অধ্যায় ১২: টেন সেলের ঘটনা
এ সময় কলাবরেটর কেসে আত্মরক্ষার জন্য অনেকে উকিলের পরামর্শে একটা শব্দ ব্যবহার করতেন। সেটা হলো DURESS অর্থাৎ চাপ। সবাই বলেছেন যে পাকিস্তান আর্মির চাপে তাদের অনেক কিছুই করতে হয়েছে যা হয়তো স্বেচ্ছায় তাঁরা করতেন না। এ কথা বলা ছাড়া উপায়ন্তর ছিল না। কিন্তু এটা যে সস্পূর্ণ অসত্য তাও নয়। আমি আগে বলেছি যে, পাকিস্তান আর্মি বাংলাভাষী প্রায় সবাইকে অবিশ্বাস করতো। সে জন্য তাদের রোষে না পড়ার একটা উপায়া ছিল একটু বেশি করে ইসলাম প্রীতি জাহির করা। এটা ছিলো অত্যন্ত বিব্রতকর একটা অবস্থা। আবার এদিকে প্রকাশ্যে শেখ মুজিবের বিরোধিতা করেছে এ অভিষোগ প্রমাণিত হলেও রক্ষা ছিল না। আমার মনে আছে ফজলুল কাদের চৌধুরিকে যখন কোর্টে হাজির করা হয় তিনি পর্যন্ত বললেন যে, তিনিও এক সময় মুজিবকে সাহায্য করেছেন এবং এমন ভাষা ব্যবহার করলেন যাতে মনে হতে পারে যে, তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধাচরণ করেননি। তাঁর জন্য দুঃখ্য হলো। অনেকের বোধ হয় মনে নেই যে, ১৬ই ডিসেম্বরের পর ফজলুল কাদের সাম্পান ভাড়া করে কিছু টাকা-পয়সা নিয়ে আরাকানের দিকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু ফজলুল কাদের চৌধুরীর মতো ব্যক্তির পক্ষে আত্মগোপন করা অসম্ভব ছিল। পথ থেকে তাঁকে ধরে আনা হয়।
আমি উল্লেখ করতে ভুলে গেছি যে ”সাত সেলে” যখন প্রথম আসি তখন যাদের পেয়েছিলাম তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন হাফিজউদ্দিন। হাফিজউদ্দিন ইসলামিয়া কলেজের আমার পুরানো ছাত্র। সে ছিলো এক ব্যাংকের ম্যানেজার। সম্ভবতঃ মুসলিম কমারশিয়াল ব্যাংকের ম্যানেজার। শেখ মুজিবের এক কেইসে তাকে সাক্ষী দিতে হয়, এই অপরাধে তার কারাবাস। সে ছিল খুব দিল খোলা লোক। মতাদর্শের দিক থেকে চরম মুজিব ভক্ত। সবাই বলতো আপনার মত ব্যক্তিকে কেন জেলে আসতে হল? পূর্ব পাকিস্তান কিভাবে শোষিত হয়েছে সে সম্পর্কে অনেক আজগুবি গল্প তার কাছে শুনতাম। দেশে নতুন ব্যাংক চালু করার প্রয়োজন যখন ঘটে তখন শেখ মুজিবের বার্তাবহ এক ব্যক্তি এসে তাকে নিয়ে যায়। সেদিনকার ঘটনটি বিশেষভাবে মনে থাকবার কারণ হাফিজউদ্দিন রাতের ভাত কিছুটা জমা করে পান্তা করে রেখেছিল। সকাল বেলা কাঁচা মরিচ আর পিয়াজ দিয়ে এসব খাবে- এই ইচ্ছা ছিল। প্রথমবার যখন খবর আসে তাকে জেলের অফিসে যেতে হবে, সে জানায় সে গোসল সেরে নাশতা করে যাবে। দশ মিনিট পর আবার তাগিদ এলো। এবারও সে একই জবাব দিলো। মুক্তি আসন্ন এটা তাকে জানানো হয়নি। স্থির করেছিলে পান্তাটা খেয়েই সে যাবে। তৃতীয়বার আসল খবর পাওয়া গেলো। পান্তা আর তার খাওয়া হলো না। আমরা মোবারকবাদ জানিয়ে তাকে বিদায় দিলাম। এরপর আর কখনো তার সাথে দেখা হয়নি। হাফিজউদ্দিন ছিলো অত্যন্ত নিঃরহঙ্কার। বেশ লেখা পড়া জানতো। এ রকম লোকের মাথায় মুজিববাদী প্ররোচনা কিভাবে বাসা বেঁধে ছিলো তা নিয়ে আমি আর মোহর আলী অনেক জল্পনা-কল্পনা করেছি। জেলে কিছুদিন থাকবার পর ডাক্তার বাসেত স্থির করেন যে, তিনি শেখ মুজিবের কাছে মুক্তির আবেদন করবেন। তাঁকে নিরস্ত করা গেলো না। তাঁর আবেদনে আর্মি DURESS বা চাপের কথাতো ছিলোই আর ছিল তাঁর শারীরিক অসুস্থতার কথা। এতে হয়তো কিছুটা কাজ হয়েছিলো। কারণ আমাদের ছয়মাস আগে, ৭৩ সালের মে বা জুন মাসে তিনি রেহাই পান।
তার কিছুকাল পরেই আমাকে জানানো হয় যে, নতুন ”টেন সেলে” আমাকে বদলী করা হবে। আমি এ অপেক্ষায়ই ছিলাম। কারণ আবদুল আউয়ালের উপস্থিতিতে একেবারে অতিষ্ঠিত হয়ে উঠেছিলাম। ”নতুন টেন”- এর বিল্ডিংটা ছিলো দোতলা। নিচের যে অংশে আমরা থাকতাম তার মধ্যে ছিলো কয়েকটা সেল। এখানে পেলাম খাজা খয়ের উদ্দিন, মওলানা নুরুজ্জামান, ব্যারিস্টার আখতার উদ্দিন এবং মওলানা মোখলেসুর রহমানকে। এই শেষোক্ত ব্যাক্তির সাথে আমার আগের পরিচয় ছিলো না। তিনি ইসলাম মিশন নামে একটা প্রতিষ্ঠান চালাতেন। তেজগাও এলাকায় তিনি একটা এতিমখানা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। পাকিস্তান পতনের কয়েকদিন আগে এটার উপর ইন্ডিয়ানরা বোমা হামলা করে। এক সঙ্গে তিনশ” এতিম মারা যায়। বাকী আর তিন জনকে আগে থেকেই চিনতাম। মওলানা নুরুজ্জামান আমার ফুপাতো ভাই সৈয়দ মুঈনুল আহসানের সহপাঠী- বরিশালের লোক- নামজাদা মওলানা। ১৬ই ডিসেম্বরের পর তাঁর বাড়ি-ঘর ভেঙ্গে চুরমার করে দেওয়া হয়। আখতার উদ্দিন যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন থেকে তাঁকে চিনতাম। তখন সন্তবতঃ উনি ল” পড়ছেন অথবা পলিটিক্যাল সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের এমএ-তে ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যে চারজন ছাত্রকে নিয়ে আমি বার্মা সফরে যাই তার মধ্যে আখতার উদ্দিনও ছিলেন। বিয়ে করেছিলেন ঢাকার নবাব বাড়ীতে। খাজা নসরুল্লাহর মেয়েকে। সেই সুত্রে খাজা খয়েরউদ্দিনের আত্মীয় হতেন।
খাজা খয়েরউদ্দিনকে শুধু নামে চিনতাম। এই প্রথম দেখা মুসলিম লীগের লোক। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান যে কনভেনশন মুসলিম লীগ গঠন করেন তার বিরোধিতা করে খাজা খয়েরউদ্দিনরা কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং আইয়ুব সরকারের সহযোগিতা করতে অস্বীকার করেন। খুব খোশ-মেজাজী লোক। গল্পগুজব করতে ভালোবাসতেন। ভালো খাবারের দিকে আগ্রহ ছিলো। বিশেষ করে পনিরের প্রতি ছিলো দারুণ আকর্ষণ। ঢাকাই পনির ভেজে দিলে আর সব কিছু বাদ দিয়ে ওগুলি খেতেন।
খাজা সাহেবের কাছে শুনেছি যে, ১৬ই ডিসেম্বরের পর তিনি কিছুকাল আত্মগোপন করেছিলেন। একদিন গেরিলারা যে বাসায় তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন সেখানে তাঁর খোজেঁ এসে হাজির হয়। তিনি তখন এক গোসলখানায় ঢুকে পড়েন। গেরিলারা সেখানেও সার্চ করবে বলে জিদ ধরে তখন তাঁর এক আত্মীয়া অন্য পথে গোসলখানায় ঢুকে দরোজা ফাঁক করে গেরিলাদের ধমকান এই বলে যে তোমাদের কি মা-বোনদের মান-ইজ্জতের কোন জ্ঞান নেই। আমি গোসল করছি। এখানে ঢুকবে কিভাবে। এরপর ওরা চলো যায়। পরে খাজা সাহেব- উপায়ন্তর না দেখে পুলিশের কাছে সারেন্ডার করেন।
তিনি ছিলেন ঢাকা পিস কমিটির চেয়ারম্যান। তাঁর বিরুদ্ধে মুজিব দলের আক্রোশ ছিল সবচেয়ে বেশি। তাঁকে খুনের মামলায় জড়াবার চেষ্টা করা হয়। খাজা সাহেবের মামলা যখন শুরু হয় তখন তিনি কোর্টে একটি বিবৃতি পাঠ করেন। এটা রচনা করতে আমিও তাঁকে সাহায্য করেছিলাম। কথাগুলি ছিলো খাজা সাহেবের। কিন্তু ভাষা অধিকাংশই আমার। দুর্ভাগ্যবশতঃ খাজা সাহেব দলিলটি হারিয়ে ফেলেছেন। এই বিবৃতিতে তিনি যে কথা বলেন আর কোন মুসলিম লীগ নেতা সে রকম কথা বলেন নি বা বলতে সাহস পাননি। তাঁর বক্তব্য ছিলো যেমন সাহসী তেমনি দ্বিধাহীন। তিনি বলেছিলেন যে, মুসলিম লীগ তাঁরই পূর্ব পুরুষ নওয়াব সলিমুল্লাহর সৃষ্টি। এই আন্দোলনের সঙ্গে তিনি জন্মসূত্রেই জড়িত। সুতরাং ”৭১ সালে পাকিস্তানের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে যে হুমকি দেখা দেয় তার মধ্যে পক্ষ নির্বাচনের প্রশ্ন ওঠেনি। যে আদর্শ যে বিশ্বাসে তিনি লালিত ও বর্ধিত হয়েছিলেন তা রক্ষা করার চেষ্টা তিনি করেছেন কর্তব্য মনে করে। এজন্য বর্তমান অবস্থায় যদি তাকেঁ শাস্তি দেওয়া হয় সেটা হবে অন্যায়। কিন্তু তিনি কিছুতেই বলবেন না যে ”৭১ সালে তিনি ভুল করেছিলেন।
খাজা সাহেবের মামলা শেষ হবার আগেই ”৭৩ সালের ডিসেম্বরে আমরা সবাই মুক্তি পেয়েছিলাম। সুতরাং খাজা সাহেবের কি শাস্তি হত সেটা আর বুঝা গেল না। মাওলানা মোখলেসুর রহমান ও মওলানা নুরুজ্জামান দু”জনই ছিলেন খুব গোঁড়া লোক। এদের সঙ্গে ইসলাম সম্বন্ধে কথা বলতে ভয় করতো। কারণ অল্পতেই তাঁরা ঈমান নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন। একবার কি প্রসঙ্গে যেন দর্শনের কথা ওঠে। দর্শনের চরিত্র ব্যখ্যা করতে যেয়ে মহা মুশকিলে পড়লাম। উভয়ই ঘোষণা করলেন যে দর্শনের সংস্পর্শে এলে কারো ঈমান ঠিক থাকার কথা নয়। মোখলেসুর রহমান সাহেব দাবী করলেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস থেকে দর্শন বিষয়টি তুলে দেওয়া দরকার। এঁর সঙ্গে তর্ক করা নিরর্থক মনে করলাম।
