মুজিবপন্থী কোনো ব্যক্তি দুর্ঘটনায় মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে সে শহীদ হয়ে যেতো। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে এ রকমের শহীদের সংখ্যা যে কতো তা গণা যায় না। শহীদ কথাটার আসল তাৎপর্য এই যে ইসলামের জন্য যুদ্ধ করে কেউ যদি নিহত হয় তার মৃত্যূকেই শাহাদত বলা হয়। রসুলুল্লাহ (দঃ) এর জীবদ্দশায় কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধে বদর, ওহুদ প্রভৃতি স্থানে যাঁরা মারা যান তাঁদেরই, শরিয়ত মতে শহীদ বলা হয়। কিন্তু তখনো অন্য অবস্থায় কাফেরদের হাতে যাঁরা নিহত হন তাঁদের শহীদ বলার নিয়ম নেই। কাফেরদের অতর্কিত আক্রমণে মারা গেলেই শাহাদত হবে তার কোনো কথা নেই। শুধু যে ব্যক্তি প্রত্যক্ষভাবে ইসলাম বিরোধী শক্তির সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে মূত্যূবরণ করেন তিনিই শহীদ। পূর্ব পাকিস্তানে ”৭১ সালের আগেও দেখেছি সরকারের সঙ্গে সংঘর্ষে কারো মৃত্যূ হলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে শহীদ ঘোষণা করা হতো। ”৭১ সালে পাকিস্তান আর্মির হাতে যারা নিহত হলো তারা সবাই হয়ে গেছে শহীদ। অথচ এর মধ্যে ধর্মযুদ্ধের কোনো কথা নেই।

আমি এ কথা স্বীকার করি যে যেহেতু বাংলায় শহীদের কোন প্রতিশব্দ নেই, এ শব্দটা বাংলায় গৃহীত হয়েছে একটু ভিন্ন অর্থে। যে ব্যক্তি কোন আদর্শের জন্য প্রাণ দেয় তাকে শহীদ বলার একটা নিয়ম দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু যে ব্যাপক অর্থে এবং বিকৃত রূপে শব্দটা ৫২ সাল থেকে ব্যবহত হচ্ছে তার পরিণতি দাঁড়িয়েছে এই যে দল বিশেষের লোকের অপঘাতে মৃত্যূ হলেই কাগজেপত্রে তার শাহাদত প্রাপ্তির খবর ঘোষণা করা হয়। 

ডিসেম্বর-জানুয়ারীতে আরো একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়। সে হলো নাম বদলের পালা। যে সব রাস্তাঘাট প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে ইসলাম শব্দটা যুক্ত ছিল, সেখান থেকে ঐ শব্দটা তুলে দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে, পাকিস্তান আমলের বা তার আগের কোনো মুসলমান নেতার নামে কোন রাস্তাঘাট-শিক্ষা প্রকিষ্ঠানের নামকরণ হয়ে থাকলে সেখান থেকেও ওসব নাম অপসারিত হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল হলো সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, আর জিন্নাহ হলের নাম থেকে জিন্নাহর নাম সরিয়ে বসানো হলো সূর্যসেনের নাম। এ ছিলো এক ধরণের গোঁয়ার্তুমির অভিব্যক্তি। সার্জেন্ট জহুরুল হক ছিলেন একজন সাধারণ সৈনিক। পঁচিশে মার্চের আগে কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে বিদ্রোহ করতে যেয়ে গুলীতে মারা পড়েন। আগরতলা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। যখন আগরতলা ষড়যন্ত্রের কথা প্রথম প্রকাশ হয়ে পড়ে তখন আওয়ামী লীগ তারস্বরে চিৎকার করে বলতে শুরু করে যে এটা সরকারের সম্পূর্ণ বানোয়াট। একাত্তর সালের পর শেখ মুজিবসহ এ ষড়যন্ত্রের নায়কেরা স্বীকার করেছেন যে তারা সত্যই দেশের বিরুদ্ধে ইন্ডিয়ার সঙ্গে এক যোগসাজশে লিপ্ত হয়েছিলেন। সে একজনের নাম ইকবালের মতো বিশ্ববিখ্যাত কবি ও দার্শনিকের নামের পরিবর্তে একদল ছাত্রের জিদে গৃহীত হওয়ায় আমরা ব্যথিত এবং আশ্চর্যান্বিত হই। ইকবাল পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলেন এ কথা সত্য। কিন্তু তিনি ইন্তেকাল করেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ন”বছর আগে ১৯৩৮ সালে। ১৬ই ডিসেম্বরের পর পাকিস্তান বিরোধী তৎপরতা এমনভাবে বৃদ্ধি পায় যে পাকিস্তান এবং ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত ইতিহাসের চিহ্নটুকু মুছে ফেলবার প্রয়াসে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ মেতে উঠেন।

