানে তাঁকে সরু একটা গোলাঘরে লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো। পুলিশ আবার যখন ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছিল তখন ঐ মেয়েরাই পুলিশকে জানিয়ে দেয় ভালো করে গোলা ঘরে খুঁজে দেখতে। দ্বিতীয় বারের তল্লশিতে তিনি ধরা পড়েন। নিজের ভ্রাতুষ্পুত্রীরা যাদের সঙ্গে কামরুল আহসানের কোনো পূর্ব শক্রতা ছিলো না, তারাই এখন নিজেদের বাংলাদেশ প্রেমিক প্রমাণ করার লোভে তাঁকে ধরিয়ে দিয়েছিলো। এ রকম ঘটনা আরো হাজার হাজার হয়েছে। প্রত্যেকেই চেষ্টা করেছে নিজের প্রাণ বাঁচাতে এবং প্রত্যেকে মনে করেছে যে প্রাণ বাঁচাবার প্রকৃষ্ট পন্হা হচ্ছে অন্য কাউকে গেরিলাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া।

এরপর হামলা হয় সৈয়দ কামরুল আহসানের ছোট ভাই এডভোকেট সৈয়দ মঞ্জুরুল আহসানের উপর। সেও নেজামে ইসলামী পার্টিতে ছিলো। থাকতো হাসিনা মঞ্জিলেই। প্রথম দিন যখন তার তল্লাশি শুরু হয়, সে এসে আমাদের বাসায় আশ্রয় নেয়। আগের মতো হাসিনা মঞ্জিল থেকে জোহরা মঞ্জিলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মঞ্জুর তখন দেওয়াল টপকে পেছন দিয়ে সরে যায়। কয়েকদিন পাশের দু”একটি বাসায় লুকিয়ে থাকে। এরা আসলে আত্মীয় না হলেও তাকে আশ্রয় দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। তারপর যখন মঞ্জুর টের পায় যে এভাবে আত্মগোপন করে থাকলে তাকে ধরতে পারলেই গেরিলারা গুলি করে মারবে তখন সে স্বেচ্ছায় পুলিশের কাছে সারেন্ডার করে।

সৈয়দ কামরুল আহসান আমি হাসপাতালে থাকা অবস্থাতেই উনিশ দিন পর রিট পিটিশন করে জেল থেকে খালাস পেয়েছিলেন এবং তারপর দু”বছর ঢাকায় থাকতে বাধ্য হন। মাঝে মাঝে গোপনে আমাদের বাসায় আসতেন। হবিগঞ্জে যেতে সাহস পেতেন না এই ভয়ে যে পুলিশ ছেড়ে দিলেও গেরিলারা তাঁকে রেহাই দেবে না।

মঞ্জুরকে ছ”মাসের উপর জেলে কাটাতে হয়েছিলো। আমি জেলে যেয়ে শুনেছি যে সেও তখন জেলে। তারপর রিট পিটিশন করে সে উদ্ধার পায়, বন্দী অবস্থায় তার ফ্যামিলিতে একটি ট্রাজেডি ঘটে। তার চৌদ্দ বছরের বড় মেয়েটি টাইফয়েডে ভুগে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যায়।

আমরা যারা দালাল বলে চিহ্নিত হয়েছিলাম, ভয়ে এবং আতঙ্কে কোন আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধব আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসতো না। আমার এক সহপাঠীর কথা শুনেছি। তিনি কয়েক বছর নাজিমউদ্দিন রোড দিয়ে যাতায়াত করতেন না। পাছে আমার বাসার পরিচিত কোন লোকের সঙ্গে দেখা হয়।

এর ব্যতিক্রম পেয়েছি দু”টি ক্ষেত্রে। আমার এক খালাতো বোনের ফ্যামিলি প্রায়ই এসে হাসপাতালে খোঁজ-খবর করতো। ভগ্নিপতি সৈয়দ আহমদ রুমী ছিলেন আদর্শবাদী লোক। ছেলেমেয়েরা যদিও পুরাপুরি তার সে আদর্শে বিশ্বাস করতো না, আমার সঙ্গে ব্যবহারে তারা কখনো সে আভাস দেয়নি। তবে একদিন এই ফ্যামিলির বড় ছেলে লুলু আমাকে অবাক করে দিলো এক প্রশ্ন করে। জিজ্ঞাসা করলো, মামা, এ কথা কি সত্য যে আপনি যখন ভাইস চান্সেলর তখন আপনি মেয়েদের হল থেকে ক্যান্টনমেন্টে মেয়ে সাপ্লাই করতেন? আমি তাকে বললাম, লুলু, তুমি ছোটকাল থেকে আমাকে চেনো আর তোমার মায়ের সঙ্গে আমার, পরিচয় আমার জম্মের পর থেকেই। তুমি কি বিশ্বাস করতে পারো যে ঐরকম অপকর্ম আমার দ্বারা সম্ভব? লুলু একটু থমকে গেলো। বললো, না মামা, আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু এতো লোকে কথাটা আমার কানে দিয়েছে যে ভাবলাম আপনাকে সাহস করে সরাসরি জিজ্ঞাসা করবো।

ব্যাপার হলো যে আমরা যারা বিচ্ছিন্নতাবাদকে সমর্থন করিনি তাদের বিরুদ্ধে সব রকম অপবাদ প্রচার করা হয়। মুজাফফর আহমদ চৌধুরী ইউনিভার্সিটির লিগ্যাল এডভাইজারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন আমার বিরুদ্ধে তহবিল তছরুপের মামলা রুজু করতে। ঘটনাচক্রে তখন লিগ্যাল এডভাইজার ছিলেন আমার স্কুল জীবনের গৃহশিক্ষক মোহাম্মদ হোসেন। তিনি নিজে মঞ্জুর আহসানকে বলেছেন যে মোজাফফর আহমদ চৌধুরীর প্রস্তাব তিনি সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন। বলেন যে, আমি সাজ্জাদ কে ছোটকাল থেকেই চিনি। সে তহবিল তছরুপ করবে এ কথা আমি বিশ্বাস করতে রাজী নই। সত্তর বৎসর বয়স্ক গভর্নর মালেকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগও ছিলো। খাজা খায়ের উদ্দিন, সবুর খান, ফজলুল কাদের চৌধুরী এঁদের বলা হতো খুনী, তাঁরা নাকি নিজেরা অর্ডার দিয়ে বহু লোককে খুন করিয়েছেন।

অন্য যে এক ব্যক্তি সেই দ্যুর্যাগের সময় আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো সে ছিলো রাজশাহী ইউনিভার্সিটির এক হলের পিয়ন। নাম মোক্তার হোসেন। এর কথা আগে উল্লেখ করেছি। ছেলেটি ঢাকায় আমাদের বাসায়ই মানুষ হয়। বড় হলে বিয়ে দিয়ে রাজশাহীতে ওকে একটা চাকরী দিয়েছিরাম। যার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয় সেও আমাদের বাড়ীতে প্রতিপালিত একটি এতিম মেয়ে। মোক্তার আমার খবর শুনে ছুটির একটা দরখাস্ত দিয়ে ঢাকা ছুটে আসে। এক মাস সে আমার কাছে হাসপাতালে ছিলো। চাকরীর পরওয়া করেনি। এক মাস বা দেড় মাস ছুটি মঞ্জুর হবে, সে রকম আশা ছিলো না, কিন্তু বলে কয়েও তাকে রাজশাহীতে ফিরে যেতে বাধ্য করতে পারিনি। আমি যখন একটু একটু করে হাঁটার ক্ষমতা ফিরে পেয়েছি তখনই কেবল বুঝিয়ে শুনিয়ে ওকে রাজশাহীতে পাঠনো হয়।