মওলানা নুরুজ্জামানের সেলের পাশে যে ভদ্রলোক থাকতেন তিনি ইস্ট পাকিস্তান সরকারের জয়েন্ট সেক্রেটারী পদে ছিলেন। রাজনীতির সঙ্গে সংশ্রব মোটেই ছিল না। কিন্তু নামাজ-রোজা করতেন বলে তাকেঁ চাকরীচ্যুত করা হয়। বয়স পঞ্চাশের মাঝামাঝি, কিন্তু দেখলে মনে হতো আশির মতো। খুব জয়িফ হয়ে পড়েছিলেন। হাত কাঁপতো। খুব অমায়িক লোক। অল্প কথা বলতেন। শুনলাম তিনিও নাকি আমার ফুপাতো ভাই সৈয়দ মঈনুল আহসানের সহপাঠী ছিলেন। লক্ষ্য করতাম যে, তিনি খানা খেতেন দেশী মাটির বাসনে। জিজ্ঞাসা করে জানলাম তিনি মনে করেন এ রকম বাসন ব্যবহার করা সুন্নত। রসূল (সঃ) তো মাটির বাসনেই খেতেন। আমি বললাম, চিনামাটির বাসনও তো মাটির বাসন। সেটা ব্যবহার করা সুন্নতের খেলাফ হবে কেন? তিনি কথাটি কখনো আগে ভেবে দেখেননি। আমার কথার যৌক্তিকতা স্বীকার করলেন।
মওলানা নুরুজ্জামানকে নিয়ে একদিন এক অস্বস্তিকর সমস্যায় পড়েছিলাম। সেদিন পৃথিবীর নানা দেশের কথা হচ্ছিলো। মওলানা সাহেব ”চাইলের” স্বৈরশাসকের কথা উল্লেখ করলেন। আমি তো প্রথমে বুঝতেই পারলাম না কোন দেশের কথা তিনি বলছেন। পরে টের পেলাম ”চিলি” কে তিনি ”চাইল”- বলছেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক তাতে তাঁর উচ্চারণ সংশোধন করার প্রবৃত্তি আমার হলো না। তিনি ভালো ইংরেজী বলতে পারতেন। একদিন ডক্টর শহীদুল্লাহ সম্পর্কে এক মজার গল্প শুনালেন। ফেকাহ শাস্ত্রের একখানা বিখ্যাত কিতাবের নাম -”বাকায়া”। আলিয়া মাদ্রাসায় এটা পড়ানো হয়। কিন্তু কিতাবখানা এত কঠিন যে সাধারণত ছাত্ররা মূল বাকায়াহটার ধারে কাছে না গিয়ে শারহে বাকায়া বা বাকায়া বোধিনী নামক পুস্তকের উপর নির্ভর করে। একদিন নাকি মাদ্রাসা সিলেবাস সম্পর্কে এক কমিটির আলোচনা প্রসঙ্গে ”বাকায়ার” কথা ওঠে। শহীদুল্লাহ সাহেব কমিটিতে ছিলেন। তিনি বার বার আপত্তি জানিয়ে বলতে থাকেন কিতাবখানার নামতো ”শারহে বাকায়া” নুরুজ্জামান সাহেব বললেন আমি তো শুনে অবাক। বুঝলাম ডক্টর শহীদুল্লাহ কোনো দিন মূল বাকায়ার নামই শোনেননি। ”বিশ সেলের” কাছাকাছি ছিলো জেলের পাগলা গারদ। সেখান থেকে অনবরত চেঁচামেচির আওয়াজ কানে আসতো। এ পাগলাদের মধ্যে এক ব্যক্তি ছিলো যাকে সবাই বুজুর্গ মনে করতো। সে এখনো জেলে আছে কিনা জানি না। শুনেছি ১৬ই ডিসেম্বরের পর যখন জেলের ফটক খুলে দেওয়া হয় এবং সব কয়েদী বেরিয়ে যায় তখনো এ লোকটা তার আস্তানা ত্যাগ করেনি। এ ঘটনার ফলে জেলের পাহারাদারদের চোখে তার মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পায়। প্রথম প্রথম পাগলদের চেঁচামেচিতে ঘুমের ব্যাঘাত হতো। তারপর এতে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। ”বিশ সেলের” উপর তলায় কয়েকজন কম্যুনিস্ট কয়েদী ছিলো। একজন ছিল রণজিৎ। আরেকজন পাবনার টিপু বিশ্বাস। এদের নামতে দেওয়া হতো না। তবে খাজা খায়েরউদ্দিন নীচে থেকে রণজিতের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন এবং তার চিঠিপত্র বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও মাঝে-মধ্যে করতেন। এ রকম একটা লম্বা চিঠি খাজা সাহেব আমাকে দেখিয়েছিলেন। ইংরেজীতে লেখা তার মধ্যে ছিলো মার্কসিস্ট দর্শনের আলোচনা। কিছুটা পড়ে দেখলাম রণজিৎ নামে এই ভদ্রলোক বিশ্বাস করেন যে মার্কসিস্ট দর্শনে বিশ্ব রহস্যের সমাধান রয়েছে। দুনিয়ায় এমন কোনো কিছু নেই যার ব্যাখ্যা এই দর্শনে নেই। এ লোকটিকে আমি কখনো দেখিনি। কারণ ঘাড়ে পিঠে ব্যাথা থাকার কারণে আমি মুখ উঁচু করে উপর দিকে তাকাতে পারতাম না।
মুজিববাদ
একদিন টিপু বিশ্বাস এক বিস্ফোরণ সৃষ্টি করলেন। জেলের কোনো কর্মচারীর ব্যবহারে রেগে ফেটে পড়ে বিষম জোরে ওদের শাসাতে লাগলেন এই বলে যে এর প্রতিশোধ নিয়ে ছাড়বেন। জেল কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে থাকেন যে তিনি একেবারে অসহায় তবে এটা তাদের চরম ভুল। তার চিৎকারে আমরা হতবাক হয়ে গেলাম। জেল কর্তৃপক্ষ কোন প্রতিক্রিয়া প্রদশর্ন না করে চুপ করে রইলেন। এত তর্জন গর্জন আমি জীবনে কখনো শুনিনি। বলা বোধ হয় প্রয়োজন যে টিপু বিশ্বাস একটি বামপন্থী সন্ত্রাসী দলের নেতৃত্ব করতেন। শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর বিরোধ ঘটেছিলো কেনো সে রহস্যের সন্ধান আমি কখনো পাইনি। তবে এটা লক্ষ্য করেছি ”৭২-৭৩ সালে বহু লোক যারা একাত্তরে শেখ মুজিবকে সমর্থন করেছিল এবং বহু দক্ষিণপন্থী লোকদের হত্যা করে বিজয় উল্লাস করতো তাদের সঙ্গেও আওয়ামী লীগের বিরোধ ঘটতে শুরু করে। আওয়ামী লীগ মনে করতো তাদের কোনো নীতি বা কর্মের বিরুদ্ধে কোন সমালোচনা করা চলবে না। সামান্য সমালোচনা করলেও এরা মনে করতো যে আওয়ামী লীগের কর্তৃত্বে ফাটল ধরবে। শেখ মনি তো প্রথম থেকেই প্রচার করতে শুরু করেছিলো যে মুজিববাদের মত এমন একটা অভিনব রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আদর্শ দুনিয়ায় আর কখনো দেখা যায়নি। এ সমস্ত কথা এ সময়ের বাংলা ও ইংরেজী দৈনিকে প্রতিনিয়ত প্রকাশিত হতো। শেখ মুজিব যিনি ছিলেন একজন রাজনৈতিক নেতা, তিনি হঠাৎ হয়ে গেলেন কার্ল মার্কসের মত এক তাত্ত্বিক। সবচেয়ে আশ্চর্য লেগেছে যে খন্দকার ইলিয়াসের মত শিক্ষিত ব্যক্তিরাও ”মুজিববাদ” নামক এই অদ্ভুত তত্ত্ব পুরাপুরি হজম করেছিলেন। ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে আমি, ডক্টর মোহর আলী ও ডক্টর দীন মোহাম্মদ ইউনিভার্সিটি থেকে চিঠি পেলাম যে ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ দালাল হিসেবে আমাদের বরখাস্ত করেছেন। আমার বেলায় এই পদচ্যুতির তারিখ ছিল বোধ হয় ১৩ই জুলাই। তার অর্থ ১৯শে ডিসেম্বর ”৭১ থেকে ”৭৩ সালের ১৩ই জুলাই পর্যন্ত আইনতঃ ইউনিভার্সিটিতে আমার চাকরী বহাল ছিল। কিন্তু আমার বকেয়া বেতন পরিশোধ করা দূরে থাকুক, আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা দিতেও প্রথমে তারা অস্বীকার করেন। শেষ পর্যন্ত ডক্টর আবদুল মতিন চৌধুরীর আমলে যখন প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা দেওয়া হয় তখন শুধু আমার নিজের জমা দেওয়া টাকাটাই পেয়েছিলাম। এর সমপরিমাণ টাকা ইউনিভার্সিটির তরফ থেকে ঐ ফান্ডে জমা দেওয়ার কথা। সেটা আমাকে দেওয়া হয়নি। এই প্রসঙ্গে আরো উল্লেখযোগ্য যে সৈয়দ মঞ্জুরুল আহসান সুপ্রীম কোর্টে কেইস করে যখন রায় পান যে দালাল আইনে আমার পদচ্যুতি সম্পূর্ণ অবৈধ তখনো ইউনিভার্সিটি সিন্ডিকেট আনুষ্ঠানিকভাবে সেই পদচ্যুতির আদেশ প্রত্যাহার করেনি এবং আমাকে কোন খেসারত দেওয়া হয়নি। আমি যখন খেসারতের জন্য চিঠি লিখি তারা এক নতুন অজুহাতের আশ্রয় নিলেন, রেজিস্টার আমাকে জানালেন যে ইউনিভার্সিটি বা সরকারের এক নিয়ম আছে যে পদচ্যুত থাকাকালীন অন্য কোথায়ও যদি চাকরী গ্রহণ করেন তবে তিনি নতুন চাকরিতে যে বেতন পাবেন সেটা খেসারত থেকে বাদ দিয়ে শুধু বাকী টাকাটাই তাকে দেওয়া হবে। এই অদ্ভুত নিয়মের যৌক্তিকতা কি তা হৃদয়ঙ্গম করা সহজ নয়। যদি সত্যিই এ রকম নিয়ম থেকে থাকে তবে তার অর্থ এই হবে যে পদচ্যুত ব্যক্তির যদি খেসারত প্রাপ্তির আশা থাকে তবে তাকে চুপ করে কোন কাজকর্ম না করে অনাহারে থাকতে হবে। আর নতুন চাকরীর বেতন যদি পুরানো চাকরীর বেশী হয় তখন আর খেসারত প্রদানের প্রশ্ন উঠবে না। আমার বেলায়ও তাই ঘটেছিলো। এই সমস্ত প্রশ্ন যখন দেখা দেয় তখন আমি মক্কার ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করি। সেখানে ঢাকার চেয়ে বেশী বেতন পেতাম বলে আমাকে আমার প্রাপ্য দেওয়া হলো না। ”৭৩ সালের আরেকঢি ঘটনা হচ্ছে যে আমার বিরুদ্ধেও দালাল আইনে সরকার মামলা রজু করেন। আমাকে এ নিয়ে দু”বার কোর্টে হাজির হতে হয়। বলা বাহুল্য, এ ধরনের অভিজ্ঞতা জীবনে আমারএইপ্রথম। কোনো উকিল পাওয়া গেলো না। শেষ পর্যন্ত আমার ফুপাতো ভাই সৈয়দ মঞ্জুরুল আহসান যিনি নিজে কিছুদিন আগে জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন, সাহস