সূর্যসেনের নাম আরো আপত্তিজনক। তিনি ছিলেন সন্ত্রাসবাদী। চট্টগ্রামে অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সাথে জড়িত। হিন্দু ঐতিহাসিক এবং রাজনীতিকরা বর্তমানে অধিকাংশই স্বীকার করেন যে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পর যে সন্ত্রাসবাদের সূচনা হয় সেটা ছিলো একান্তভাবে একটা হিন্দু মৌলবাদী আন্দোলন। অরবিন্দ ঘোষ, বিপিন পাল যারা এই সন্ত্রাসবাদে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁরা জয় কালির নামে শপথ নিয়ে ইংরেজ হত্যার প্রতিজ্ঞা করতেন। তাঁদের মূলমন্ত্র ছিলো গীতার বাণী। এ সন্ত্রাসবাদীরা জানতেন যে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামক যে নতুন‌‌ প্রদেশটি গঠিত হয়েছিলো সেটা টিকে থাকলে পূর্ববঙ্গের মুসলমান সম্প্রদায় অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে উপকৃত হবে। কিন্তু এর ফলে হিন্দুজমিদার এবং বণিক শ্রেণীর স্বার্থে আঘাত লাগবে বলে তারা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাদের চাপের মুখে ১৯১১ সালে বৃটিশ সরকার মুসলমানদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাদের সিদ্ধান্ত পাল্টে নেন।‌ বাংলার দুই অংশ পুনর্মিলিত হয়। আবার শুরু হয় মুসলমান সম্প্রদায়ের ইতিহাসে আর এক শোষণের‌ যুগ। তখন থেকেই মুসলমানরা সংঘবদ্ধভাবে কংগ্রেসের সংশ্রব ছাড়তে শুরু করে। ১৯২৩ সালে কংগ্রেস নেতা সি আর দাস বুঝতে পেরেছিলেন যে বাংলার সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় মুসলমানের সমর্থন ও সহযোগিতা না পেলে স্বাধীনতা আন্দোলন সফল হবে না। তিনি বেঙ্গল প্যাক্ট নামক এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এটায় চাকরিতে এবং ব্যবস্থাপক সভায় মুসলমানদের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব দেবার প্রতিশ্রুতি ছিলো। কিন্তু সি আর দাসের মৃত্যূর পর তার অনূসারী সুভাষ বোস, শরৎবোস, বিধান রায় ঐ চুক্তি বাতিল ঘোষণা করেন। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এর পেছনে ছিলো সন্ত্রাসবাদীদের চাপ। বিশেষ করে সুভাষ বোস সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন। বিশের দশকে যে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সদস্য হিসাবে সূর্যসেন অস্ত্রাগার লূন্ঠন করতে যান সেটা ১৯০৫ সালের সন্ত্রাসী আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ের রূপ। অথচ ”৭২ সালে একদল ছাত্র তাকেই বাংলাদেশের জাতীয় বীরের মর্যাদায় স্থাপন করলো। এরা একবারও ভেবে দেখেনি যে, সূর্যসেন যে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন তার মধ্যে পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতার কোনো কথা ছিলো না। সন্ত্রাসবাদীরা মুসলমান সমাজকে সম্পূর্ণভাবে পাশ কাটিয়ে গীতার মন্ত্রে দীক্ষিত এক সমাজ এবং রাষ্ট্র কায়েম করতে চেয়েছিল।

ঐতিহ্য বর্জন


আমার আরো দুঃখ্য হলো যখন শুনলাম যে আমার পুরানো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের নাম বদলিয়ে নজরুল কলেজ রাখা হচ্ছে। (এ কথা উল্লেখযোগ্য যে কলেজটি পাকিস্তান আমলে ডিগ্রী কলেজে উন্নীত হলে এটাকে শুধু ইসলামিয়া কলেজ বলা হতো।) কিন্তু ইসলামের নাম এখন হয়ে পড়লো একান্তভাবে অপাংক্তেয়। যারা নজরুল ইসলামের নাম এ জায়গায় বসাতে গেলেন তারাও কবির নামের শেষ অংশটুকু বাদ দিলেন। কারণ তাতে ইসলাম শব্দটা এসে যায়। ফল দাঁড়িয়েছে এই যে এক উদ্ভট নাম এই ঐতিহাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর চাপানো হয়েছে। নজরুল বলে কোনো শব্দ আরবীতে নেই। নজরুল ইসলামের নজরুল নযর-উল-ইসলাম এর কি সংক্ষিপ্ত রূপ। এটা বাংলাদেশে প্রচলিত হয়েছে কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে এ শব্দটিকে একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করে আমরা চরম মূর্খতার পরিচয় দিয়েছি। তাছাড়া ইতিহাসের প্রতি এই অবজ্ঞা কেন? আওয়ামী লীগ মনে করতো যে ইসলামের নাম তুলে দিতে পারলেই তারা প্রমাণ করতে পারবে যে তারা সত্যিকারভাবে ধর্মনিরপেক্ষ। তাদের এ ধর্মনিরপেক্ষতার কপটতা ধরা পড়ে যখন দেখা যায় যে নটরডাম কলেজ, সেন্টগ্রেগরিজ স্কুল, হোলি ফ্যামিলি হসপিটাল, হোলি ফ্যামিলি কলেজ, রামকৃষ্ণ মিশন এ সবের নাম স্পর্শ করা হয়নি। লক্ষ্মীবাজারের কায়েদে আজম কলেজের নাম বদলে হলো সোহরাওয়ার্দী কলেজ। গভর্নর মোনেম খান প্রতিষ্ঠিত জিন্নাহ কলেজের নাম হলো তীতুমীর কলেজ। নতুন ঢাকার প্রধান সড়কের নাম ছিলো জিন্নাহ এভিনিউ তখন থেকে এটাকে সরকারীভাবে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ বলা হয়।

দেশের অন্যত্র এ রকম আরো পরিবর্তন ঘটে। রাজশাহী ইউনিভার্সিটির জিন্নাহ হলের নাম পরিবর্তিত হয়েছে ফজলুল হক হলে। উদাহরণ  বাড়িয়ে লাভ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে যে এভাবে ইতিহাসকে কি অস্বীকার করা যায়? অক্সফোর্ড কেমব্রিজ সাত-আটশ” বছরের পুরানো নাম এখনো সবাই ব্যবহার করে। অথচ ইংল্যন্ডের ধমীঁয় এবং রাজনৈতিক পরিবেশ একেবারে বদলে গেছে। সেন্ট জন্স কলেজ, সেন্ট ক্যাথরিন্স কলেজ প্রভৃতি নামে কেউ কখনো আপত্তি করে বলে শুনিনি। যদিও আধুনিক কালের ছাত্র-ছাত্রীরা বা শিক্ষকবৃন্দ খৃষ্টান ধর্মের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা পোষণ করেন না। কিন্তু ইতিহাস তো আলাদা জিনিস। নতুন বাংলাদেশের নেতাদের কার্যকলাপে মনে হচ্ছিলো যে পুরানো ইতিহাসের প্রয়োজন একেবারেই ফুরিয়ে গেছে। ১৬ই ডিসেম্বর থেকে যেনো আমরা জন্ম নিলাম। এর ফলে তখন থেকে যে স্ববিরোধিতা আমাদের আচরণে ধরা পড়ছে তার অবসান বিশ বছর পরও হয়নি। সমাজে এবং দেশে পরিবর্তন নিরন্তর ঘটে। কিন্তু ইতিহাসের ধারা নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবাহিত হতে থাকে। সমস্ত পরিবর্তনের সামগ্রিক রূপ নিয়ে একটা জাতির পরিচয়। ফ্রান্সে এককালে রাজতন্ত্র ছিল। ফরাসী বিপ্লবের পরও আবার কিছুকাল ঐ রাজতন্ত্র ফিরে এসেছিলো। বর্তমানে ফ্রান্সে গণতন্ত্র। কিন্তু তাই বলে সম্রাট নেপোলিয়ান বা রাজা ষষ্ঠদশ লুই এঁদের নাম তো ইতিহাস থেকে  মুছে ফেলা সম্ভব নয় এবং সে চেষ্টাও কেউ করে না। বাংলাদেশে ইন্ডিয়ার সাহায্যে যে দল ক্ষমতায় আসীন হলো তারা মনে করতো যে কলমের খোঁচায় ডিক্রি জারী করে জাতির ইতিহাসই তারা পাল্টে দেবে।

শুধু ইসলামের সাথেই সম্পর্ক ছেদ হলো না, আরবী-ফার্সি যে দু”টি ভাষার সঙ্গে আমাদের কালচার নিবিড়ভাবে যুক্ত তাকেও পাশ কাটিয়ে এক নতুন সংস্কৃতি সৃষ্টি করার চেষ্টায় নতুন শাসকরা মেতে উঠলেন। আরবী ফার্সির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কোন মন্তব্য করলেন না বটে কিন্তু কার্যত ঐ ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়ে নতুন পথে তাদের যাত্রা শুরু হলো। বাংলাদেশ সরকার যে সব নতুন পদবী সৃষ্টি করলো তার মধ্যে এর প্রমাণ ছিলো। গৃহযুদ্ধে যে সব সৈন্য সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলো তাঁরা কেউ হলেন বীরোত্তম কেউ বীরশ্রেষ্ঠ ইত্যাদি। বৃটিশ আমলেও মুসলমানদের উপাধিতে ফার্সি আরবীর পরিচয় থাকতো। তখনকার মুসলিম উপাধি ছিলো খান সাহেব, খান বাহাদুর, নবাব, শামসুল ওলামা প্রভৃতি। হিন্দুরা পেতেন রায় সাহেব, রায় বাহাদুর, রাজা, মহামযোপাধ্যায় এরকম পদবী। এখন হিন্দু-মুসলিম প্রভেদ ঘুচে গেলো। মজার কথা এই যে ইন্ডিয়াতে ৪৭ সালের পর যে সমস্ত পদবী সৃষ্টি হয়েছিলো সেগুলি যেমন ছিলো সংস্কৃত ভিত্তিক যথা ভারত ভূষণ, ভারত রত্ন। বাংলাদেশে নতুন পদবীতে তার এক প্রতিধ্বনি ছিলো। যেনো আমরা সংস্কৃতিতে ইন্ডিয়ারই এক ক্ষুদ্র সংস্করণ।