এই গরীব ছেলেটির মহানুভবতা ভুলবার নয়। যখন আত্মীয়-স্বজন ভয়ে কাছে ভিড়তো না তখন সাহস করে এই ছেলেটি সুদূর রাজশাহী থেকে ছুটে এসে যে উদারতা দেখিয়েছিলো সে রকম উদাহরণ একাত্তর-বাহাত্তর সালে ছিলো খুব বিরল।

বাসায় চাকর-চাকরানী যারা ছিলো দু” একজন ছাড়া প্রায় সবাই ভয়ে পালিয়ে যায়। কারণ রাস্তাঘাটে আওয়ামী লীগের লোকেরা এদের নানা হুমকি দিতো। বাসা যখন প্রায় একেবারে খালি এবং একজন চাকর ছাড়া পুরুষ আর কেউ নেই তখন আমার স্ত্রীর অনুরোধে বরিশালের কয়েকটি ছেলেকে বাসার বৈঠকখানায় থাকতে দেওয়া হয়। এদের সঙ্গে পরিচয় বহুদিনের। আমার স্ত্রীকে ওরা ফুপু বলতো। ওরা ছিলো চার ভাই। এরা পথেঘাটে নানা বিদ্রুপ ও হুমকির সম্মুখীন হতো।

একদিন রাত্রে বন্দুকধারী কয়েকজন গুন্ডা এসে হাজির হয়। তখনো বরিশালের ছেলেগুলি বাসায় আসেনি। পুরুষের মধ্যে আমাদের সেই পুরানো চাকর রহমান একা। গুন্ডারা জোর করে বাড়ীতে ঢুকে লুটপাট করবে। আমার স্ত্রী একা ওদের মোকাবেলা করছেন। রহমান সঙ্গে দাঁড়িয়ো হঠাৎ সে গুন্ডাদের একজনকে চিনে ফেলে। বলে ওঠে আপনি না আলী আহসান সাহেবের ছোট ভাই আলী রেজা সাহেবের ছেলের বন্ধু। আমি এখনই আপনার বন্ধুকে খবর দিচ্ছি। আচমকা এ কথা শুনে বন্দুকধারী ছেলেটি লজ্জা পেয়ে যায়। এবং তখন বাড়ী ছেড়ে চলে যায়।

এই যে ছেলেটির কথা বললাম একে আমিও চিনতাম। ওদের বাসা ছিলো নাজিমুদ্দিন রোড এবং হোসনী দালাল রোডের সংযোগ স্থলে। বাপ শিক্ষিত। ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষক আহসানুল হক এ বাড়ীতে বিয়ে করেন। ছেলেটিকে যখন প্রথম দেখি তখন এর বয়স বোধ হয় নয় দশ হবে। একাত্তর সালে সম্ভবত আঠারো উনিশ। এই বয়সের এবং এ রকম পরিবারের বহু ছেলে দেশ উদ্ধারের নামে গুন্ডামী ও ডাকাতি করে বেড়িয়েছে।

এরাই ১৬ই ডিসেম্বরের পর ঢাকা এবং অন্যান্য শহরের বহু বাড়ী দখল করে এবং কারখানা ফ্যাক্টরী, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করায়ত্ত করে। একটা গল্প শুনেছি। এক গেরিলা ধানমন্ডি এলাকার এক বিরাট বাড়ী দখল করে তার ফ্যামিলিকে সেখানে নিয়ে আসে। বাপ ছিলেন ধর্মভীরু। তিনি যখন টের পান যে একেবারে বেআইনীভাবে বাড়ীর মালিককে তাড়িয়ে দিয়ে আসবাবপত্র সহ বাড়ীটা দখল করা হয়েছে তখন তিনি আপত্তি করতে থাকেন। ছেলে তাকে শুনিয়ে বলে আপনি সারাজীবন চাকরী করে আর তসবিহ টিপে এক কাঠা জমির মালিকও হতে পারেননি। আপনার পছন্দ না হলে আপনি এ বাড়ী থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন। অবশ্য বাপকে সে জন্য সত্যই তাড়িয়ে দিয়েছিলো কিনা তা শুনিনি। কিন্তু এটা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিলো না।

বুভুক্ষু পঙ্গপালের মতো গেরিলারা এবং আওয়ামী লীগের লোক যারা দেশের ভিতরে চুপ করে ছিলো তারা পাকিস্তানবাদী এবং বিহারী বলে চিহ্নিত লোকদের বাড়ী ঘরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এদের জন্য কোনো আইন ছিলো না। দেশোদ্ধারের জন্য এরা পরিশ্রম করেছে তার পারিশ্রমিক স্বরূপ এদের অবাধে লুটপাট করার স্বাধীনতা দেওয়া হয়। এর মধ্যে সরকারী অফিসাররাও ছিলেন। তাঁরাও সুবিধা মতো বাড়ী-ঘর-সম্পত্তি দখল করেছেন। শুনেছি শেখ মুজিবুর রহমানের বন্ধু এক পুলিশ অফিসার রাজারবাগে কয়েক বিঘা জমি এ রকম করে দখল করেন। এই জমিটা ডায়াবেটিক সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম ডাক্তার মোহাম্মদ ইবরাহিম ডায়াবেটিক হাসপাতাল করার জন্য সরকার থেকে পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কিছুতেই এটা পুনরুদ্ধার করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত সরকার ডাক্তার ইবরাহিমকে শাহবাগে এক খন্ড জমি দান করে। এখানেই বর্তমানে ডায়াবেটিক সেন্টার ও হাসপাতাল অবস্থিত।

ন” মাসে ব্যাংক লুটের ঘটনা কিছু কিছু ঘটেছে। কিন্তু এখন এটা হয়ে দাঁড়ায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। শোনা যায়, এ রকম ঘটনার সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের এক ছেলে জড়িত ছিলো। এ কথা বহু লোকের মুখে শুনেছি। তবে এর সত্যতা সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে আমার পক্ষে কিছু বলা অসম্ভব।

শেখ মুজিবুর রহমান দেশে এসেই প্রথমে ঘোষণা করেন যে প্রথম তিন বছর তিনি জাতিকে কোনো কিছুই দিতে পারবে না। এ সময়টা ব্যয়িত হবে পুনর্গঠনের কাজে। এবং তখন নানা আত্মত্যাগের জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি আরো দাবী করেন যে পাকিস্তান আর্মির আত্মসমর্পণ করার সঙ্গে সঙ্গে দেশে পূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং বিদেশীরা নির্বিঘ্নে পুঁজি বিনিয়োগ করতে পারে। এক বিদেশী সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব জানান যে ঢাকার পরিস্থিতি নিউইয়র্কের চেয়েও নিরাপদ। রাত্রেও নাকি এখানে নির্ভয়ে লোকেরা রাস্তায় চলাফেরা করতে পারে। অথচ হাসপাতালে শুয়ে রোজই শুনতাম এবং কাগজেও দেখতাম বিভিন্ন এলাকায় খুনের খবর। পাকিস্তানপন্থী এবং উর্দুভাষী বিহারী এ সময় বিনা বিচারে গেরিলাদের নিমর্মতার শিকার হয়েছে। বহু জায়গায় উন্মত্ত জনতা লোকজনকে ধরে দালালীর অভিযোগে সেখানেই হয় পিটিয়ে কিম্বা বন্দুকের গুলিতে কিম্বা দা দিয়ে মাথা কেটে শাস্তি দিয়েছে।