করে আমার কেইস পরিচালনা বকরতে এগিয়ে আসেন। মঞ্জুর আমাকে বলে দিয়েছিল যে, হাকিম আমার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য কোর্টে অভিযোগগু পাঠ করে শুনাবে এবং জিজ্ঞাসা করবে আমি গিল্টি বা দোষী নই কি না। আমাকে বলা হলো আমি যেনো বলি নট গিল্টি। তাই বললম। তারপর কেইসটি কিছুদিনের জন্য মুলতবি হয়ে যায়। দ্বিতীয় তারিখে আবার আমাকে কোর্টে হাজির হতে হয়। তখনো আইনের খুটিঁনাটি নিয়ে সৈয়দ মঞ্জুরুল আহসানের সঙ্গে হাকিমের আলোচনার পর মামলাটি মুলতবি করা হয়। এটা ১৯৭৩ সালের শেষ দিকের ঘটনা। আর আমাকে কোর্টে যেতে হয়নি। কারণ ঐ সালের ৫ই ডিসেম্বর আমরা সবাই জেল মুক্ত হই। ”৭৩ সালের শেষার্ধে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার চরম অবনতি ঘটে। উত্তর বঙ্গে দুর্ভিক্ষে হাজার হাজার লোক মৃত্যূ মুখে পতিত হয়েছিলো সে কথা আগে একবার উল্লেখ করেছি। অন্য দিকে হঠাৎ করে সমাজতন্ত্রের নীতি অনুসরণ করতে যেয়ে সরকার যখন মিল-কারখানা অনভিজ্ঞ এবং দুশ্চরিত্র লোকদের হাতে অর্পণ করেন তখন উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশের চতুর্দিকে দেখা দেয় চরম অভাব-অনটন। কিন্তু কাগজ পত্রে এ সম্বন্ধে কোন সমালোচনা হতো না। শুধু সংবাদ পাঠ করে আঁচ করা যেতো দেশে কি হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃবর্গের লাইফ স্টাইল
একদিকে দেশের এই দুর্দশা অন্য দিকে শুনতাম আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের বিলাসবহুল জীবনের কথা। এ সময় গাজী গোলাম মোস্তফা নামক এক ব্যক্তিকে বাংলাদেশ রেডক্রসের প্রধান করা হয়। দুর্দশাগ্রস্ত জনগণের জন্য যে বিপুল পরিমাণ বিদেশী সাহায্য আসা শুরু করে তার বন্টন-বিতরণের ভার ছিল এই গোলাম মোস্তফার উপর। শুনতাম সাহায্যের সিকি পরিমাণ অর্থও লোকের হাতে পৌছাত না। খাদ্য-ঔষধ-কাপড়-চোপর-কম্বল ইত্যাদি যা এসেছিলো তার কিছুটা বিক্রী হতো ব্ল্যাক মার্কেটে, আর কিছু যেত ইন্ডিয়ায়। হেনরি কিসিঞ্জার একবার রিলিফের দ্রব্যাদি দিল্লীর রাস্তায় দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি তখন এ দেশকে বটমলেস ব্রেড বাসকেট বা তলাবিহীন রুটির ঝুড়ি এই আখ্যা দেন। এ দুর্নাম আমাদের এখনও কাটেনি। হিসাব করে দেখা গেছে যে একাত্তরের পর কয়েক বছরে বাংলাদেশ যে বিদেশী সাহায্য পেয়েছিলো তার পরিমাণ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিধ্বস্ত জার্মানী মার্শাল প্ল্যানের যে সাহায্য পায় তার চেয়েও বেশী। অথচ এর বিনিময়ে দেশ কিছুই পেল না। কারণ বলা নিষ্প্রয়োজন। এই বিপুল অর্থের সিংহভাগ বিদেশী ব্যাংকে জমা হতো আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের নামে, দেশে তখন কে সবচেয়ে ধনী এরকমের একটা প্রতিযোগিতর কথা আমাদের কানে আসতো। অনেকের ধারণা ছিলো রেডক্রসের গাজী গোলাম মোস্তফাই নাকি বাংলাদেশের সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি। আমাদের কানে যে সমস্ত কথা এসেছে আমি সে কথাই বলছি। কারণ এ সব খবরের সত্যতা যাচাই করার সাধ্য আমাদের ছিল না। আর এক গল্প শুনেছি। সে আরো মজার। আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় এক নেতার বাড়ীতে তখন নাকি খানাপিনা তৈরী হতো তিন রকমের। দেশী, মোগলাই এবং সাহেবী। একদিন শুনেছি ছাত্রলীগের এক সদস্য যার সঙ্গে শেখ মুজিবের ছেলেদের বন্ধুত্ব ছিলো এই নেতার বাড়ীতে বেড়াতে আসে। তাকে দুপুরের খাবার খেয়ে যেতে বলাহয়। সে রাজী হয়। জিজ্ঞাসা করা হয় সে তিন ধরনের খাবারের কোনটা খাবে। সে মোগলাই খাবে বলে জানায়। পেট ভরে পোলাও-কোরমা খাবার পর যখন পেটে একেবারে জায়গা ছিল না তখন তার ধারণা হয় যে বিদায় নেবার আগে দেশী খানার চেহারাটা একবার দেখে নেবে। সেই টেবিলে যেয়ে তার তো চক্ষু স্থির। বড় বড় চিতল এবং রুই মাছের টুকরো দেখে ভরা পেটেও তার জিহ্বায় পানি আসে। কিন্তু তখন ওসব খাবার উপায় ছিলো না। তবুও সে এক টুকরা চিতল খাওয়ার লোভ সামলাতে পারেনি। এই ছাত্রটির মুখে যিনি গল্পটি শুনেছিলেন তিনিই আমাকে এসব কথা জানান। আরো শুনেছি গাজী গোলাম মোস্তফার একটা কাজ ছিল রিলিফের টাকা দিয়ে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতাদের দৈনিক বাজার করে দেওয়া। শুনতাম ”৭২- ”৭৩ সালেও এদের প্রত্যেকের বাড়ীতে কাঁচা বাজারই হতো প্রায় হাজার টাকা। অর্থনীতি ধ্বংস হওয়ার আরেক কারণ মিল-কারখানা রাষ্টায়ত্ত হবার পর কেউ আর কাজ করার প্রয়োজন বোধ করেনি। অনুপস্থিত থেকেও অনেকেই বেতন নিয়েছে। আবার অনেক ভুয়া নাম বেতনের খাতায় বসিয়ে নতুন ম্যানেজাররা তাদের বেতন বাবদ টাকা নিতেন। সারা দেশে এভাবে শুরু হয় লুটপাটের পালা। মুক্তিযোদ্ধারা অবাঙ্গালী এবং পাকিস্তানপন্থী বাঙালীদের বাড়ীঘর সহায় সম্পত্তি দখল করে বসে। ”৭৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে অবস্থা যখন চরমে পৌছায় তখন বিপুল সংখ্যক লোকজনকে জেলে অটকে রেখে পোষণ করা হয়। সরকারের পক্ষে এটা কঠিন হয়ে পড়ে। এই কয়েদীদের অন্তত দু”বেলা খেতে দিতে হতো। আমি একথা বলছি না যে শুধু এই কারণেই ডিসেম্বরে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এ কারণটি যে সরকারী সিদ্ধান্তের উপর প্রভাব ফেলেছিলো তা অস্বীকার করার উপায় নেই। অক্টোবর থেকে সাধারণ ক্ষমার গুজব ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এরকমের কথাবার্তা দু”বছরের মধ্যে অনেকবার শুনে নিরাশ হয়েছি বলে আমার নিজের মনে এ সময় কোনো উত্তেজনার সৃষ্টি হয়নি। তারপর সরকার শেষ পর্যন্ত যখন ঘোষণা করেন যে দালাল আইনে আটক সমস্ত ব্যক্তিকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তখনো এই আদেশে কতগুলো শর্ত আরোপ করা হয়। প্রথমতঃ খুন জখম এ রকমের কোনো অপরাধে যারা দন্ডিত হয়েছিলো তাদের বেলায় এটা প্রযোজ্য হবে না, এবং সে সম্বন্ধে সরকার নতুন কোন তদন্ত করবে না। তাছাড়া কোর্টে যাদের মামলা ঝুলছিলো তাদের নির্দেশ দেওয়া হলো যে সরকারের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা দেখিয়ে হাকিমের কাছ থেকে ছাড় নিতে হবে। এতে কারো কারো বেলায় জেল থেকে মুক্ত হতে বেশ কয়েকদিন লেগে যায়। আমাকে মুক্ত করা হয় পাঁচই ডিসেম্বর। সকাল বেলায় আমার ফ্যামিলি আমাকে নিতে এসে শুনলো যে, কোর্টের হুকুম ছাড়া আমাকে ছাড়া হবে না। তখন সৈয়দ মঞ্জুরুল আহসান সেদিনই কোর্টে গিয়ে তদবির করে এক হুকুম লিখিয়ে নিতে সমর্থ হয়। আমি সেদিন বিকাল বেলা সন্ধ্যার একটু আগে বাসায় ফিরে আসি। পেছনে রেখে এলাম অনেক অপমান, অবমাননা এবং দুর্ব্যবহারের স্মৃতি। আমি আগেই বলেছি প্রথম দিকে জেলের ওয়ার্ডাররা আমাদের মানুষই জ্ঞান করতো না। সে আচরণে সামান্য একটু পরিবর্তন এলেও জেলের নিয়ম অনুসারে এমন কতগুলো কাজ করা হতো যাতে ভুলবার উপায় ছিলো না আমরা কতটা অসহায়। সপ্তাহে একদিন জেলের আইজি সেল পরিদর্শন করতে আসতেন। তখন আমাদের আবার তালা দিয়ে সেলে বন্ধ করে রাখা হতো চিড়িয়াখানার জানোয়ারের মতো। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আওয়ামী লীগের কয়েকজন মন্ত্রী এ রকম পরিদর্শনে একবার আসেন। এর মধ্যে ছিলেন তাজউদ্দিন এবং ডক্টর কামাল হোসেন। তাদের সঙ্গে যারা ছিলেন তাদের ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম না কিন্তু ডক্টর কামাল হোসেন ইউনিভার্সিটিতে যখন শিক্ষকতা করেন তখন থেকে তাঁকে চিনি, উনি আমার দিকে তাকালেনই না। মুখে ছিলো চরম ঘৃণার ভাব, তাজউদ্দিন জিজ্ঞাসা করলেন আপনি কেমন আছেন? মনে হলো এটাও একটা বিদ্রুপ, আরো অপমানিত বোধ করলাম এ জন্য যে পরিদর্শনে কেউ এলে সেলের ভিতরেও আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে বলা হতো। বসবার উপায় ছিলো না। সাপ্তাহিক পরিদর্শন ছাড়া জেলের জমাদার রোজই একবার করে সমস্ত সেল ঘুরে দেখতো। ওয়ার্ডারদের একটু উপরেই তার স্থান। সামান্য একটু লেখাপড়া হয়তো জানতো। কিন্তু ব্যবহারে মনে হতো সে যেনো একজন বড় কর্তা ব্যক্তি। জেলে যে একেবারে ভালো ব্যবহার পাইনি, তা নয়। একজন ডিআইজি ছিলেন। তিনি যথা সম্ভব ভদ্র ব্যবহার করতেন। আমাদের আটক করে রাখা হয়েছে এজন্য উনি যেন কুন্ঠা বোধ করতেন। একবার এক ছোকড়া ওয়ার্ডার কিভাবে এক কয়েদীকে খতম করেছিলে। সে কাহিনী শোনায়। সে কয়েক বছর আগের কথা। কয়েদিদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেওয়ায় তাদের উপর ফাঁকা গুলী করার হুকুম হয়। লোকটি আমাকে বললো যে ভুলে তার গুলী একটা লোকের পায়ে লেগে যায়। সে ভাবে লোকটি যদি জেল কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করে সে বেকায়দায় পড়বে। আহত কয়েদী যাতে আর কথা বলবার সুযোগ না পায় সেজন্য লোকটি আরেকবার গুলী করে তাকে মেরে ফেলে। বলা বাহুল্য, ঐ ঘটনার পরিসমাপ্তি ওখানেই ঘটে। আরো শুনেছি যে, কয়েদীদের জন্য দৈনিক যে বাজার করা হয় তার ভাগ আইজি থেকে শুরু করে সব অফিসারদের বাড়ীতে পৌঁছে দিতে হয়। ছিটেফোঁটা যা থাকে তাই কয়েদীদের ভাগ্যে জুটে। আরেকটা ব্যাপার উল্লেখ করা দরকার। কয়েদীরা দই শ্রেণীতে বিভক্ত। প্রথম হচ্ছে বিচারাধীন কয়েদী, দ্বিতীয়তঃ সাজাপ্রাপ্ত কয়েদী। এই দুই শ্রেণীতেই আবার আরেকটা শ্রেণী বিভাগ আছে। বৃটিশ আমল থেকেই রাজনৈতিক বন্দীরা কতগুলো সুবিধা ভোগ করতো যা ছিলো অন্যদের জন্য নিষিদ্ধ। পাকিস্তান আমলে ইউনিভার্সিটি শিক্ষক যাঁরা দু”একবার ভাষা আন্দোলনের কারণে জেল খেটেছেন তাদের মুখেও শুনেছি যে খাওয়া-দাওয়া ব্যাপারে তাদের কোন অভিযোগ ছিল না। বরঞ্চ যে পরিমাণ দুধ-মাখন-রুটি মাছ-গোশত এদের জন্য বরাদ্দ ছিল তা অনেকে খেয়ে কুলাতে পারতো না। এঁরা টুথ ব্রাশ-টুথপেস্ট, খবরের কাগজ এ সবই পেতেন। কিন্তু আমরা যারা একাত্তর সালের পর রাজনৈতিক কারণে বন্দী হয়ে জেলে এসেছিলাম আমাদের এসব সুবিধা কোনোটিই দেওয়া হয়নি। অনেকে এ নিয়ে অভিযোগ করেছেন। তাজউদ্দিন যখন পরিদর্শনে আসেন তখন নাকি খান আবদুস সবুর খান তাকে বলেছিলেন, “আমরা তোমাদের সঙ্গে কি ব্যবহার করেছি, এটা কি তার যথাযোগ্য প্রতিদান?” জেলের কর্মচারীদের অভিযোগ অনেক ছিল। ”৭৩ সালে দু”একজন বাদে প্রায় সবাই যখন মুজিববিরোধী হয়ে উঠে তখন এরা সবুর খান, ফজলুল কাদের চৌধুরি, খাজা খয়ের উদ্দিন- এদের বলতো স্যার আপনারা যখন সরকার গঠন করবেন, আমাদের দিকে একটু নজর রাখবেন। তার মানে এরা ধরেই নিয়েছিল যে আওয়ামী লীগ সরকার টিকছে না। আশ্চর্যের কথা জেল খাটা লোক আগেও পুনরায় রাজনৈতিক ক্ষমতায় যেতে পেরেছেন কিন্তু জেল থেকে বেরিয়ে জেলের আভ্যন্তরীণ অবস্থা উন্নয়নের কথা একবারও তাদের মনে হতো না। আমি আগেই বলেছি যে জেলের যে পরিবেশ তাতে ভালো লোকও এখানে অসৎ হয়ে উঠতে বাধ্য হয়। সাজা প্রাপ্ত চোর-ডাকাত বেরিয়ে আবার চুরি ডাকাতিই করতে যায়। বরঞ্চ আরো একটু পাকা হয়ে। সাধারণ কয়েদীরা সামান্য একটু নিয়ম ভঙ্গ করলে ওয়ার্ডারদের হাতে বেদম মার খায়। আমাদের ফালতুদের মুখে প্রতি সপ্তাহেই এ সমস্ত কাহিনী শুনেছি। বিহারী হলে তো কথাই ছিলো না। তাদের সামান্য পদস্ফলন হলেও নির্যাতনের সীমা থাকতো না। জেলের পরিমন্ডলে প্রত্যেকটি ওয়ার্ডারই স্যাডিস্ট হয়ে উঠে। নির্জীব লোকজনকে মেরে এরা এক রকমের পাশবিক আনন্দ উপভোগ করে। আরেকটি ব্যাপার খুব খারাপ লেগেছে। দু” সপ্তাহ পর পরিবারের লোকজন যখন দেখা করতে আসতো, না ছিল কোনো প্রাইভেসি, না ছিলো ভালো বসবার ব্যবস্থা। এক কামরায়ই দু” তিন পরিবারের লোকজন জমায়েত হয়ে বিভিন্ন কোণায় আশ্রয় নিতো। তখন প্রাইভেসির কথা ভাবাই যেত না। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই আমাদের সেলে যাওয়ার তাগিদ পেতাম। প্রথম প্রথম রান্না করা খাবার আনা নিষেধ ছিলো। শুধু কলা বা ঐ জাতীয় ফল সেলে আনা যেত। পরে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়। বিশেষ, করে ঈদ এবং অন্যান্য পর্বের সময়। জেল থেকে যখন বেরিয়ে আসি তখন নিজের মনেই সন্দেহ হয়েছে যে আমি আবার স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারবো কিনা। শারীরিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছিলাম, অর্থনৈতিকভাবে হয়ে পড়েছিলাম বিপর্যস্ত। ভবিষ্যতে যে কয়দিন আয়ু থাকবে সে সময়টা কি করে চলবে এই দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে বাসায় ফেরত এলাম। তবে দু”বছর পর মুক্ত হতে পেরেছি এই অনুভূতি সেই মুহুর্তে আমার সমস্ত দুশ্চিন্তাকে ছাপিয়ে উঠেছিলো।
বাসায় এসে অনেক কথা শুনলাম যা আগে আমাকে বলা হয়নি বা যা আগে জানবার উপায়ও ছিল না। তখন মনে হয়েছিল যে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল খেকে মুক্ত হয়ে এসেছি বটে কিন্তু আমি যেন এক বৃহত্তর কারাগারে প্রবেশ করেছি। প্রথমতঃ আমরা যারা পাকিস্তানের আদর্শে বিশ্বাস করতাম তাদের কোন বাক স্বাধীনতা ছিলো না। আকার ইংগিতেও পাকিস্তানের কথা বলা ছিলো চরম দন্ডনীয় অপরাধ এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে দন্ড হতো মৃত্যূদন্ড। সরকার পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার না করলেও তথাকথিত মুক্তিবাহিনীর লোকজন এসে এ রকম হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে অসংখ্য। তাদের বিরুদ্ধে নালিশ বা মামলা রজু করার কথাই উঠতো না। তারাই ছিলো দেশের হর্তাকর্তা বিধাতা। প্রায় রোজই খবরের কাগজে দেখতাম এ ধরনের সংবাদ। ইংরেজীতে ”উইচ হান্ট” বলে একটা কথা আছে। মধ্যযুগে যখন ইউরোপীয় সমাজে এই বিশ্বাস প্রচলিত ছিলো যে ডাইনী বুড়িরা গোপনে শয়তানের উপাসনা করে এবং মানুষের ক্ষতি করার অপরিমিত ক্ষমতা তাদের আছে। তখন সমাজে কোন দুর্ঘটনা ঘটলেই ডাইনী খুঁজে বের করার চেষ্টা শুরু হতো। জুবজুবে কোনো বুড়িকে নিরালা কোনো জায়গায় দেখা মাত্র সন্দেহ করা হতো যে তারা অপকর্মে লিপ্ত। সঙ্গে সঙ্গে তাদের ধরে এনে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার রেওয়াজ ছিল। শাসক শ্রেণীর কোন ব্যক্তি অসুস্থ হলেও সন্দেহ করা হতো যে এটা ডাইনীদের শয়তানির ফল। ইংল্যান্ডের প্রথম এলিজাবেথ একবার যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন অনেক বুড়ি প্রাণ হারিয়েছে। তাছাড়া এর পেছনে খৃষ্টান যাজকদেরও সমর্থন ছিল। তাঁরা মনে করতেন যে তথাকথিত ডাইনীদের নির্মূল করে দিতে পারলে খৃষ্টান ধর্মের উন্নতির পথে একটা বড় অন্তরায় অপসারিত হবে। মোদ্দা কথা হচ্ছে উইচহান্টের ফলে সাধারণ লোকের জীবনও বিপন্ন হয়ে পড়েছিলো। পাদ্রীরা অনবরত খোঁজ করে বেড়াতেন কারো ধর্ম বিশ্বাসে কোথাও ফাটল দেখা দিয়েছে কিনা।
উইচহান্ট
নতুন বাংলাদেশে এ ধরনের উইচহান্ট শুরু হয় আওয়ামী লীগ বহির্ভূত লোকদের নিয়ে। প্রমাণের দরকার হতো না। গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-মাঠে বিচারের প্রহসন করে কয়েক হাজার লোককে ১৬ই ডিসেম্বরের পর খতম করা হয়। এই প্রক্রিয়া ৭৩-৭৪ সালেও অব্যাহত ছিলো। তাই বলছিলাম আমাদের মত ব্যক্তিদের নিঃশ্বাসও ফেলতে হতো সন্তর্পণে। আমরা জেল থেকে যারা বেরিয়ে ছিলাম তারাও পরস্পরের সাথে দেখা করতে ভয় পেতাম। মনে হতো কে কখন আবার ধরা পড়বে।
দ্বিতীয়তঃ লক্ষ্য করলাম যে আওয়ামী লীগের লুটপাটের ফলে দেশের অর্থনীতি এমনভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে যে সাধারণ লোকের পক্ষে ডাল ভাত খেয়ে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে ওঠে। চালের দাম একাত্তর সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল মণ প্রতি ৩০ টাকা। ৭৩ সালে এটা উঠে ৪০০ টাকায়। এবং ৪০০ টাকায়ও পাওয়া যেত শুধু মোটা চাউল। এ রকম ভাবে ডাল-তেল-লবণ, মরিচ, হলুদ এসব নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে এমন এক পর্যায়ে ওঠে যে ১০/১২ হাজার টাকার আয় যাদের ছিলো তাদের ভালো খাবারের কথা ভাববার উপায় ছিলো না। ৭৩ সালের দুর্ভিক্ষে উত্তর বঙ্গে যে কয়েক হাজার লোক প্রাণ হারিয়ে ছিলো সে কথা আগে একবার উল্লেখ করেছি। আমি লক্ষ্য করলাম যে হয়তো টেকনিক্যাল অর্থে দেশের মধ্য ও দক্ষিণ অঞ্চলে দূর্ভিক্ষ ছিলো না কিন্তু আসলে যে অবস্থায় আমরা তখন বাস করেছি ৭০-৭১ সালের অবস্থার তুলনায় তাকে দূর্ভিক্ষ বলা যায়।