একাত্তরের মার্চ মাসে ছাত্ররা শেখ মুজিবুর রহমানকে যে উপাধি দেয় সেই বঙ্গবন্ধু কথাটাও চিত্তরঞ্জন দাসের ”দেশবন্ধু” উপাধির অনুকরণ। পাকিস্তান আমলে যে সমস্ত পদবী প্রচলিত ছিলো সেগুলো একেবারেই পরিত্যক্ত হলো। তখনকার পদবীর মধ্যে সুপরিচিত ছিলো তমগায়ে খিদমত, তমগায়ে কায়েদে আজম, সিতারায়ে ইমতিয়াজ, হিলালে পাকিস্তান, নিশানে পাকিস্তান ইত্যাদি। নতুন পরিবেশে এ সমস্ত পদবী চলতো না সে কথা স্বীকার করি। কিন্তু পূর্বের সংস্কৃতির সঙ্গে সমস্ত সংশ্রব বাদ দিয়ে সংস্কৃতিতে সংস্কৃত ভাষাকে বালাদেশের কালচারের ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করার মধ্যে যে ইঙ্গিত ছিলো তার অর্থ স্পষ্ট। ভাবখানা এই যে যেহেতু রাজনৈতিক বিরোধের কারণে বাংলাদেশী সমাজ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সুতরাং ইসলাম ধর্ম, উর্দু-ফার্সি-আরবী ভাষা এ সমস্তই পরিত্যাজ্য। এগুলো যেনো একচেটিয়াভাবে পাঞ্জাবীদের সম্পত্তি। কালচারের ক্ষেত্রে এটা ছিলো এক চরম দেউলিয়াপনার পরিচয়। আমার মনে আছে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন নাৎসীদের বিরুদ্ধে বৃটেন লড়াই করে যাচ্ছে তখন জার্মানীতে শেক্সপিয়ারের রচনাবলী নিয়ে গবেষণা চলতো। একদল জার্মান পন্ডিত এমন দাবীও করেছিলেন যে, ষোড়শ শতাব্দীর কবি নাট্যকার শেক্সপিয়ারের যথার্থ উত্তরাধিকারী জার্মানরা, হীনবল বৃটিশদের শেক্সপিয়ারের উপর কোনো অধিকার নেই। তেমনি হিটলারের সহযোগী মুসোলিনী যে দেশে রাজত্ব করতেন সেই ইটালিতেই ল্যাটিন ভাষা এবং সাহিত্যের উদ্ভব হয়। মধ্যযুগের বিখ্যাত সাহিত্যিক দান্তে, বোকাচো, পেত্রার্ক, কাবালকান্তি এঁরা সব ইটালির লোক। কিন্তু মুসোলিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামকে কেউ ল্যাটিন কবি ভার্জিল, হরেস, ঐতিহাসিক লিভি বা দান্তে প্রমুখ সাহিত্যিকের বিকদ্ধে সংগ্রাম মনে করেনি। জার্মানীর স্যেটে, শিলার, হাইনে প্রভৃতির সাহিত্য বর্জন করার কথা ওঠেনি। এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সস্পর্ক ছিলো না এবং এখনো নেই। কবি হোমার জম্মেছিলেন গ্রীসে প্রায় তিন হাজার বছর আগে। তাঁর অমর মহাকাব্য ইলিয়ড এবং ওডিসি ইউরোপের সর্বত্রই পঠিত হয়। ইউরোপীয় সভ্যতার মূলমন্ত্রই এর মধ্যে নিহিত। কোনো যুগেই ইউরোপের কোনো দেশে গ্রীক সংস্কৃতির ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দাবি কেউ উঠায়নি।

মধ্যযুগে সভ্য ইউরোপে সাধারণ ভাষা ছিলো ল্যাটিন। যেমন মুসলমান আমলে ভারতের সর্বত্র ফার্সির চর্চা হতো। বাংলার মাটিতেও অনেকেই ফার্সিতে কবিতা লিখেছেন, ইতিহাস রচনা করেছেন। ইউরোপে যেমন মধ্যযুগের শেষদিকে আঞ্চলিক ভাষাগুলো উন্নতি লাভ করে বিভিন্ন দেশে নতুন সাহিত্যের জন্ম দেয়; ভারতেও আঞ্চলিক ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তার সঙ্গে ফার্সির কোন বিরোধ ঘটেনি। যেমন ঘটেনি ল্যাটিনের সঙ্গে কোনো আঞ্চলিক ইউরোপীয় ভাষার। আঠারো শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত ইউরোপের শিক্ষিত সমাজ পরস্পরের মধ্যে ল্যাটিন- এ ভাব বিনিময় করতে পারতো। এ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে যখন ডঃ জনসন ফ্রান্সে বেড়াতে যান, তিনি ল্যাটিন-এ কথা বার্তা বলেছেন। ফরাসী তিনি জানতেন কিন্তু ভয় পেতেন যে তাঁর ফরাসী উচ্চারণ হয়তো শুদ্ধ হবে না। ল্যাটিন-এর এ ঐতিহ্য ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো বর্তমান। অক্সফোর্ড-ক্যামব্রিজ সমাবর্তন সভায় প্রধান বক্তৃতা হয় ল্যাটিন-এ। পূর্ব ইউরোপেও এর ব্যতিক্রম নেই। ১৯৭৭ সালে পোলান্ডে পজনান শহরে এক সম্মেলনে যোগ দিয়ে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেটা ভুলবার নয়। সেখানকার ইউনিভার্সিটিতে এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে দেখলাম বক্তৃতা হলো চার ভাষায়। প্রথমে ল্যাটিন-এ পরে ফরাসীতে তারপর ইংরেজীতে এবং শেষে পোলিশ ভাষায়। ৭৭ সালের পোলান্ড ছিলো কমিউনিস্ট শাসিত। কিন্তু আশ্চর্য হলাম যে, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তারা প্রাচীন ঐতিহ্য ত্যাগ করার চেষ্টা করেনি। অথচ বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার নাম দিয়ে নতুন সরকার ঢাকা এবং রাজশাহী ইউনিভার্সিটির মনোগ্রামে যে কোরআন শরীফের আয়াত ছিলো সেগুলি তুলে দেয়।