বাহাত্তরের জানুয়ারীর আরো দু”টি ঘটনা আমার বিশেষভাবে মনে পড়ে। চারদিকে তখন বাঙালী জাতীয়তাবাদ এবং মুজিববাদের শ্লোগান। হিন্দু মুসলিম ভেদাভেদ উঠে গেছে। শেখ মুজিবুর রহমান সমগ্র বাঙালী জাতির ত্রাণকর্তা এবং সেহেতু বাঙালীদের নিয়ে যেখানেই যা হচ্ছিলো তার তদারক ও বিচার করার দায়িত্ব যেনো তাঁর। আওয়ামী লীগের ছাত্র নেতা আ স ম আবদুর রব দাবী করেন যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে সুভাষ বসুর রহস্যজনিত মৃত্যু সম্পর্কে একটি তদন্তে কমিশন গঠন করতে হবে। কারণ তিনি তো বাঙালী।

ছাব্বিশে জানুয়ারী ইন্ডিয়াতে যখন রিপাবলিক ডে বা প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপিত হয় তখন ইন্ডিয়ার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করার জন্য এক ডেলিগেশন দিল্লী যায়। দেশবাসীকে বুঝানো হলো যে ”দখলদার” পাকিস্তান বাহিনীর পরাজয়ের পর কংগ্রেসের আদর্শের সঙ্গে আমাদের আর বিরোধ নেই। এই ডেলিগেশনে মন্ত্রীরাও কেউ কেউ ছিলেন।

নতুন সরকার আর এক কান্ড করে। যার ফলে নৈরাজ্য আরো বৃদ্ধি পায়। যেহেতু বাংলাদেশ সরকারের মূলনীতি ছিলো চারটিঃ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা সেইহেতু সমাজতন্ত্রের নামে সব ব্যাংক, কর্পোরেশন, মিল ফ্যাক্টরী সরকারের আয়ত্তাধীনে আনা হয়। পুরাতন ম্যানেজার এবং ডিরেক্টরদের সরিয়ে আওয়ামী লীগের লোকজনকে ঐ সব বড় বড় পদে বসানো হল। এরা ছিলো একেবারে অনভিজ্ঞ। নতুন ক্ষমতা পেয়ে এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারখানা বা মিলের মালপত্র যন্ত্রপাতি বিক্রয় করে রাতারাতি বড় লোক হওয়ার চেষ্টায় মেতে উঠে। শুনেছি যে এভাবে দেশের পাটের কল এবং টেক্সটাইল মিলগুলি প্রায় পঙ্গু হয়ে পড়ে। পুরাতন মাত্রায় উৎপাদন চালিয়ে যাবার উদ্যোগতো ছিলোই না বরঞ্চ চাকরির খাতায় (payroll) বহু ভুয়া নাম বসিয়ে তাদের নামে টাকা আত্মসাৎ করা হতো। ফলে রাতারাতি এ সব মিল কারখানায় মুনাফার বদলে লোকসানের পরিমাণ এতো বৃদ্ধি পায় যে আজ পর্যন্ত বিশ বছর পরও সে ঘাটতি থেকে বাংলাদেশ পরিত্রাণ পায়নি। তারপর আরো শুনেছি যে এসব আওয়ামী লীগপন্থী পদ-কর্তার সাহায্যে বহু যন্ত্রপাতি ইন্ডিয়াতে পাচার হয়ে গিয়েছিলো।

পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ জুট মিল-এ বহু বিহারী কর্মী ছিলো। এই মিলের জেনারেল ম্যানেজারও  ছিলেন একজন অবাঙ্গালী। পাট সম্বন্ধে তিনি ছিলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ। তাঁকেও নানাভাবে নাজেহাল করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত তিনি ইন্ডিয়ায় যান এবং সঙ্গে সঙ্গে সেখানে কলকাতায় জুট মিলে একটা বড় চাকরি পান।

শুধু যে ভুয়া নাম বসিয়ে টাকা আদায় করা হতো তা নয়। শ্রমিকরা মনে করতে শুরু করে যে কাজ করুক বা না করুক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তাদের বেতন গ্রহণের অধিকার থাকতে হবে। মিলগুলো কোন রকমে চালু রাখতে সরকারকে তখন থেকে প্রচুর পরিমাণ গচ্চা দিতে হচ্ছে। এক পর্যায়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমানে নাম শেরাটন) কর্মরত শ্রমিকরা দাবী তোলে যে হোটেলটি যেনো তাদের মালিকানায় ছেড়ে দেওয়া হয়।

এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার ক্ষমতা কারো ছিলো না। একেতো মুজিবের সঙ্গে ছিলেন কয়েকজন অর্থনীতিবিদ যাঁরা কেতাবী সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন এবং মুজিবকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে কলকারাখানা, ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত করে নিলে বাংলাদেশ রাতারাতি একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হবে। শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনাও মাফ করে দিয়েছিলেন। শেষে যখন দেখা যায় যে এর ফলে রাজস্বে একটা বিরাট ঘাটতি সৃষ্টি হবে তখন আমলারা তাঁকে বুঝিয়ে খাজনা আবার পুনঃ প্রবর্তিত করেন উন্নয়ন ট্যাক্স বা ডেভলপমেন্ট ট্যাক্স নামে।

মুজিববাদ

কাগজপত্রে বক্তৃতায় প্রচার করা হতো যে ”মুজিববাদ” বিশ্বে একটা বিপ্লব এনে দেবে। সমাজতন্ত্রের চাইতেও নাকি এর মধ্যে প্রগতির সম্ভাবনা আরো অধিক। এই ”মুজিববাদের” প্রধান তাত্ত্বিক ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ মনি। এ যে শ্লোগান চালু করে সেটা হলো, ”বিশ্বে এলো নতুন বাদ-মুজিববাদ, মুজিববাদ”। মুজিববাদের বৈশিষ্ট্য নাকি. এই যে সমাজতন্ত্র যেখানে জাতীয়তাবাদের স্বীকৃতি নেই সেখানে মুজিববাদে জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্রের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়ে বিশ্বে একটা নতুন আদর্শ স্থাপন করা হলো এবং এই পথেই এশিয়া এবং আফ্রিকার সমস্ত অনুন্নত দেশের মুক্তি খুঁজতে হবে। এই শেখ মনিই পরে বিপুল সংখ্যক আওয়ামী যুবককে নিয়ে পূর্ব জার্মানীতে ”ইয়ুথ ফেস্টিভালে”- যোগ দিয়েছিলো।

ডিসেম্বরের শেষে বা জানুয়ারীর শুরুতে আরো অনেক খবর কানে আসতে থাকে। শুনলাম যে যদিও সৈয়দ আলী আহসান ইন্ডিয়াতে গিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সমর্থনে প্রচার কার্যে লিপ্ত হয়েছিলেন, তার আপন চাচাতো ভাই যশোরের সৈয়দ ওবায়দুল্লাহ ওরফে সুবা এসময় গ্রেফতার হয়ে জেলে যায়।