তৃতীয়তঃ বৃটিশ শাসনের পর আবার নতুন করে টের পেলাম, উপনিবেশবাদ কাকে বলে। ভারতের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনার অধিকার কারো ছিলো না। তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা উপলব্ধি করতে পারেন যে ভারতীয় সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানের সব কিছু লুটে-পুটে নিয়ে যাচ্ছে তারাও মুজিব সরকারের রোষানলে পতিত হন। শুনলাম মেজর জলিলের দুর্দশার কারণ এই। তিনি নাকি ছিলেন যশোর সেক্টরে। ১৬ই ডিসেম্বরের পর তিনি যখন স্বাধীনতার আনন্দে প্রায় আত্মহারা হয়ে উঠেছেন তখন লক্ষ্য করলেন যে ভারতীয় সৈন্যরা যশোর ক্যান্টনমেন্টের সবকিছু তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি গ্রেফতার হন। এভাবে কিছুটা তাঁর মোহভঙ্গ হয়। এ ছিলো এক আশ্চর্য ঘটনা। দালাল, আল-বদর, আল-শামস এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো যে এরা আওয়ামী লীগের আন্দোলনের সমর্থন করেনি। কিন্তু হাজার হাজার যুবক যারা মনে করেছিলো যে পাকিস্তানী ”দুঃশাসনে”র অবসান ঘটিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করবে তারাও দেখতে পেলো যে নতুন ঔপনিবেশিক শক্তি ভারতের তাবেদারীকে স্বাধীনতার সংজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে মাত্র। শেখ মুজিব গান্ধীর কাছে কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ প্রথমেই বেরুবাড়ী এবং এ রকম আরো কয়েকটা অঞ্চল ভারতকে দান করে বসেন। তার বিনিময়ে বাংলাদেশের তিন বিঘা নামক ছিটমহলের সঙ্গে করিডোর পাওয়ার কথা।
চতুর্থতঃ উপনিবেশবাদের আরেক নমুনার কথা কানে এলো। শুনতে পেলাম ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা ঢাকার সেক্রেটারিয়েটে বসে দেশের প্রশাসনের নীল নকশা তৈরী করে দিচ্ছেন। এ সময় ভি পি ধর, পি এন হাসকার প্রমুখ ভারতীয় অফিসার যারা অপারেশন বাংলাদেশ পরিচালনা করেন তারা কয়েকবার ঢাকা পরিদর্শনে আসেন। শুনেছি কোন ব্যাপারে কোন নীতি অনুসরণ করা হবে তা ঠিক করে দেওয়া হতো দিল্লী থেকে। আরেক কারণে প্রশাসনে অচলাবস্থা দেখা দেয়। যে সমস্ত অফিসার একাত্তর সালে নিরপেক্ষভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করে গেছেন তাদেরও মাফ করা হলো না। এদের মধ্যে কোনো কোনো ব্যক্তিকে চাকরীচ্যুত করা হয়; কেউ জেলও খেটেছেন। সুতরাং সর্বত্র ছিলো ত্রাসের অবস্থা। সরকারী অফিসারদের চেয়ে বেশি ক্ষমতা ছিলো ইন্ডিয়া ফেরত যুবকদের হাতে। তাদের ইচ্ছা মতেই অফিসারদের বদলি করা হতো। কারো হতো পদোন্নতি; কারো শাস্তি।
আইনের শাসন বলে কিছুই ছিলো না। ১৬ই ডিসেম্বরের আগে পর্যন্ত পাকিস্তানী মুদ্রার মান ছিলো ভারতীয় মুদ্রার চেয়ে বেশী। ১৬ই ডিসেম্বরের পর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশের মুদ্রার মান হ্রাস পায় এবং এই পরিস্থিতি থেকে আজো দেশ রেহাই পায়নি। জেলে নিজেদের টাকা পয়সা ব্যবহারের প্রয়োজন পড়েনি, তার অনুমতি ছিলো না। পুরানো ব্যাংকগুলি সব বন্ধ করে নতুনভাবে আবার ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করা হলো। সোনালী, রূপালী, জনতা, অগ্রণী, পূবালী প্রভৃতি নামের নতুন কতগুলি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত করা হয় যেনো পাকিস্তান আমলের নাম গুলিও গ্রহণযোগ্য নয়। এর ফলে অর্থনীতিতে যে ধারাবাহিকতা থাকা প্রয়োজন সেটা ধ্বংস করা হয়।
শুধু অর্থনীতি নয়, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, কলা সব ক্ষেত্রেই বলা হচ্ছিলো যে ১৬ই ডিসেম্বর থেকে আমাদের যাত্রা শুরু। শুধু পাকিস্তানের ২৩ বছর নয়, মুসলিম আমলের কয়েক শতাব্দীর ইতিহাসকেও অগ্রাহ্য করা হলো। যেনো ও সময় এমন কিছুই হয়নি, যদ্বারা এ অঞ্চলের অধিবাসীরা উপকৃত হয়েছে বা যার কোনো প্রভাব এদের জীবনের উপর অনুভব করা যায়। কোলকাতা ফেরত এক ভদ্রলোক ঘোষণা করলেন যে যুগে যুগে নাকি ইসলামের নামে পূর্ব বঙ্গের বাঙালীরা প্রবঞ্চিত হয়েছে। তুর্কি, মোগল, পাঠান যেমন প্রবঞ্চক ছিলো তেমনি ছিলো পাকিস্তানীরা। আশ্চর্যের কথা এই ভদ্রলোকটি ”৪৮ সালের পর একদিন এই বলে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন যে পাকিস্তানের অস্তিত্বের খাতিরে দরকার হলে আমাদের রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বর্জন করতে হবে; এই অতিশয়োক্তির প্রয়োজন কোনো কালেও ছিলো বলে আমার মনে হয়নি। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে ভাবলাম যে ”৪৮ সালের পর যারা এ রকম আষ্ফালন করতেন তারাই এখন বলতে শুরু করেছিলেন যে মুসলিম ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করা হবে আমাদের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। এরা একবারও ভেবে দেখেননি যে যুগ যুগান্তের প্রবঞ্চনার যে করুণ চিত্র এরা তুলে ধরেছিলেন তার মধ্যে সত্যের লেশ থাকলেও সেটা আমাদের জন্য হতো চরম অগৌরবের কথা। তাদের অভিযোগের সরলার্থ দাঁড়ায় এই যে পূর্ব বঙ্গে যে কয়েক কোটি মুসলমান বাস করে নৃতত্ত্বের দৃষ্টিতে তারা এতো নিকৃষ্ট যে কোনো যুগেই তারা কিছু করতে পারেননি, শুধু বঞ্চিত, উপেক্ষিত, অবহেলিত, উৎপীড়িত হয়ে এসেছে। এ ছিলো এক অদ্ভুত যুক্তি। অথচ এই যুক্তি কে মুজিববাদী অসংখ্য যুবক নিরেট সত্য বলে মেনে নিয়েছিলো। এই যে অসংখ্য মুসলমান যাঁরা মুসলমান হিসেবে বাংলাদেশ পূর্ব যুগে সাহিত্য সৃষ্টি করে গেছেন, স্থাপত্যে নিদর্শন রেখে গেছেন, জীবনের নানা ক্ষেত্রে যারা এক নতুন সভ্যতা সৃষ্টি করেছিলেন যা সামগ্রিক ইসলামের ইতিহাসের একটা দিক মাত্র, তাঁদের অবদান মিথ্যা হয়ে গেলো। বাংলার মুসলমান সুলতানেরাই বাংলা ভাষাকে জাতে তুলে ছিলেন। তাঁরা নিজেরা তুর্কি বা ফার্সি ভাষী ছিলেন কিন্তু বর্তমানের বিচারে তাঁরা হয়ে গেলেন উৎপীড়ক। যাঁরা মগের অত্যাচার থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করেছেন, যাঁরা মারাঠা বর্গীদের আক্রমণ থেকে এ দেশকে বাঁচিয়েছেন তাঁরাও ঐ সংজ্ঞায় পড়লেন। ১৯৪৭ সালের বিভাগ পূর্ব ইতিহাসের কথা যাদের মনে ছিলো তাঁরা নিশ্চয়ই জানতো যে এ অঞ্চলের উৎপাদিত শস্য দিয়ে কোলকাতার সমৃদ্ধি ঘটেছিল। পাট উৎপাদন করতাম আমরা; পাটের কল স্থাপিত হয় কোলকাতা এলাকায় অমুসলিম মালিকানায়। এমন কি নারায়ণগঞ্জের পাটের বাজারও ছিল মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীদের দখলে। জমিদাররা ছিলেন সবই প্রায় হিন্দু। এরা বাস করতেন কোলকাতায়, রাজস্ব গ্রহণ করতেন পূর্ব বঙ্গের জমিদারী থেকে। তবে এসব অত্যাচার নয়, এগুলিকে কেউ এখন উৎপীড়ন ও বলছিল না। কারণ এরা তো ছিল বাংলাভাষী, আমাদের একান্ত আপন লোক। এ যেনো আপন ভাইয়ের হাতে চর থাপ্পর খাওয়ার মতো। তবে মাড়োয়ারীদের শোষণের ব্যাপারটা এরা কিভাবে ব্যাখ্যা করেছে জানি না। সে প্রসঙ্গ এখন আর কেউ তুলে না। আরো মজার ব্যাপার যে বাংলা ভাষার দোহাই দিয়ে পাকিস্তানীদের অত্যাচারের নিত্য নতুন ফিরিস্তি তৈরী হচ্ছিল এবং বলা হচ্ছিল যে পাকিস্তানে যোগ দিয়ে আমরা নিজেদের সর্বনাশ ঘটিয়ে ছিলাম, সে বাংলা ভাষা ভারতে রাষ্ট্র ভাষার সম্মান পায়নি এবং পাওয়ার কোন সম্ভাবনাও নেই। যারা বলছিলেন দেশ বিভাগ নাকচ করে আবার ভারতে ফিরে যেতে তাঁরা ইচ্ছা করেই এ প্রসঙ্গটা উত্থাপন করতেন না। এমন একটা ভাব দেখান হতো যে পশ্চিম বাংলার সঙ্গে মিশে গিয়েও আমরা বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে ব্যবহার করতে পাররো। এদের বাংলা ভাষা প্রীতি যে একেবারে মেকী সে সম্পর্কে আমার মনে কোনো কালেই সন্দেহ ছিলো ন। এবং এখনও এ রকম সন্দেহ পোষণ করার অসংখ্য কারণ দেখতে পাচ্ছিলাম। তাদের আসল মতলব ছিলো এ অঞ্চলের স্বাধীনতাকে বিকিয়ে দেওয়া এবং এই অভিযানে বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিলো একটা হাতিয়ার মাত্র। অথচ আশ্চর্য যারা একদিকে মাঠে ময়দানে ”৪৭ সালের ভারত বিভাগের নিন্দা করতেন তারাই সেজে ছিলেন বাংলা ভাযার সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে দরদী পৃষ্ঠপোষক। দুঃখ্যের বিষয় তরুণ-ছাত্র জনতা এ দুই মনোভাবের অসঙ্গতি ধরতে পারেনি। আর পারার কথাও ছিলো না। পাকিস্তান আমলের তথাকথিত উৎপীড়ন কাহিনী এমনভাবে পল্লবিত করে এদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছিল যে অন্য কোনো কথা ভাববার অবকাশ এদের ছিল না। এই তরুণদের নিয়ে আপসোস করা যেতো কিন্তু বয়স্ক লোক যারা জেনেশুনে অনবরত মিথ্যা প্রচার করে যেতো তারা বিবেকের কাছে কি জবাব দিয়েছে সে তারাই জানে।