¨  এসব কারণে মনে করার যথেষ্ট হেতু ছিলো যে একাত্তর সালের শেষে যে দল ক্ষমতা অধিকার করে তারা চেয়েছিলো দেশের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এমন একটি পরিবর্তন ঘটাতে যাতে এর আসল পরিচয় চিরদিনের জন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কখনো কখনো মনে হতো যে পনেরো শতাব্দীতে সুলতানী আমলে রাজা গণেশ বলে একব্যক্তি যেমন সুলতান পরিবারের দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে কিছুকালের জন্য ক্ষমতা দখল করে বসে এ যেনো সে রকম একটা ব্যাপার। রাজা গণেশ সিংহাসন দখল করেই মুসলমান নিশ্চিহ্ন করতে শুরু করে। তখন নূর কুতবে আলম নামক এক বিখ্যাত আলেম সমাজকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে যে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে রাজা গণেশকে তার কাছে নতি স্বীকার করতে হয়। ইতিহাসের এমনই পরিহাস যে এই রাজা গণেশেরই পুত্র যদু ইসলাম গ্রহণ করে সুলতান জালাল উদ্দিন নামে ইতিহাসে খ্যাত। বাংলাদেশের ইতিহাসে ভবিষ্যতে কি ঘটবে ৭২ সালের শুরুতে তা আমরা কেউ বলতে পারছিলাম না। কিন্তু আমাদের জীবনে যে একটা বিরাট দুর্যোগ নেমে এসেছে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ ছিল না। ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান হয় তখন রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক মতামতের জন্য কাউকে কোনো শাস্তি প্রদান করার কথা আমরা ভাবিনি। কংগ্রেসের হিন্দুরা তো ছিলোই, মুসলমানদের মধ্যে বহু লোক পাকিস্তানের বিরোধিতা করেছিলো। কুমিল্লার আশরাফ আলী চৌধুরীর নাম আমি আগে উল্লেখ করেছি। এ রকম আরো অনেক ব্যক্তি ছিলেন যারা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান সংগ্রামের বিপক্ষে কাজ করেছেন। জনাব এ কে ফজলুল হক পর্যন্ত ৪৬ সালের ইলেকশনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তার কৃষক প্রজা পার্টির সদস্যরা। কিন্তু এদের কাউকে ৪৭ সালের ১৪ই আগষ্টের পর জেলে যেতে হয়নি বা কারো প্রাণহানি ঘটেনি। সরকারী চাকরি থেকে পাকিস্তান বিরোধিতার জন্য কাউকে চাকরিচ্যূত করা হয়নি। বরঞ্চ তখন কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে নতুন দেশ গড়ার কাজে সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। গণপরিষদে তাঁর প্রথম বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন যে, স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর রাজনীতিতে ধর্মীয় ভেদাভেদের চিহ্ন আর থাকবে না, সবারই সমান অধিকার থাকবে নাগরিক হিসাবে। যদি বলা হয় যে ৪৭ এবং ৭১ সালের মধ্যে প্রধান তফাৎ এই যে ৪৭ সালে গৃহযুদ্ধের মতো কোনো কিছু ঘটেনি, সে যুক্তিও হবে অচল। কারণ বাস্তবিক পক্ষে ১৯৪৬ সাল থেকে কোলকাতা, বিহার, পূর্ব পাঞ্জাবে যে দাঙ্গা হয় সেটা ছিল একাত্তর সালের ঘটনার চেয়েও ভয়াবহ। বিহার থেকে কয়েক লক্ষ মুসলমান এসে পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিলো। অন্যদিকে পূর্ব এবং পশ্চিম পাঞ্জাবে প্রায় চার-পাঁচ কোটি লোক এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে হিজরত করতে বাধ্য হয়। এদের মধ্যে কত লোক মারা গেছে তার হিসাব কেউ জানে না। ৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট কোলকাতায় যে দাঙ্গা হয় তখন আমি নিজে সেখানে