১৬ই ডিসেম্বরের পরের অরাজকতা

গেরিলারা ১৬ই ডিসেম্বরের পর নির্যাতন করে সুবার একটা হাতও ভেঙ্গে ফেলে। সুবার মতো তাঁর ভগ্নিপতি বশির উদ্দিন মাজমাদারও নির্যাতিত ও গ্রেফতার হন। মাজমাদার সাহেব পাকিস্তান আমলে কিছুকাল প্রাদেশিক মন্ত্রী ছিলেন। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো যে এঁরা দু”জনেই পাকিস্তানে বিশ্বাসী।

পাকিস্তানে বিশ্বাসী আমাদের পরিচিত আর এক ব্যক্তির অবস্থা নিয়ে এ সময় অনেক জল্পনা-কল্পনা শুনেছি। এর নাম মৌলবী ফরিদ আহমদ। মৌলবী ফরিদ আহমদ ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজিতে ডিগ্রী নিয়েছিলেন। আমার চার বছরের ছোট খুবই আদর্শবাদী। পাকিস্তান জাতীয়তাবাদে তাঁর আস্থা ছিলো মজবুত। তিনি জানতেন তাঁর জীবন বিপন্ন হতে পারে। ১৬ই ডিসেম্বরের আগে একদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। দেখলাম সঙ্গে বন্দুকধারী গার্ড। প্রথম প্রথম শুনতাম যে পাকিস্তান আর্মির আত্মসমর্পণ করার পর তিনি সুন্দরবন অঞ্চলে চলে যান এবং সেখান থেকে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব গুজবের কারণ, মৌলবী ফরিদ আহমদকে যারা চিনতো তারা জানতো যে সহজে নতি স্বীকার করার লোক তিনি নন। অনেক পরে খবর পেয়েছি যে, ঢাকা ইউনিভার্সিটির একটি হলে আটক করে তাঁকে খুন করা হয়। কিন্তু অদ্যবধি তাঁর লাশের কোনো খোঁজ হয়নি।

”জয় বাংলা” বলতে অস্বীকার করায় বহু লোককে জবাই করা হয়। দাড়িওয়ালা লোক দেখলেই গেরিলারা ধরে নিতো যে সে হয় মুসলিম লীগ বা জামাতের সমর্থক। এভাবে যে কত লোক নিহত হয় তার হিসাব কেউ জানে না। তখন এই নিধন যজ্ঞকে বলা হতো দেশ প্রেমের উৎকৃষ্ট প্রকাশ।

একটা গৃহযুদ্ধের অবসান হবার পর ক্রোধ এবং হিংসার বিষ্ফোরণ ঘটে। কিন্তু বাংলাদেশে যতো লোক ১৬ই ডিসেম্বরের পর বিভিন্ন গেরিলা বাহিনীর নির্মমতার শিকার হয়েছে ততো আর কোনো দেশ হয়নি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে ফ্রান্স নাৎসী মুক্ত হলে হিটলার বিরোধী প্রতিরোধে যারা যোগ দিয়েছিলো তারা অনেক শত্রুকে গুলী করে মেরে ফেলে। কিন্তু এদের সংখ্যা তেমন নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে যে, মার্শাল পেঁত্যা নাৎসীদের সহায়তায় ফ্রান্সের পূর্বাঞ্চলে ভিশিতে এক সরকার গঠন করেছিলেন। তাঁকেও বিজেতা জেনারেল দ্যাগল হত্যা করেননি। মার্শাল পেঁত্যার বিচার হয়েছিলো। তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও স্বীকার করা হয় যে মার্শাল পেঁত্যার মতো ব্যক্তি যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সেনাধ্যক্ষ হিসাবে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেন তাকে দেশদ্রোহী বলা সমীচীন হবে না। তিনি চেয়েছিলেন যে ফ্রান্স যাতে একেবারে ধ্বংস প্রাপ্ত না হয়। অবশ্য তাঁর মন্ত্রী সভার কয়েকজন সদস্য হিটলারবাদের সমর্থন করেছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন লাভাল এবং এডমিরাল দারলাঁ। আমার যদ্দুর স্মরণ আছে এ দু”জনের মৃত্যূদন্ড হয়। মার্শাল পেত্যাঁকে নিয়ে বহুদিন বিতর্ক চলে। শেষ পর্যন্ত তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। তাঁর মৃত্যূর পর তাঁকে জাতীয় বীরের সম্মান দেওয়া হয়েছে।

১৬ই ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশে দেখলাম এর ব্যতিক্রম। যাঁরাই শেখ মুজিবকে সমর্থন করেননি তাঁরাই হয়েগেছেন পাকিস্তান আর্মির ঘৃণ্য দালাল। আর অনেক চোর-বদমাশ গাঁয়ে মুজিববাদের লেবেল এঁটে হয়ে উঠে বড় দেশপ্রেমিক। দেশ প্রেমিক নির্ধারণের এই নতুন মাত্রাটি বিশ বছর পরও পরিত্যক্ত হয়নি। তার ফলে একাত্তর সালে দেশে যে বিভেদ ঘটেছিলো তা নিরসনের আশু সম্ভাবনা নেই বললেই চলে এবং এখনো সমাজ দ্বিধা বিভক্ত।

আমার উপর যে হামলা করা হয়েছিলো সে সম্বন্ধে কোন খবর দেশের কোনো পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। জানুয়ারীতে একদিন দেখলাম ইংরেজী অবজারভার পত্রিকায় আমার নাম। দালাল হিসেবে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিলো সেই তালিকায়। তখন বুঝতে পারলাম যে আমি একজন গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি। এবং এটাই পুলিশ পাহারার কারণ। তখনো জানা ছিলো না ভাঙ্গাচুরা অবস্থায় শিগগিরই আমাকে জেলে পাঠানো হবে।

একদিন হাসপাতালের অন্য ক্যাবিন থেকে এক ব্যক্তি দেখা করতে আসেন। বয়স্ক লোক। মুখে দাড়ি। বললেন ১৬ই ডিসেম্বরের পর থেকে ১০ই জানুয়ারী পর্যন্ত অনশন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর এমনই ভক্ত যে তাঁকে পাকিস্তান থেকে রেহাই না দিলে আমরণ অনশন চালিয়ে যেতেন। শেখ মুজিব এসে খবর পেয়ে লোকটিকে মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসার্থে পাঠিয়েছিলেন। এ রকম ঘটনা আরো দু”একটির কথা শুনেছি। এক শ্রেণীর লোকের মধ্যে শেখ মুজিবের উপর প্রগাঢ় আস্থা ছিলো। তারা বিশ্বাস করতো যে দেশের মাটিতে শেখ মুজিব পা দেওয়া মাত্র দেশের সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এ রকম এক ব্যক্তির লেখা এক চিঠি অবজারভারে পড়ি। শেখ মুজিব বোধ হয় খন্দকার মোশতাক বা ও রকম কাউকে দেখতে হাসপাতালে এসেছিলেন। ভদ্রলোক লিখেছিলেন যে তাঁর সঙ্গে প্রচুর সংখ্যক গার্ড ছিলো না। দেশের এই সংকটময় মুহুর্তে এভাবে অরক্ষিত অবস্থায় তিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে তুলেছেন-এ আশংকায় ভদ্রলোক শিউরে উঠেছিলেন। তবে মজার কথা, ঐ জানুয়ারী মাসেই অন্য রকমের কথাও কানে আসতে থাকে। কিন্তু এ কথা সত্য যে ১৬ই ডিসেম্বরের পর সারাদেশে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের মধ্যে এক ধরনের ইউফোরিয়া বা উল্লাস ও আশাবাদের সঞ্চরণ হয়েছিলো।