১৯৭৪ সালে প্রকাশ্যে এ সমস্ত প্রশ্ন তুলবার অধিকার আমাদের ছিলো না। কিন্তু স্বাধীনতার নামে ”৭১ সালে যা অর্জিত হয়েছিলো সেটা যে চরম ভারতীয় দাসত্ব তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। চারদিকে ছিলো ধ্বংসস্তুপ, বিপর্যস্ত অর্থনীতির দৃশ্য। অথচ নতুন সরকার অনবরত বলে বেড়িয়েছেন যে পুঁজি নিয়োগের এমন সুবর্ণ সুযোগ আর কখনো হয়নি। কোনো পুঁজিপতি পুঁজি নিয়োগ করতে এগিয়ে এসেছিলেন বলেও শুনিনি। ”৭৪ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়া ও মিশর ব্যতিরেকে আর কোনো মুসলিম দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করেনি। পাকিস্তান তো নয়ই। ঐ সালে লাহোরে একটি ইসলামিক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। তখন আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুমেদিয়ান ঢাকা এসে শেখ মুজিবুর রহমানকে ঐ সম্মেলনে যোগ দিতে সম্মত করান এবং তাঁকে তার প্লেনেই লাহোর নিয়ে যান। সেখানে ভুট্টো আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের কথা ঘোষণা করেন। বুমেদিয়ান মুজিবুর রহমান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোকে কি বলেছিলেন তা আমরা জানি না কিন্তু রাজনৈতি পরিবর্তন সত্ত্বেও বাংলাদেশ যে ইসলামী জগতের অংশই যে রয়ে গেছে মুজিবুর রহমান তা স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। জনগণের মধ্যেও এ নিয়ে বিভ্রান্তির শেষ ছিলো না। একদিকে তাদের অনবরত বুঝানো হচ্ছিলো যে কাজ-কর্মে চিন্তায় স্বপ্নে-আদর্শে তাদের বাঙালী হতে হবে। তখনো বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের কথা কেউ বলতে সাহস পায়নি অন্যদিকে পূর্ব বঙ্গের মুসলিম অধ্যূষিত অঞ্চলে এই বাঙালীত্বের স্বরূপ কি দাড়াবে তা কেউ বলতে পারছিলেন না বা বলতে সাহস পাচ্ছিলেন না বা এ সম্বন্ধে গভীরভাবে ভেবে দেখবার শিক্ষাও তাঁদের ছিলো না। তারা একদিকে প্রচার করতো যে ছিটেফৌঢী দু”এক ব্যক্তিকে বাদ দিলে বাংলার মুসলমান নাকি সব হিন্দু বংশোদ্ভুত। সুতরাং নতুন পরিবেশে তাদের মুসলমান পরিচয় ত্যাগ করলে তাদের হিন্দু ধর্মে পুনঃ প্রবেশ শুধু বাঞ্ছনীয় নয়, অত্যাবশ্যক হয়ে দাড়ায়। একে তো হিন্দু ধর্মে কেউ নতুনভাবে দীক্ষা গ্রহণ করতে পারেনা। অন্যদিকে কয়েক শতাব্দী ধরে এই মুসলমান সমাজ যে জীবন ধারা অনুসরণ করে এসেছে সেটার বিকল্প কি হতে পারে এই নেতারা তা বলতে পারছিলেন না। এদের মধ্যে কেউ কেউ এমন ছিলেন যারা সম্ভব হলে নাম পাল্টিয়ে কপালে তিলক লাগিয়ে হিন্দু হতে পারলে গৌরববোধ করতেন। কেউ কেউ অবশ্য ছেলেমেয়েদের হিন্দুর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে নিজেদের বাঙ্গালীত্বের প্রমাণ দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে এরা কোন সমাজেই স্থান পাচ্ছেন না। আর অশিক্ষিত জনসমাজের কথা তো আলাদা। শহরে বসে দু-এক ব্যক্তি যা করেছেন, গ্রামের সমাজে তা কোন কালেই সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এটা শুধু নিছক সাধারণ অর্থে ধর্মীয় ব্যাপার নয়। আচার-ব্যবহারে, নৈতিক আদর্শে দুই সমাজের মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টি করা একটা অসম্ভব ব্যাপার। তার অর্থ এই নয় যে হিন্দু-মুসলমান প্রতিবেশী হিসাবে বাস করতে পারে না। বহু শতাব্দী ধরেই তারা এভাবে বসবাস করছিলো। এবং একটা দুরত্ব রক্ষা করে তারা চলছিল। কিন্তু এখন শুনলাম এ দূরত্ব রক্ষা করার প্রয়োজন একেবারেই নেই। সুতরাং জিন্নাহ হলকে সূর্যসেন হলে পরিবর্তন করে এরা দেখাতে চেয়েছিলেন যে সূর্য সেনের মতো ব্যক্তিরাই আমাদের আসল হিতাকাংক্ষী। আর নওয়াব সলিমুল্লা, এ কে ফজলুল হক, মওলানা আকরাম খাঁ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমূখ যারা মুসলিম স্বার্থ সংরক্ষণের কথা বলতেন তারা ছিলেন আমাদের সমাজের পরম শত্রু। তবে একথা স্বীকার করতে কেউ সাহস পায়নি যে আমাদের মিত্রদের পরামর্শ মতো চলতে গেলে, পাকিস্তানের কথা ছেড়েই দিচ্ছি, ঢাকা ইউনিভার্সিটির কোনো প্রয়োজন হতো না। আমরা কৃষক গাড়োয়ান এবং দর্জী হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারতাম। জেল থেকে বেরিয়ে আরো একটা অদ্ভুত কথা শুনতে পেলাম। শেখ মুজিব নিজে এবং তার দলের লোকজন দাবী করতে শুরু করলো যে পাকিস্তানের কাছে তাদের পাওনা অনেক কিছু। ঢাকা, চাটগাঁও, খুলনা, রাজশাহী, ঈশ্বরদী, রংপুর প্রভৃতি এলাকায় উর্দূভাষীদের সম্পত্তি যা কিছু ছিলো তাতো দখল করে নেওয়া হলো। কিন্তু তার উপর তার স্বরে চিৎকার করে বলা হলো যে করাচীতে, ইসলামাবাদে, লাহারে বাঙালীরা অনেক সম্পত্তি ফেলে এসেছে যে জন্য পাকিস্তানকে খেসারত দিতে হবে। পাকিস্তান বিমান বাহিনী এবং নৌ-বাহিনীর জাহাজ দাবী করা হলো। এ রকম আরো দাবী তখন উঠেছিল যে আলোচনা করা সম্ভব হতো যদি লেখাপড়া করে একটা যুক্তি মারফত পূর্ব পাকিস্তান, পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো। যেমন হয়েছিলো ১৯৪৭ সালে। পাকিস্তান এবং ইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠিত হয় বৃঢিশ পার্লামেন্টে গৃহীত একটি আইনের আওতায়। পাকিস্তান যদি লড়াই করে ইন্ডিয়া থেকে বেড়িয়ে আসতো, আইনের চোখে তার কোন দাবীই তো গ্রাহ্য হতো না। আইন করে বেড়িয়ে এসেও পাকিস্তান তার প্রাপ্য বিশেষ কিছুই পায়নি। পার্টিশন কাউন্সিল ইন্ডিয়ার সৈন্য বাহিনীর যে সমস্ত মালামাল পাকিস্তানকে দিতে বলেছিলেন নেহেরু সরকার তার কিছুই হাতছাড়া করেন নি। বরঞ্চ পাকিস্তানের প্রাপ্য ৯০ কোটি টাকাও আটক করে পাকিস্তানের শ্বাস রোধ করার চেষ্টা করেছেন। ওয়েস্ট বেঙ্গলের নতুন চিফ মিনিস্টার বিধান চন্দ্র রায় ঘোষণা করলেন যে পূর্ব বঙ্গে সরকারী সম্পত্তি কি আছে তার হিসাব না হওয়া পর্যন্ত কোলকাতা থেকে তিনি এক কপর্দক পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কাছে হস্তান্তর করবেন না। যদি নতুন বাংলাদেশ সরকার সেই পুরানো দাবী আদায়ের চেষ্টা করতো বুঝতাম যে তারা সত্যই দেশের হিতাকাংক্ষী কিন্তু ও প্রসঙ্গ কেউ তুললো না। শুধু শুনলাম যে অত্যাচারী পাকিস্তানীরা ন্যায্য পাওনা দিচ্ছে না। এ সমস্ত উক্তির মধ্যে যুক্তির কোনো বালাই ছিল না। শুধু তরুণ সমাজকে উত্তেজিত করে রাখার একটা চেষ্টা হচ্ছিলো। যুদ্ধ করে যে অঞ্চল বিচ্ছিন্ন হয়েছে সে কথা কেউ আর এ প্রসঙ্গে তুললেন না। আমেরিকা, এককালে বৃটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিলো। যারা আমেরিকার স্বাধীনতার ইতিহাস জানেন তাদের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে যে জর্জ ওয়াশিংটন বৃটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা লাভ করেন। আমেরিকার সঙ্গে বহুদিন পর্যন্ত ইংল্যান্ডের সদ্ভাব ছিলো ন। তারা একবার স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে যুদ্ধ পর্যন্ত করেছে। ১৯৫৬ সালে আমি যখন আমেরিকা গেলাম তখন পূর্বাঞ্চলে কোন কোন এলাকা ইংরেজরা বিধ্বস্ত করেছিলো তা দেখানো হয়। খেসারতের প্রশ্ন কখনো ওঠেনি। আলজেরিয়া আট বছর যুদ্ধ করে ফ্রান্স থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। কিন্তু শেষ পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট দ্য গলের হস্তক্ষেপের ফলে একটা চুক্তির মারফত এই সংঘাতের অবসান ঘটে। সেজন্য এ ক্ষেত্রে লেনদেনের ব্যাপার নিয়েও