ছিলাম। চারদিনের দাঙ্গায় হাজার চারেক লোক নিহত হয়েছিলো বলে শুনেছি। হঠাৎ কোলকাতার মতো শহর মুসলিম এলাকা এবং হিন্দু এলাকায় বিভক্ত হয়ে যায়। এটাকে যদি গৃহযুদ্ধ না বলি তবে কাকে গৃহযুদ্ধ বলবো? তখন মুসলমানের মনে হিন্দুদের বিরুদ্ধে যে তীব্র ক্ষোভ ও হিংসার সৃষ্টি হয়েছিল তেমনি হিন্দুরাও মুসলমানের প্রতি চরম বৈরিতার মনোভাব পোষণ করতো। কিন্তু এতদসত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের সরকার কোনো হিন্দু কর্মচারীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেনি। যারা চলে গেলো তারা গিয়েছিল অপশন দিয়ে সেচ্ছায়। হিন্দুরা বহু সম্পত্তি পূর্ব পাকিস্তানে ফেলে যায়। এ সমস্ত পরিত্যক্ত বাড়ীঘর, জায়গা-জমি সরকারের কর্তৃত্বে রাখা হয়। মুসলিম লীগের লোকেরা এগুলি বেআইনীভাবে দখল করেছে বলে শোনা যায়নি। গ্রামের দূরাঞ্চলে এ রকমের দু”একটা ঘটনা হতে পারে কিন্তু এ কথা মনে রাখা দরকার যে, পাকিস্তান ও ভারত সরকার উভয়ই পরিত্যক্ত সম্পত্তি সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ঢাকার আদূরে নারায়ণগঞ্জে যে তিনটি কাপড়ের মিল ছিলো সেগুলো কোনো মুসলমান এসে দখল করেনি। হিন্দু জমিদারদের বাড়ীঘরও কোনো মুসলিম নেতা ভোগদখল করার সুযোগ পায়নি। অথচ ৭২ সালে ধানমন্ডি মোহাম্মদপুর এলাকার বহু বাড়ীঘরের মালিক হয়ে বসলেন মুক্তিযোদ্ধারা। দেশের আইনের কাঠামো নতুন সরকারের প্ররোচণায় যেভাবে ভেঙ্গে পড়লো তার নজির সাম্প্রতিক ইতিহাসে ছিলো না। এই যে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হলো এর জের বহুদিন চলবে এ সম্বন্ধে আমার মনে কোনো সন্দেহ ছিলো না। সাধারণ লোকে মুজিববাদী সমাজতন্ত্রের অর্থ করেছিলো এই যে এখন আর সমাজের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে কোনো ভেদাভেদই চলবে না। শিক্ষিত-অশিক্ষিতের প্রভেদ উঠে যাবে। মেধার কোনো কথা উঠবে না। যার যা দাবী সমাজকে তাই গ্রহণ করতে হবে। আমি হাসপাতালে বসে শুনতাম যে ভদ্রঘরের মেয়েরা সহজে ঘরের বাইরে বের হতে ভয় পেতো কখন কে তাদের হাত ধরে টান দেবে। দেশ ফেরত মুক্তিযোদ্ধারা পছন্দ মতো মেয়েদের জোর করে বিয়ে করতে শুরু করে। বাপ-মা ভয়ে কথা বলতে সাহস পেতো না। বাঁধা দিতে গেলে-সমস্ত পরিবারকে প্রাণ দিতে হতো। বিহারী মেয়েদের কথাই ছিলো না। তারা ছিলো লুটের মালের মতো। যদৃচ্ছা তাদের ব্যবহার করা হয়েছে। এ রকম বহু করুণ ইতিহাস আমি ব্যক্তিগতভাবে শুনেছি। জানুয়ারীর ১৫ তারিখের দিক থেকে আমি লাঠি ভর করে একটু একটু করে হাঁটবার চেষ্টা করি। সঙ্গে লোক রাখতে হতো। না হলে হঠাৎ করে পড়ে যেতাম। শরীরের উপর দিকের অবশ ভাবটা একটু হ্রাস পেয়েছিলো কিন্তু পা দু”টি ছিলো প্রায় অকেজো। পায়ের তলায় অনবরত এক ধরনের যন্ত্রণা অনুভব করতাম। যার ফলে মাটিতে পা রাখতে অসুবিধা হতো। আগেই বলেছি যে বিছানায় এপাশ ওপাশ হতে পারতাম না। আর একটু পরে যখন একটু একটু করে কারো সাহায্য ছাড়াই লাঠি ভর দিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করেছি তখনই শুনলাম যে আমাকে হয়তো জেলে যেতে হবে। ৩০শে জানুয়ারী সকাল বেলার রাউন্ডে যে ডাক্তার এসেছিলেন তিনি বললেন, আমার সঙ্গে একটু কথাআছে। কামড়া থেকে অন্য লোককে সরিয়ে দিতে বললেন। তারপর জানালেন যে, অর্ডার এসেছে আগামীকাল আমাকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে পাঠানো হবে। আমি বললাম, আমার অবস্থা দেখতে পাচ্ছেন। আমি এখনো ভালো করে দাঁড়াতে পারি না। আরো ১৫ দিন যদি হাসপাতালে রাখেন পায়ের শক্তি হয় তো কিছুটা বাড়বে। ডাক্তার বললেন, উপরের হুকুম। তিনি কিছুই করতে পারবেন না। আমি তার সঙ্গে আর তর্ক করলাম না। বাসায় খবর দিলাম ওরা যেনো চেক বই নিয়ে অবশ্যই সেদিন বিকেলে আমার সঙ্গে দেখা করে। বিকেলে যখন ওদের বললাম যে কাল সকালে আমাকে জেলে যেতে হবে, মেয়েরা