জিনিস পত্রের দাম জানুয়ারীতে হুহু করে বাড়তে শুরু করে। এ বৃদ্ধির পরিমাণ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা বলা ছিলো অসম্ভব। আমার মনে আছে একদিন আমার এক মেয়ে জিজ্ঞাসা করে কিছু জামদানী শাড়ী কিনে রাখবে কিনা। ওগুলো ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ টাকায় বিক্রী হচ্ছিলো। আমি বারণ করেছিলাম এই বলে যে এটা কেনাকাটা করার সময় আমাদের নয়। তখন ধারণাই করতে পারিনি যে ত্রিশ টাকার শাড়ী কয়েক দিনের মধ্যেই হাজার টাকা ছাড়িয়ে যাবে। বর্তমানে এসব শাড়ীর দাম চার-পাঁচ হাজার টাকার উপর উঠেছে বলে শুনেছি।

মুজিব সরকার প্রচলিত সমস্ত ব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলে নতুন রাষ্ট্র গড়তে উদ্যোগী হয়ে উঠেন। পাকিস্তান আমলের কোনো কিছুই রাখা হবে না। বলে ঘোষণা করা হয়। নতুন যে মুদ্রা চালু করা হলো তার নাম দেওয়া হয় টাকা। টাকা কথাটা নতুন নয় বৃটিশ আমলেও ইন্ডিয়ার অন্যত্র যে মুদ্রাকে রুপী বলা হতো, বাংলা ভাষায় তার নাম ছিলো টাকা। পুরানো নোটে প্রায় আট-দশটি ভাষায় মুদ্রার নাম লেখা থাকতো। ইংরেজি, হিন্দী, গুজরাটি প্রভৃতি ভাষায় যে শব্দটি পাওয়া যেতো সেটি হলো রুপী বা রুপিয়া আর বাংলায় টাকা। মুদ্রার নাম আনুষ্ঠানিকভাবে টাকা করাতে ইন্ডিয়ান রুপী বা পাকিস্তানের রুপীর সঙ্গে এক বিনিময় হারের প্রশ্ন ওঠে এবং প্রথম দিকে এতে প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হয়।

পাকিস্তান আমলের ব্যাংকগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকার নতুন কতগুলি নামের ব্যাংক চালু করে। এর মধ্যে ছিলো সোনালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক ইত্যাদি। ব্যাংকিং ব্যবসায় এই বিপ্লব ঘটাতে গিয়ে বাংলাদেশ পুরানো ব্যাংকগুলোর সম্পদ থেকে রাতারাতি বঞ্চিত হয়। দেশ পরিচালনার ভার যাদের উপর এসে বর্তেছিলো তারা মনে করতেন যে একেবারে নতুন করে তাঁরা সবকিছু করবেন, ঐতিহ্যের প্রয়োজন নেই। পাকিস্তান আমলের খবরের কাগজে কতগুলোর নাম ১৬ই ডিসেম্বরের পর থেকে বদলে যায়। পাকিস্তান অবজারভার আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ অবজারভার নামে, দৈনিক পাকিস্তানের নাম হয় দৈনিক বাংলা এবং মর্নিং নিউজের পরিবর্তে বের হয় বাংলাদেশ টাইমস। আমার যদ্দুর মনে পড়ে ১৬ই ডিসেম্বরের কিছুকাল পরই মর্নিং নিউজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। এই পত্রিকাটির উপর আওয়ামী লীগের আক্রোশ ছিলো বেশী। এর এডিটর ছিলেন একজন উর্দুভাষী ভদ্রলোক। অবজারভারের মালিক হামিদুল হক চৌধুরী পাকিস্তানে আটকা পড়েছিলেন। এবং যদিও একাত্তর সালে তিনি পাকিস্তানের পতনের সম্ভাবনায় বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন, তাঁর ইংরেজী পত্রিকা ছিলো প্রধানতঃ বাঙালী জাতীয়তাবাদের লালন ক্ষেত্র। সত্তর সালেও এডিটর আবদুস সালাম এবং হামিদুল হক চৌধুরী স্বনামে প্রবন্ধ লিখে আলাদা বাঙালী কালচারের কথা প্রচার করেন। এঁদের চৈতন্যোদয় হয় যখন সত্তর সালের অক্টোবরের দিকে আওয়ামী লীগপন্থী তরুণরা বলতে শুরু করে যে তারা ক্ষুদিরামের বংশধর। আমার মনে আছে সালাম সাহেব এর জোরালো প্রতিবাদ করে এক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। বলেছিলেন যে পূর্ব বাংলা মুসলমানের ঐতিহ্য তো ক্ষুদিরামের ঐতিহ্য নয়। কিন্তু তখন অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে।

খুব সম্ভব গভর্ণর মোনেম খান ”পয়গাম” নামে যে দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন সেটাও ১৬ই ডিসেম্বরের পর বন্ধ হয়ে যায়। ”পয়গামের” প্রেস আওয়ামী লীগাররা দখল করে। তবে এটা কোন তারিখের ঘটনা, সে কথা আমার পরিস্কার মনে নেই।

মুজিব সরকারের আরেক কীর্তি হচ্ছে রেডিও ও টিভি থেকে কোরআন তেলাওয়াত বাতিল। তাদের যুক্তি ছিলো যে ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে কোরআন তেলাওয়াতের সঙ্গতি বিধান করা যায় না। শেষে শ্রোতাদের প্রবল চাপে আবার যখন কোরআন তেলাওয়াত পুনরায় চালু করতে হয় তখন স্থির করা হয় যে কোরআনের সঙ্গে গীতা, ত্রিপিটক ও বাইবেল পাঠ করা হবে। এ ব্যবস্থা এখনো চলছে।

আমি উপরে বলেছি যে মুজিব বিরোধী বহুলোক ১৬ই ডিসেম্বরের পর নির্যাতিত এবং গ্রেফতার হয়। এর মধ্যে এমন লোকও ছিলো যারা শেষ দিকে বাংলাদেশ আন্দোলনে যোগ দেয়। এ রকম এক ব্যক্তি ছিলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটির সাবেক ভাইস চান্সেলর ডক্টর মোহাম্মদ ওসমান গনি। ভিসির পদ থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি কেনিয়ায় পাকিস্তানের হাইকমিশনার হন। এবং সেখানে মুজিবের প্রতি আনূগত্য ঘোষণা করে লন্ডন চলে যান। কিন্তু এতে তিনি রেহাই পাননি। ঢাকায় গভর্নর মোনেম খানের কট্টর সমর্থক বলে তার দুর্নাম ছিলো। লন্ডনে আট বা নয় জানুয়ারী শেখ মুজিব যখন পৌছান তখন বাঙ্গালী যারা তাঁকে অভ্যর্থনা করতে এগিয়ে এসেছিলো ডক্টর গনিও তার মধ্যে ছিলেন। কিন্তু তাঁর পরিচয় জানাজানি হওয়া মাত্র তাকে নাজেহাল করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।