একটা মীমাংসা হয়েছিলো। বাংলাদেশের নতুন নায়কেরা যে দাবী তুললেন সেটা আন্তর্জাতিক কোন আদালতে স্বীকৃতি পাবার সম্ভাবনা ছিলো না। সেজন্য এ প্রসঙ্গ কেউ উত্থাপন করেনি। শুধু ধমক দিয়ে আদায় করার চেষ্টা করেছে। আরো মজার কথা যে আনুষ্ঠানিকভাবে আগে যেমন পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্যের জিকির তুলে ছাত্রদের মনে পাকিস্তানের প্রতি একটা বিদ্বেষ সৃষ্টি করা হয়, এখনো তেমনি বলা হলো যে পাকিস্তান অন্যায়ভাবে বাংলাদেশের প্রাপ্য হিস্যা ছাড়ছে না। এটা ভবিষ্যতে যাতে এ দু”অঞ্চলের মধ্যে কোনো সদ্ভাবের সৃষ্টি না হয় তারই একটা কৌশল ছিল মাত্র। ৭৩-এর পরিবেশে যে অনুভূতিটা অনবরত টের পাচ্ছিলাম তার সঙ্গে রাষ্ট্র নায়কদের মনোভাবে সঙ্গতি ছিলো না। মন্ত্রীরা এবং আওয়ামী লীগ দল যতোই চিৎকার করুক সাধারণ লোকের মধ্যে ৭১ সাল সম্বন্ধে ছিল একটা অপরাধবোধ। রাগের মাথায় হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে লোকে যেমন অঘটন ঘটিয়ে পরক্ষণেই অনুতপ্ত হয়ে যায় তেমনি একটা ভাব লোকজনের কথাবার্তায় বুঝা যেতো। সঙ্গে সঙ্গে এরা বলতো যে পাকিস্তানীরা যদি ২৫শে মার্চ ওভাবে আমাদের উপর আক্রমণ না করতো তা হলে দেশটা রক্ষা পেতো। একটু শিক্ষা-দীক্ষা যাদের আছে তারাই ভারতের ভূমিকা সম্বন্ধে শংকিত হয়ে উঠেছিলো। হঠাৎ করে তারা যেনো উপলব্ধি করলো যে ভারত পরিবেষ্টিত হয়ে এ দেশে কখনো স্বাধীন হয়ে থাকতে পারবো না। দেশে এমন কোনো সম্পদ ছিলো না যার উপর নির্ভর করে সে স্বাবলম্বী হতে পারে। আশ্চর্য হলাম যখন শুনলাম যে কেউ কেউ বলতে শুরু করেছে যে পিন্ডির জায়গায় আমরা শুধু দিল্লীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেছি। এ সব আলোচনা-চুপ করে শুনেছি কিন্তু দেশের আবহাওয়া যে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছিলো এছিলো তারই প্রমাণ। এ দিকে দেশের শিল্প-কারখানার যে অবস্থা তাতে উৎপাদন কিছুই হতো না বলে বাজার ছেয়ে গিয়েছিলো ইন্ডিয়ান পণ্যে। তখন থেকেই ইন্ডিয়ান শাড়ী বাজারে শস্তায় চালু হয়। এই প্রতিযোগিতায় আমাদের টিকে থাকবার উপায় ছিল না। কারণ জাতীয়তাবাদ দিয়ে পলিটিক্স করা যায় কিন্তু ক্রেতা হিসাবে একজন লোক যখন বাজারে যায় সে সুলভ পণ্যের সন্ধান করে। জাতীয়তাবাদী হয়ে সে শস্তা জিনিস বাদ দিয়ে চড়া দরে কোনো জিনিস কিনবে না। পাকিস্তান আমলে সরকারী নীতির ফলে দেশী কলকারখানাগুলি যে প্রটেকশন পেয়েছে শেখ মুজিব বন্ধু রাষ্ট্র ইন্ডিয়ার স্বার্থে সে প্রোটেকশন তুলে নিলেন। বাজারে এলো ইন্ডিয়ান পণ্যের প্লাবন। আমরাও বাধ্য হয়ে এ সমস্ত জিনিস ব্যবহার করেছি। কারণ উপায় ছিলো না। সবচেয়ে ব্যথা পেতাম যখন পুরানো সরকারী কর্মচারীদের বিরুদ্ধে নানা উদ্ভট অভিযোগ। তারা নিজেরা যে সমস্ত দফতরের পরিচালনা করতেন, যেখানে নীতি প্রণয়নেরও স্বাধীনতা তাঁদের ছিলো, এখন তাঁরাই তাদেঁর অকর্মণ্যতা ঢাকবার জন্য বলতে শুরু করলেন যে পাকিস্তানীদের দৌরাত্ম্যে তারা জেনে শুনেও এ অঞ্চলের স্বার্থ রক্ষা করতে পারেননি। যারা ভিতরের খবর জানে না তাদের কাছে এ সমস্ত যুক্তি খুব গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো যে এ অঞ্চলের মিনিষ্টার বা সেক্রেটারী কেন এ প্রশ্ন তুলে আগে প্রতিবাদ করেননি? কাউকে তো পদত্যাগ করতেও শুনিনি। অপর পক্ষে উচ্চপদ লাভ করলেই তারা কেন্দ্রীয় সরকারের গুণগান করতে ক্রটি করেনি। এই মোনাফেকী কি আমাদের চরিত্রেরই একটা বৈশিষ্ট্য? আওয়ামী লীগের তরফ থেকে যখন আঞ্চলিক বৈষম্যের ধুয়া তোলা হয় তখন সরকারী কর্মচারী একদিকে যেমন গোপনে শেখ মুজিবুর রহমানকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে উৎসাহিত করেছেন, অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সরকারকে বুঝিয়েছেন যে এ সমস্ত মিথ্যা চিৎকার নিয়ে আতঙ্কিত হবার কারণ নেই। এই কারণে কেন্দ্রীয় সরকারও টের পাননি যে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক অসন্তোষ কিভাবে ধুমায়িত হচ্ছে। আইয়ুব খান যখন তার ওয়ার্ক্স প্রোগ্রাম প্রর্বতন করেন তখন সরকারী কর্মচারী ও ইউনিভার্সিটি শিক্ষকের মুখে এর প্রচুর প্রশংসা শুনেছি। আবার সত্তর সালে এরাই বলেছিলেন যে ওয়ার্ক্স প্রোগ্রামের দ্বারা দেশে কতগুলো টাউট সৃষ্টি করা হয়েছে। দেশের উন্নতি কিছুই হয়নি। এ রকমের অভিযোগ পাকিস্তান আমলে সব কিছুর বিরুদ্ধেই করা হতো। অথচ তেইশ বছর আগে যে পূর্ব বাংলা আমরা পেয়ে ছিলাম তার সঙ্গে সত্তর সালের পূর্ব পাকিস্তানের চেহারার তুলনা করলে যে বিরাট ব্যবধান চোখে পড়ে সে কথাটা এখন অস্বীকার করা হচ্ছিলো। রাস্তাঘাটে, কল-কারখানা, বন্দর উন্নয়নমূলক কর্মসূচীতে পূর্ব পাকিস্তানের কৃষক-মজুর, শিক্ষক-উকিল, ব্যবসায়ী কেউ নাকি উপকৃত হয়নি। আশ্চর্য, তখন যে ক”টি পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হতো তারা সমস্বরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে একই অভিযোগ উচ্চারণ করে গেছে। একদিকে এরা অভিযোগ করতো কেন্দ্রীয় সরকারের অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন নাকি বিঘ্নিত হয়েছিলো। অন্যদিকে এরা কেন্দ্রের নিষ্ক্রিয়তার কথা বলতো। কোন উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা এ অঞ্চল থেকে স্বতঃষ্ফুর্তভাবে প্রস্তূত হয়েছে বলে আমি শুনিনি। একদিকে ছিলো কেন্দ্রের উপর এবং অবাঙ্গালী অফিসারদের উপর নির্ভরশীলতা, অন্যদিকে কোনো ভুল-ভ্রান্তি হলেই বলা হতো যে পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চাদপদ করে রাখার ওটা একটা চক্রান্ত।
পূর্ব পাকিস্তানে বৃটিশ যুগের অবস্থা
যখন ”৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় তখন আমার বয়স ২৭। এমন অর্বাচীন তরুণ ছিলাম না যে কি হচ্ছে তার তাৎপর্য একেবারেই বুঝবার ক্ষমতা ছিলো না। যিন্তু ”৪৭ থেকে ”৭১ পর্যন্ত তেইশ বছরের যে ইতিহাস তার মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রমুখ রাজনীতিবিদদের মুখে একথা একবারও শুনিনি যে নতুন রাষ্ট্রকে লালন করে টিকিয়ে রাখবার পর অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানের উপযুক্ত ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে। একে ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আতাউর রহমান খান, আবু হোসেন সরকার প্রমূখ ব্যক্তি যাঁরা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে শীর্ষস্থানীয় ছিলেন তাঁরা সবাই বিভিন্ন সময়ে সরকারী ক্ষমতা ভোগ করেছেন, কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত হওয়া মাত্রই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক উক্তি করতে এদের দ্বিধা হয়নি। হামিদুল হক চৌধুরীর কথা আমি আগে উল্লেখ করেছি। এদের সবার মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির একটা সংকীর্ণতা ছিলো। কেউ যেনো বুঝতে চেষ্টা করতেন না যে, যে অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয়েছিলো তার পরিবর্তন ঘটাতে হলে নতুন রাষ্ট্রের কাঠামোকে মজবুত করাই হবে সবচেয়ে বড় কর্তব্য। তাঁরা এমন ভাব দেখিয়েছেন যে সামগ্রিক ভাবে পাকিস্তান রক্ষার দায়িত্ব হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের। আমাদের কোন দায়িত্ব নেই, আছে শুধু অধিকার। একদিকে দাবী করেছি যে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ অন্যদিকে সংখ্যা লঘিষ্ঠের মত সাহায্য চেয়েছি। সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে সংখ্যালঘিষ্ঠের কাছে দাবী দাওয়া পেশ করার এই নজীর অন্য দেশের ইতিহাসে বিরল। ১৯৪৭ সালের যে গণপরিষদ গঠিত হয় তার সদস্য সংখ্যার মধ্যেও পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিলো। এ কথা সত্য যে উপযুক্ত লোকের অভাব এ অঞ্চলে ছিলো বলে লিয়াকত আলী খানের মত কয়েকজন মোহাজেরকে এই অঞ্চলের কোটা থেকে নির্বাচন করা হয়েছিলো। কিন্তু বাঙালীদের সংখ্যাই ছিলো বেশী। তবুও