কেঁদে ফেললো। কিন্তু করণীয় কিছুই ছিলো না। আমি চেকগুলিতে সই করে দিলাম। বললাম একটু বেশী করে টাকা উঠিয়ে রাখতে। হঠাৎ যদি সরকার আমার ব্যাংক একাউন্ট ফ্রিজ করে তা হলে যেনো অসুবিধায় না পড়তে হয় । সেদিন রাত্রে আমার একেবারেই ঘুম হয়নি। জীবনে যা ভাবতে পারিনি তাই ঘটতে যাচ্ছিলো। আমরা যারা এককালে পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করেছিলাম এই বিশ্বাসে যে দেশ ও সমাজকে এভাবে শোষণের দায় থেকে মুক্ত করতে পারবো, তারাই হয়ে গেলাম ঘৃণ্য অপরাধী। আমার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ ছলো তা আমাকে জানানো হয়নি। কোন পরোওয়ানাও দেখানো হয়নি। পরোওয়ানা দেখবার কথা বলতেও রুচি হয়নি। কারণ জানতাম যে জিজ্ঞাসা করে কোনো লাভ হবে না তাই সারা রাত ধরে মনে মনে কারাবাসের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলাম। ৩১ তারিখে সকাল ১০টার দিকে একজন পুলিশ অফিসার এসে বললেন তিনি আমাকে নিতে এসেছেন। আমি তৈরিই ছিলাম। কাপড়ের ছোট একটা সুটকেস নিয়ে লাঠি ভর করে তার সঙ্গে নীচে গেলাম। শুধু অফিসারকে অনুরোধ করলাম যে যেহেতু জেলখানা যেতে আমার বাসায় সামনে দিয়েই যেতে হবে, তার জিপটা যেনো এক মিনিটের জন্য বাসার গেইটে দঁড়ায়। অফিসার আমার এ অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন।বিশে ডিসেম্বর থেকে একত্রিশে জানুয়ারী সকাল পর্যন্ত মোট বিয়াল্লিশ দিন হাসপাতালে ছিলাম। আগে বলেছি যে প্রথম সাতদিন ইন্ডিয়ান আর্মির জওয়ানরা আমাকে পাহারা দিতো তখন কোনো বাইরের লোককে আমার অনুমতি ছাড়া ক্যাবিনে আসতে দেওয়া হতো না। অনেকটা নিরাপদ বোধ করতাম। সাত দিন পর যখন বাংলাদেশ পুলিশ পাহারার ভার গ্রহণ করে তখন আর নিরাপত্তা রইলো না। হঠাৎ করে যে কোনো ব্যক্তি কামরায় এসে ঢুকতো। পুলিশকে বললেও কিছু হয়নি। অনেক সময় শুনতাম পুলিশের লোক চা খেতে বা অন্য কোনো কাজে কোথাও চলে গেছে আমাকে না জানিয়েই। হাসপাতালের প্রশাসনিক দূরাবস্থা দেখে মাঝে মাঝে মন খুব খারাপ হয়ে যেতো। ভি আই পি রুমে যদি আমার এ অবস্থা হয় তবে সাধারণ রোগীদের ভাগ্যে কি ঘটছে অনুমান করতে পারতাম। পীড়াপীড়ি না করলে সাতদিনেও বিছানার চাদর পাল্টিয়ে দেওয়া হতো না। আর যে চাদর পেতাম তাও ভালো করে ধোয়া নয়। খাবার ব্যবস্থা ছিলো অতি নিকৃষ্ট। মাঝে মাঝে তরকারীতে মাছি, পোকা পাওয়া যেতো। খেতে পারতাম না। শেষ পর্যন্ত বাসা থেকে খাবার আনিয়ে খেয়েছি। তবে এ কথা স্বীকার করবো যে ডাক্তার সাহেবদের কাছে কোনো দুর্ব্যবহার পাইনি। আমি মুজিব বিরোধী ছিলাম বলে আমার প্রতি কেউ অবজ্ঞা দেখাননি। রাউন্ডে রোজই তারা আমার ক্যাবিনে আসতেন এবং ঔষধপত্রের জন্য আমাকে কোন পয়সা দিতে হয়নি। গ্রেফতারকৃত রোগী ছিলাম বলে ক্যাবিনের ভাড়াও আমার কাছ থেকে আদায় করা হয়নি। নিরাপত্তা নিয়েই নানা আশংকা বোধ করেছি। যেরূপ অরক্ষিত অবস্থায় ছিলাম হঠাৎ কোনো দুষ্কৃতকারী এসে আমাকে খুন করে ফেললেও আশ্চর্য হওয়ার কারণ থাকতো না। আমি মৃত্যূর জন্য প্রস্তুত ছিলাম। সেজন্য এ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাইনি।

জেলে প্রবেশ

১৯৭২ সালের একত্রিশে জানুয়ারী যখন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ফটক দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম মনে হলো এবার সত্যিকারভাবে বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে আমার সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। জেল আমাদের বাসার কাছে হলেও জেলের অভ্যন্তর ভাগ কেমন সে অভিজ্ঞতা ছিলো না। আমাকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় টেবিলে। এখানে এক জেল কর্মচারী আমার নাম পরিচয় ঠিকানা লিখে নিলেন। আমার সঙ্গে জিনিসপত্র কি আছে তা বলতে হলো। ঔষধপত্র সবই ওরা রেখে দিলো। বলা হলো যে, যে ঔষধের দরকার