এ রকম আরেক ব্যক্তি ডক্টর মফিজউদ্দিন আহমদ চাকরিচ্যূত হন। তিনি ছিলেন কেমিস্ট্রির অধ্যাপক। সত্তর সালে জাহাঙ্গীর নগর মুসলিম ইউনিভার্সিটির ভাইস চান্সেলর নিযুক্ত হন। তিনি কোনো মুজিব বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হননি। কিন্তু যেহেতু তিনি ভিসির পদ লাভ করেন গভর্ণর মোনেমের আমলে সেহেতু মুজিব সরকার তাকে বরখাস্ত করে। তাঁরই স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন সৈয়দ আলী আহসান।

শেখ মুজিব দেশে প্রত্যাবর্তন করার পর সবচেয়ে বড় নাটক শুরু হয় পরাজিত পাকিস্তানী সৈন্যদের নিয়ে। এদের সংখ্যা ছিলো ৯৩ হাজার। প্রথমতঃ শেখ মুজিব দাবী করেন যে তাঁর মুক্তি বাহিনী এদের পরাস্ত করেছে। এদের তিনি যুদ্ধ অপরাধের জন্য বিচার করবেন। বলা হয়, এরা পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা অভিযান চালিয়ে বহু লোককে হত্যা করেছে। সুতরাং বিনা বিচারে এদের ছেড়ে দেওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। তিনি একটা ইনকোয়ারী কমিশনও গঠন করেন। পাক আর্মি কোথায় কি অঘটন ঘটিয়েছে সে সম্বন্ধে তদন্ত করে সাক্ষ্য প্রমাণসহ রিপোর্ট তৈরি করার ভার ছিলো এই কমিশনের উপর। কার্যতঃ ইন্ডিয়া যখন বিজেতা শক্তি হিসাবে যুদ্ধ বন্দীদের এদেশ থেকে সরিয়ে নেয় তখন বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি নেবার প্রয়োজনও সে বোধ করেনি। তবে শেখ মুজিবের অনুরোধে বাছাই করা ১৯৩ জন আর্মি অফিসারকে রেখে যাওয়া হয়। এরাই নাকি গণহত্যার নীল নকশার প্রস্তুতকারক। শেষ পর্যন্ত অবশ্য এরাও ইন্ডিয়াতে স্থানান্তরিত হয় কারণ তখন যুদ্ধ বন্দীদের বিচারের ব্যাপারটা ক্রমান্বয়ে চাপা পড়ে যায়। আসল কথা হচ্ছে যে আইনতঃ যুদ্ধ বন্দীদের উপর বাংলাদেশের কোনো কর্তৃত্ব ছিলো না। এরা ইন্ডিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল এবং জেনেভা কনভেনশন মোতাবেক মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এদের থাকবার কথা ইন্ডিয়ার দায়িত্বে। হয়েছিলোও তাই। কিন্তু প্রথম দিকে জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাসে এ ব্যাপার নিয়ে যে আসফালন শুরু হয়েছিলো সেটা একটা প্রহসন হিসাবে স্মরণীয় হয়ে আছে।

যুদ্ধাপরাধ তদন্ত কমিশনে বহু সরকারী অফিসার নিযুক্ত হন। বেশ কিছু টাকা পয়সাও ব্যয় করা হয়। তখন কথায় কথায় শুনতাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে জার্মানীর নুরেমবার্গে এবং জাপানের টোকিওতে যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার হয়েছিলো, সেই কথা। তবে এ প্রসঙ্গে এ কথাও স্মরণযোগ্য যে পৃথিবীর কোনো দেশেই বাংলাদেশের এ প্রস্তাবের সমর্থন পাওয়া যায়নি। ইন্ডিয়াও চুপ করেছিলো।

একই প্রকারের আসফালন শুরু হয় পাকিস্তানের অস্তিত্ব নিয়ে। শেখ মুজিব প্রশ্ন করেন, আমি কোন পাকিস্তানকে স্বীকৃতি দেবো, পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশকে? অর্থাৎ একাত্তরের বিপর্যয়ের পর পাকিস্তান বলে কিছু নেই। আছে কতগুলো খন্ড রাজ্য।

আরো মনে পড়ে যে শেখ-মুজিব যদ্দিন ১৬ই ডিসেম্বরের পর পাকিস্তানে বন্দী ছিলেন তদ্দিন প্রায়ই হুমকি দেওয়া হতো যে তাঁর মুক্তি বিলম্বিত হলে বাংলাদেশের দুর্ধর্ষ গেরিলা বাহিনীকে পশ্চিম পাকিস্তানেও পাঠানো হবে। এবং পূর্ব পাকিস্তান যেভাবে তাদের কবলিত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানকেও তারা সেভাবে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে।

বাঙালী গেরিলারা পশ্চিম পাকিস্তানে কিভাবে কাজ করবে সে কথা আমাদের মতো ব্যক্তির পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিলো না। আমরা জানতাম যে গেরিলাদের স্থানীয় ভাষা জানতে হয় এবং স্থানীয় অবস্থার সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে পরিচিত হতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সে যে সমস্ত গেরিলা তৎপর ছিলো তারা ছিল সব ফরাসী ভাষী। মাঝে মাঝে শুনতাম যে দু”একজন ইংরেজকে বিশেষভাবে তালিম দিয়ে প্যারাসুট যোগে ফ্রান্সের বিভিন্ন অঞ্চলে নামিয়ে দেওয়া হতো। একবার একটি মেয়ে কে এই কাজে ফ্রান্সে পাঠানো হয়। খবরে পড়েছি যে তাকে কয়েকদিন ধরে মদে গোসল করিয়ে তার গায়ের গন্ধ যেনো ফরাসী মেয়েদের মতোই হয় তার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। বলাবাহুল্য সে অনর্গল শুদ্ধ উচ্চারণে ফরাসী বলতে পারতো। বাঙালী গেরিলারা যারা উর্দু-পাঞ্জাবী-পশতু কিছুই জানতো না এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ভৌগোলিক পরিবেশ সম্পর্কে যারা ছিলো একেবারেই অজ্ঞ তাদের মুখে পশ্চিম পাকিস্তানে তৎপর হওয়ার হুমকি আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়েছে। তবে এটা বোধ হয় আমাদের এ অঞ্চলের লোকের স্বভাব। মিথ্যা গর্ব করা এবং অলীক স্বপ্ন নিয়ে মেতে থাকতে আমরা যতোটা ভালবাসি, ততোটা আর কিছুতে নয়।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে পূর্ব-পাকিস্তানের বিপর্যয়ের পর জেনারেল ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সরে দাঁড়ান। একাত্তর সালের পঁচিশে মার্চের আগে এবং তেহাত্তর সালের পর মিঃ ভুট্টোর ভূমিকা যতোই বিতর্কিত হোক না কেনো বাহাত্তর সালে তিনি পরাজিত জাতিকে একটা আশার বাণী শোনাতে পেরেছিলেন। আর্মি যদি তখনো ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকতো পশ্চিম পাকিস্তান হয়তো খন্ডবিখন্ড হয়ে যেতো।