হবে জেল থেকেই তা সাপ্লাই করা হবে, কয়েদীর নিজের কাছে ঔষধ রাখবার অধিকার নেই। সেইফটি রেজারের সমস্ত ব্লেডও রেখে দিতে হবে। এটাও রাখার নিয়ম নেই। পরে শুনেছি ব্লেড, ছুরি, কাঁচি, দা এমন কি রশি পর্যন্ত কোনো কয়েদীকে রাখতে দেওয়া হয় না। থিওরি হচ্ছে যে জেলের অস্বাভাবিক পরিবেশে অনেকে আত্মহত্যার কথা ভাবে এবং এসব জিনিস পেলে তা দিয়ে নিজের প্রাণনাশের চেষ্টা করে। কথাটা যে অমূলক নয় বুঝতে দেরী হয়নি। আমাকে নিয়ে আসা হলো সাত সেলে। এখানে সাতটা সেল আছে বলে সাধারণভাবে পাহারাদাররা একে সাত সেল বলে। চারদিকে দেওয়াল দেওয়া একদিকে ঐ এলাকায় ঢোকার একটা দরজা। দেখলাম সারা জেল অনেকগুলি ছোট অংশে বিভক্ত। ওখানে যে সমস্ত কয়েদীকে রাখা হয় তাদের পক্ষে অন্য কোন কয়েদীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের কোনো সুযোগ নেই। সাত সেল- এ যাদের রাখা হয় তারা প্রথম শ্রেণীর কয়েদী। সাধারণ কয়েদীরা যে অঞ্চলে থাকে তাকে বলা হয় খাতা। সেখানে এক কামরায় ৪০-৫০ জন করে লোক ঠাসাঠাসি করে-শোয়। তাদের প্রত্যেককে দেওয়া হয় দু”টো কম্বল-একটা বিছাবার একটা গায়ে দেবার। বালিশের কোন ব্যবস্থা নেই। বলাবাহুল্য এ সমস্ত তথ্য পরে জানতে পেরেছি।আমাকে ”সাত সেলে” -নিয়ে এলেও প্রথম সাত দিন সাধারণ কয়েদীদের মতো দু”টো কম্বল নিয়ে মেঝেতে শুতে হয়েছে। আর খাবারও খেতে হয়েছে সাধারণ কয়েদীর, তবে সেলে যাদের পেয়েছিলাম তারা আমাকে সাহায্য করায় অসুবিধা যতোটা হওয়ার কথা ছিলো ততোটা হয়নি। সাত সেলে পেলাম ডক্টর দীন মোহম্মদ ও ডক্টর মোহর আলীকে। ওঁরা প্রথম থেকেই প্রথম শ্রেণীর কয়েদীর মর্যাদা ভোগ করছিলেন। সন্ধ্যা হওয়ার একটু আগে দীন মোহম্মদ চুপ করে একটা বালিশ দিয়ে গেলেন। ওটা উনি বাসা থেকে আনিয়েছিলেন। ওঁদের জন্য যে খাবার আসতো তার অংশ আমাকে দিতেন। সাধারণ কয়েদীর খাবার যে কতোটা নিম্নমানের তা বুঝিয়ে বলা অসম্ভব। সকাল বেলা এক ধরণের জাউ পেতাম। সেটা যেমন বিস্বাদ তেমনি তা দেখলেও মন বিষিয়ে উঠতো। দুপুর বেলা মোটা ভাতের সঙ্গে মাছ বা গোশতের একটা সালুন দেওয়ার কথা। কিন্তু মাছ বা গোশতের সন্ধান পাওয়া যেতো না। কোথাও কোন কাঁটা বা হাড়- এ রকম কিছু চোখে পড়লে বুঝা যেতো এটা মাছের বা গোশতের তরকারী। অথচ শুনেছি জেলের নিয়মাবলীর মধ্যে সবশ্রেণীর কয়েদীর যে খাদ্য তালিকা নির্দিষ্ট তাতে আমাদের দেশের মান অনুযায়ী কয়েদীর ভালো খাবারই পাবার কথা। কিন্তু ওসব কিতাবী নিয়ম কোন জেলেই নাকি অনুসরণ করা হয়না।  সবচেয়ে শক পেলাম টয়লেটের অবস্থা দেখে। ”সাত সেলে”র জন্য এক লাইনে পাঁচটা টয়লেট ছিলো। সামনে একটা দেয়াল। কিন্তু টয়লেটগুলোর মধ্যে কোন দরজা বা পর্দা নেই। একজনের সামনে দিয়েই আর এক ব্যক্তিকে অন্য পায়খানায় ঢুকতে হতো। ময়লা পরিস্কার করতো সশ্রম কারাদন্ডপ্রাপ্ত কয়েদীরা।  ”সাত সেলে” আর যাঁরা ছিলেন তাঁরা হচ্ছেন ফরিদপুরের ওয়াহিদুজ্জামান সাহেবের ভাই ফাইকুজ্জামান। পা  ভাঙ্গা খোঁড়া লোক। তাঁর অপরাধ তিনি ওয়াহিদুজ্জামানের ভাই। ফরিদপুরের আর এক ভদ্রলোক ছিলেন, তাঁর নাম ভুলে গেছি। আর দু”জনের মধ্যে একজন হচ্ছেন রাজশাহীর আয়েনউদ্দিন আর এক পুলিশ ইন্সপেক্টর শামসুদ্দীন। আয়েনউদ্দিন সাহেবকে আগে থেকেই চিনতাম। তাঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় রাজশাহীতে। মুসলিম লীগ পার্লামেন্ট পার্টি মেম্বর হিসাবে তিনি ইউনিভার্সিটি সিন্ডিকেটের সদস্য ছিলেন। দেখলাম আমাদের সাতজনের কাজ কর্ম করার জন্য একজন ”ফালতু” মোতায়েন করা আছে। সেও নিম্নশ্রেণীর এক কয়েদী। দালাল আইনে গ্রেফতার হয়েছিলো। অশিক্ষিত গ্রাম্য লোক। তার অপরাধ কি তা-ও তাকে বলা হয় না। তার পরিবারের কথা মনে করে সে প্রায়ই কান্নাকাটি করতো।

(বইটির pdf version download করুন এখানে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>