১৬ই ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রথম স্বীকৃতি দান করে ইন্ডিয়া এবং তার পরই বৃটেন। বৃটেনের এই সিদ্ধান্তে পাকিস্তানীরা খুবই মর্মাহত হয়েছিলো। কারণ পাকিস্তান তখনো কমনওয়েলথ সদস্য। মিঃ ভুট্টো সঙ্গে সঙ্গে কমনওয়েলথ ত্যাগের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।

আমরা আশ্চর্য হলাম আরো যখন মুসলিম রাষ্ট্রদের মধ্যে মালয়েশিয়া প্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলো। আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কারণ আর কিছুই নয়, শুধু যে এই ত্বরিৎ সিদ্ধান্তের কথা মনে করলে এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তান কতটা বন্ধুহীন হয়ে পড়েছিলো।

আরো আশ্চর্যের কথা যখন পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধ চলছিলো এবং যেকোন মুহুর্তে ইন্ডিয়ার কাছে পাকিস্তান পরাজিত হবে এ সম্ভাবনা দেখা দেয় তখন ইরানের রেজা শাহ পাহলবী বেলুচিস্তানের অংশ বিশেষের উপর তাঁর দাবীর উল্লেখ করেন। অথচ ইরানের সঙ্গে পাকিস্তানের ছিলো গাঢ় সম্পর্ক। এ সব ঘটনায় এটাই প্রমাণিত হয় যে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চিরস্থায়ী শক্রতা কিংবা বন্ধুত্বের কোনো স্থান নেই। শক্রতা ও বন্ধুত্ব দু”টোই সাময়িক অবস্থার উপর নির্ভরশীল। দুটোরই অর্থ আপেক্ষিক।

দালাল আইন ও উগ্র জাতীয়তাবাদ

যদিও শেখ মুজিবের প্রত্যাবর্তনের আগে থেকেই বহু লোককে ধরপাকড় এবং হত্যা করা হয়, কলাবরেটর আইন পাস হয় সম্ভববতঃ ১০ ই জানুয়ারীর পর। কলাবরেটর শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসাবে দালাল শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই দালাল আইনের আওতা ছিলো এতো ব্যাপক যে শেখ মুজিবের বন্ধু-বান্ধবও ভীত হয়ে পড়েছিলেন। যাঁরাই সক্রিয়ভাবে গেরিলা তৎপরতায় শরীক হননি তারাই হয়ে উঠেন দালাল। আমার মনে আছে শেখ মুজিবের বন্ধু জহির উদ্দিন যিনি এককালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছিলেন, তিনি বেগম মুজিবের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। তাঁর অপরাধ ছিলো যে একেতো তিনি কলকাতার লোক; উর্দু ভাষী। দ্বিতীয়তঃ প্রত্যক্ষভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদের সমর্থন করেননি। দালাল আইনে হাজার হাজার ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা রজু করা হয়। আমি এক উকিলকে বলতে শুনেছি যে এ সব মামলার ফলাফল যাই হোক, এগুলো চালাতেই ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর লাগবে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য অনেক মামলা প্রত্যাহার করা হয় এবং ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রে হাই কোর্ট রায় দেয় যে দালাল আইনটি অসাংবিধানিক। এ সব মামলা চালাবার লোক পাওয়া যেতো না। উকিলরা ভয় পেতেন যে দালাল আইনে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তির পক্ষ সমর্থন করতে গেলে তারাও দালাল হয়ে পড়বেন। বাস্তবিক পক্ষে এরূপ ঘটনা বহু ঘটেছে।

দালাল আইনের ধারা নিয়ে আলোচনা করার স্বাধীনতা কারোর ছিলো না। ও সম্বন্ধে আইনের দিক থেকে কোনো আপত্তি উত্থাপন করা মাত্র আপত্তিকারীকে দালাল বলে চিহ্নিত করা হতো। ভয়ে এবং আতঙ্কে হাইকোর্ট বার এসোসিয়েশন থেকে শুরু করে মফস্বলের উকিলরা পর্যন্ত চুপ করে থাকতে বাধ্য হন। দু”একজন উৎসাহী মুজিববাদী উকিল দালাল আইনের পক্ষে জোরালো প্রচারণা চালান। তাদের সে সমস্ত উক্তি ছিলো যেমন যুক্তিহীন তেমনি ন্যক্কারজনক। এক উৎসাহী উকিল-যার নাম এখন আর আমার মনে নেই-দালাল আইনের সমর্থনে ছোটখাট একটা বইও প্রকাশ করেন। অবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের নীতি বোধ এবং বিবেকবুদ্ধি কিভাবে পরিবর্তিত হয়, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তার যতো উদাহরণ দেখা গিয়েছিলো ততো বোধ হয় সাম্প্রতিক ইতিহাসে আর কোথায়ও চোখে পড়বে না।

শেখ মুজিব দেশে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতির পিতা হিসাবে অভিনন্দিত হন। সঙ্গে সঙ্গে চাটুকারের দল তার স্ত্রী লুতফুন নেসাকে ”জাতির মাতা” বলে অভিহিক করতে আরম্ভ করে। এও ছিলো এক হাস্যকর ব্যাপার। এ কথা সত্য যে কোনো কোনো দেশে বিশেষ কারণে কোনো ব্যক্তিকে জাতির পিতা বলা হয়। কিন্তু এটা নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি কোথায়ও হয়নি। আমেরিকায় জর্জ ওয়াশিংটনকে কেউ কেউ মার্কিন জাতির পিতা বলে। কারণ যে যুদ্ধে বৃটেনকে পরাজিত করে আমেরিকান উপনিবেশগুলো স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে সেই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। তিনিই আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তেমনি উনিশ শতাব্দীতে যখন দক্ষিণ অঞ্চলগুলি দাসত্বের প্রশ্নে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তাদের বিরুদ্ধে উত্তর অঞ্চলে যে যুদ্ধ হয়, তার নেতৃত্ব দিয়ে ছিলেন আব্রাহাম লিংকন। গেটিসবার্গ রণক্ষেত্রে তিনি যে বক্তৃতা দেন সেটা শুধু আমেরিকার ইতিহাসেই নয়, পৃথিবীর স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও একটি স্মরণীয় দলিল। এই বক্তৃতায় তিনি Government of the people, by the people, for the people শব্দগুলি ব্যবহার করেন। লিংকন আততায়ীর গুলীতে নিহত হলে ওয়াল্ট হুইটম্যান তার কবিতায় তাকে মাই ফাদার বলে সম্বোধন করেন। ওয়াশিংটন এবং লিংকন দুজনকেই আমেরিকানরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। কিন্তু জাতির পিতা সমস্যা নিয়ে সে দেশে কোনো বিতর্ক নেই। তাছাড়া এটাও মনে রাখা দরকার যে গৃহযুদ্ধে জয়লাভ করে কোনো ব্যক্তি কোনো কালেই সমগ্র জাতির শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারে না।

শেখ মুজিবের চাটুকার দল এতোটা বাড়াবাড়ি করতে শুরু করে যে শুনেছি তারা নাকি প্রস্তাব দিয়েছিলো যে জার্মান এয়ার লাইন লুফথানসা নামের অনুকরণে বেগম মুজিবের নামানুসারে বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সের নাম লুতফুন নেসা এয়ার লাইনস করা হোক। তবে এ ব্যাপার নিয়ে সরকারী মহলে সত্যি কোনো আলোচনা হয়েছে বলে শুনিনি। কিনতু বেগম লুতফুন নেসাকে কোনো অনুষ্ঠানে দেখা গেলে জাতির মাতা ধ্বনি শোনা যেতো।

১৯৭২ সালের প্রথম ক”মাস উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদের যুগ। সব কিছুর মধ্যেই বাঙালীত্বের সন্ধান করা হতো। এমন কি ইংরেজী ভাষায়ও বাঙালীকে বেংগলী বলা চলবে না-এই দাবী উঠেছিলো। এটাও ছিলো এক হাস্যকর অভিনয়। বিদেশী ভাষায় কোন জাতি বা ভাষার নাম কি হবে সেটা ঐ ভাষাভাষী লোকেরাই স্থির করে। তাদের মুখে যে ধ্বনিটা সদূজভাবে আসে সেটা প্রচলিত হয়। ফরাসী ভাষায় ফরাসীর ফ্রাঁসে। ইংরেজীতে বলি ফ্রেঞ্চ, বাংলায় ফরাসী। উর্দুতে ফ্রানসিসি। অন্য ভাষায় কি বলে আমি জানি না। তবে যদি কোনো ফরাসী নেতা দাবী করে বসেন যে অন্য কোনো ভাষায় ফ্রাঁসে ছাড়া আর কিছু বলা চলবে না তখন অবস্থা কি দাঁড়াবে? জার্মানীকে জার্মানরা বলে ”ডয়েচল্যান্ড”। ফ্রান্সে বলে আলমাইন। আরবীতেও আলমাইন। এ নিয়ে জর্মোনীতে কোন কূটনৈতিক প্রতিবাদ করতে শুনিনি। ১৯৭০ সালে যখন চীনে যাই, ওদেশের লোকদের মুখে শুনলাম অদ্ভুত শব্দ। সেটা অনেকটা ব্যজিস্তানের মতো। কারণ পাকিস্তান শব্দটা ওরা পরিস্কারভাবে বলতে পারে না। মক্কায় দেখেছি তুরস্কের লোকেরা তককিরের সময় যে ধ্বনিটি উচ্চারণ করে সেটা আল্লাহ হুয়াচবার এর মতো শোনা যায়। আমি বহুবার চেষ্টা করে শুনবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু দেখেছি ওরা আকবার বলতে পারে না। এ তুর্কী ভাষারই কোন বৈশিষ্ট্য হবে।

বাঙলাকে বেংগলি বলা চলবে না বলে যারা চিৎকার করে তারা একবারও ভেবে দেখে না যে আমরা নিজেরা অন্য দেশের নাম কিভাবে বিকৃত করি। ইংরেজী কথাটা খাঁটি বাংলা। ইংল্যান্ডের ভাষার নামতো ইংরেজী নয়, ইংলিশ। ফরাসীরা বলে আংলে। কোন ইংরেজ সরকার যদি বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করেন অভিধান থেকে ইংরেজী শব্দটা তুলে দিতে আমরা বোধ হয় খুব অসুবিধায় পড়বো। তাছাড়া পৃথিবীতে, প্রায় হাজার চারেকের মতো ভাষা প্রচলিত। এগুলির মধ্যে স্বর ও ব্যঞ্জন ধ্বনিতে প্রচুর প্রভেদ বিদ্যমান। আরবীতে মহাপ্রাণ ধ্বনি নেই। খ চ ছ ট ঠ প ফ ড় ঢ় এর কোনটাই নেই। ওদেশের লোকদের মধ্যে পাকিস্তানকে ”বাকিস্তান” বলতে শুনেছি। ভুট্টোকে বলতো বুতু। ঐভাবেই তারা এসব নাম উচ্চারণ করতে পারে। তেমনি বাংলাদেশের আরবঅ নাম ”বানজলাদেশ”।

প্রেসিডেন্ট এরশাদের আমলে বানান সম্বন্ধে এ-রকমের হঠকারিতার এক ঘটনা ঘটে। তিনি একবার সৌদি আরব গিয়েছিলেন। সেখানে শোনেন যে সৌদিরা মক্কার ইংরেজী বানান Mecca বদলে Makkah করেছে। তার কারণ Mecca নামটা ইংরেজীতে একটা শব্দে পরিণত হয়েছে। ঘোড় দৌড়ের বাজির আড্ডাকে Mecca বলা হয়। সৌদীরা মনে করতে শুরু করে যে এতে মক্কা শহরের পবিত্রতা নষ্ট হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে বানান পাল্টে দেওয়া হল। এও মূর্খতা বই কি? এই পরিবর্তন দেখামাত্র এরশাদ সাহেব হুকুম করেন যে ঢাকার বানান হবে Dhaka। যেন জোর করে ইংরেজদের দিয়ে মহাপ্রাণ ধ্বনি ”ঢ” উচ্চারণ করানো যাবে। এই মূর্খতার বিরুদ্ধে  প্রতিবাদ করে আমি ”Arab News” পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেছিলাম। সরকারী কাগজপত্রে, গাড়ীর নেমপ্লেটে, দোকানের সাইনবোর্ডে বানান বদলাতে কয়েক কোটি টাকা খরচ হয়েছে। Dacca University-র পুরানো ছাত্রদের এখন Dhaka লিখতে হবে। এ দুটো যে একই বিশ্ববিদ্যালয় সেটা সাটিঁফিকেটে প্রমাণ করতে এখনও অসুবিধা হয়।

কিন্তু যাদের শুদ্ধ উচ্চারণ শেখানোর জন্য এই আয়োজন তারা তো ড্যাকাই বলছে। আমরা শুধু অনর্থক কতগুলি পয়সা নষ্ট করেছি। অপকর্মের পয়সা খরচের ব্যাপারে আমাদের জুড়ি নেই। এ রকম আরো অনেক ভাষায় উচ্চারণের তারতম্য আছেই। আফ্রিকায় ভাষাগুলির স্বর ও ব্যঞ্জনধ্বনি সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। অনুরূপভাবে দক্ষিণ আমেরিকার প্রাচীন ইনকাদের বংশধরদের মধ্যে বিভিন্ন ধ্বনি কিভাবে উচ্চারিত হয় তাও বলতে পারবো না। কিন্তু যে জন্য এতো কথার অবতারণা করলাম সে হলো এই উগ্র জাতীয়তাবাদের নামে বাংলাদেশে যে মূর্খতার প্রকাশ দেখেছি তাতে লজ্জাবোধ করেছি। যেনো আমরা ধমক দিয়ে পৃথিবীর সব অঞ্চলের উচ্চারণ সংশোধন করে ফেলতে পারবো। এ এক ধরনের পাগলামী, যে জন্য আমাদের প্রচুর খেসারত দিতে হচ্ছে। নিজেদের এতো স্পর্শকাতর করে তুলেছি যে এই নিয়ে মাথা ঘামিয়ে অন্য কিছু করার সময় আর থাকে না। কিন্তু মনে আছে ৭২ সালের প্রথম দিকে এ সব নিয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে দেশদ্রোহিতার দায়ে পড়তে হতো, দেশ প্রেমের একমাত্র সংজ্ঞা ছিলো বিনা প্রতিবাদে মুজিবপন্থী লোকদের ক্রিয়াকর্মের সমর্থন করা।

(বইটির pdf version download করুন এখানে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>