কেন্দ্রীয় পরিষদে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যে ভূমিকা আমাদের পালন করার কথা, তা আমরা করতে পারিনি। যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতার অভাবে। বলা হয়ে থাকে যে কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্র এবং মিলিটারীতে পূর্ব পাকিস্তানের যথোপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব না থাকার কারণে আমাদের রাজনীতিকরা অসহায়বোধ করতেন। এটা তাদের ব্যর্থতা এবং অকর্মণ্যতা ঢাকবার একটা অজুহাত মাত্র। কারণ গোলাম মোহাম্মদ গভর্নর জেনারেল হিসাবে গণপরিষদে হস্তক্ষেপ করার আগে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই দেশের কাজকর্ম পরিচালিত হয়েছে। আমলারা এবং মিলিটারী অফিসাররা প্রাইম মিনিস্টার এবং মিনিস্টারদের হুকুম মেনে চলতেন। কায়েদে আজমের মৃত্যূর পর পূর্ব পাকিস্তানের খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। লিয়াকত আলী হত্যার পর তিনি আবার প্রাইম মিনিস্টারের পদ গ্রহণ করেছিলেন। এরপর শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং বগুড়ার মোহাম্মদ আলী ঐ পদ কিছুকালের জন্য অধিকার করেছিলেন। শুনেছি যে ব্যক্তিগতভাবে শহীদ সোহরাওয়ার্দী জাঁদরেল লোক ছিলেন। কোন আমলার কাছে ভীত হওয়ার কোনো কারণ তাঁর ছিল না। শিক্ষা, যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা কোন দিক থেকেই। কিন্তু পদচ্যূত হলে এরা যে সমস্ত আষ্ফালন করতেন পদে অধিষ্ঠিত থেকে একথা কখনো বলেননি যে কেনো পূর্ব পাকিস্তান আরো বেশী সুবিধা পাচ্ছেনা। বরঞ্চ, আগেই উল্লেখ করেছি যে প্রাইম মিনিস্টার হিসাবে শহীদ সোহরাওয়ার্দী সলিমুল্লা মুসলিম হলে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তান স্বায়ত্তশাসনের ৯৮ ভাগ ভোগ করছে। এ সমস্ত কথার অর্থ কি তা একাত্তর সালের বিষ্ফোরণের পর বুঝবার উপায় ছিলো না। হয় বলতে হয় যে শহীদ সাহেব আগাগোড়া মিথ্যা কথা বলে গেছেন- যা বিশ্বাস করা শক্ত। অথবা বলতে হয় যে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানকে খতম করার উদ্দেশ্যেই এ সমস্ত অভিযোগ তুলেছিলো। আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে আমরা পাঞ্জাবের তুলনায় পশ্চাদপদ ছিলাম না তা নয়। এই পশ্চাদপদতার কারণ ১৭৫৭ সালের পরবর্তী ইতিহাস। বৃটিশ আমলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক নিষ্পেষণ এবং বঞ্চনার কারণেই পাকিস্তান আন্দোলনে আমরা সবচেয়ে বেশী সাড়া দিয়েছিলাম। আমাদের আশা ছিলো যে বর্ণ হিন্দুদের বেষ্টন থেকে মুক্ত হতে পারলে আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার পুনরুদ্ধার করতে পারবো। এবং সেই প্রক্রিয়া যে তেইশ বছরে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিলো সে সম্বন্ধে আমার মনে কোনো সংশয় ছিলো না। বৃটিশ আমলে বাংলায় বর্ণ হিন্দুর আধিপত্যের দু-একটা উদাহরণ হয়তো এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। বেঙ্গল লেজিসলেচারে স্যার আব্দুর রহীম প্রমুখ সদস্যদের প্রতিবাদের মুখে একবার এমন একটা আইন পাশ হয় যার ফলে বাংলার মুসলমান প্রজারা আরো বেশী করে হিন্দু জমিদারদের খপ্পরে পড়ে। আইনে অবশ্য হিন্দু-মুসলমানের কথা উল্লেখ ছিলো না। কিন্তু সবাই জানতো যে বাংলার অধিকাংশ জমিদার যেমন হিন্দু তেমনি অধিকাংশ প্রজা ছিলো মুসলমান। আরো আশ্চর্যের কথা এই বিবর্তনমূলক আইনটি পাশ হয় তথাকথিত জনদরদী ”কংগ্রেস” দলের সমর্থনে। যেখানে হিন্দু স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সেখানে কংগ্রেস তার রূপ সহজেই বদলিয়ে ফেলতো। আরেকটি ঘটনা হলো, সেকেন্ডারী এডুকেশন বিল প্রত্যাহারের ঘটনা। ১৯৩৭ সালে যে ফজলুল হক মন্ত্রিসভা গঠিত হয় তারা মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ কোলকাতা ইউনিভার্সিটির হাত থেকে সরিয়ে নিয়ে একটি মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের উপর অর্পণ করতে চেয়েছিলেন। প্রস্তাবটি ছিলো সর্বতোভাবে যুক্তি সঙ্গত এবং যে সমস্ত হিন্দু তখন এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন তারাই পশ্চিম বাংলায়ও মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড স্থাপন করেন। কিন্তু ফজলুল হক সাহেবের মুসলিম লীগ মিনিস্ট্রি যখন প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন তখন তার অর্থ করা হলো যে মুসলিম লীগ কোলকাতা ইউনিভার্সিটির স্বার্থে আঘাত হানার চেষ্টা করছে। কংগ্রেস সদস্যরা এমন প্রচন্ড আন্দোলন শুরু করলেন যে বাধ্য হয়ে হক সাহেবকে প্রস্তাবটিকে পরিত্যাগ করতে হয়, অথচ এই নগ্ন সাম্প্রদায়িকতার নিন্দা করতে পরবর্তী কালে আওয়ামী লীগকেও শুনিনি। আমি এখানে দু”টি উদাহরণ দিলাম মাত্র। এরকমের ঘটনা অহরহ ঘটতো এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও মুসলমানরা চাকরী-বাকরীতে ব্যবসা-বাণিজ্যে সংখ্যালঘু হয়ে ছিলো। একবার ফজলুল হক সাহেবের মন্ত্রী সভার আমলে চাকরীতে মুসলমানদের অনুপাত বৃদ্ধি করার প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে করা হয়। বলা বাহুল্য, প্রবল আপত্তি উঠে। বলা হয় যে সাম্প্রদায়িক অনুপাত সংশোধন করার অজুহাতে কতগুলি ”ইনএফিশিয়েন্ট” বা অদক্ষ লোকদের চাকরী দিলে প্রশাসনের মানের অবনতি ঘটবে। এর প্রতি উত্তরে ফজলুল হক সাহেব ইংরাজীতে এফিশিয়েন্সী সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ বা বিবৃতি প্রকাশ করেন। তাতে তিনি লিখেছিলেন যে একজন আমলার জন্য এফিশিয়েন্সীর অর্থ বিশ্বাস যোগ্যতাও বটে। অর্থাৎ যে কর্মচারীর উপর সামাজিক কারণে জনসাধারণের পরিপূর্ণ আস্থা নেই তার পক্ষে সুচারুভাবে তার কর্তব্য সম্পন্ন করা দুরূহ। তিনি বললেন এই কারণে চাকরীতে মুসলমানের অনুপাত করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বাংলার জনসাধারণের অধিকাংশই মুসলমান। তাদের আপন সম্প্রদায়ের আমলার উপর তারা যতটা ভরসা করতে পারে ততটা কোন ইংরেজ বা হিন্দু অফিসারের উপর সম্ভব নয়। যাক, আমি বলছিলাম কেনো আমরা এ অঞ্চলে পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলাম সে কথা। অথচ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার অব্যবহিত পরই একদল আমাদের বুঝাতে লাগলেন যে আমরা কিছুই পাচ্ছিলাম না। শুধু নতুন বঞ্চনার শিকার হয়েছিলাম মাত্র। এ সমস্ত কথা যদি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার ১৫ বছর পর শুরু হতো তা হলে বুঝা যেতো যে ঐ ১৫ বছরে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের সমান হতে পারিনি বলেই ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে। কিন্তু আমার তো স্পষ্ট মনে আছে ৪৮-৪৯ সাল থেকেই এ অভিযোগের সূত্রপাত। তখনি শুরু হয় ভাষা আন্দোলন, শুরু হয় অবাঙ্গালী অফিসারদের বিরুদ্ধে জেহাদ, নবাগত বিহারী মোহাজেরদের প্রতি শক্রতা। আমি যে কথা বলছি তার মর্মার্থ হলো যে পাকিস্তানের পতন পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের বঞ্চনার কারণে হয়নি। এবং এ অঞ্চল পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে অগ্রগতির পথে সমস্ত বাধা অপসারিত হবে, বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সে কথা বিশ্বাস করতো বলে আমি মনে করি না। তারা ইন্ডিয়ার ইঙ্গিতেই এ আন্দোলন করেছিলো। একদিকে তারা নির্ভর করতো মিথ্যা প্রচারণার উপর অন্যদিকে সাধারণ ক্রটি-বিচ্যুতি, ভুল-ভ্রান্তি যা যেকোন দেশেই ঘটে তার সুযোগও তারা নিয়েছে। আমি আগে বলেছি যে পশ্চিম পাকিস্তানেও একদল ছিলো যারা পাকিস্তানের আদর্শের কথা বেমালুম ভুলে যেয়ে শুধু স্বার্থের কথা ভেবেছে এবং তাদের নির্বুদ্ধিতা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে ইন্ধন যুগিয়েছে। কিন্তু আসল প্রশ্ন হচ্ছে যারা এ সমস্ত অভিযোগ তুলে বিচ্ছিন্নতাবাদের বীজ বপন করে, পাকিস্তানের আদর্শ বাস্তবায়িত করার সদিচ্ছা এবং আগ্রহ তাদের কি কখনোই ছিলো? ১৯৪৭ সালের ৩রা জুনের ”মাউন্টব্যাটন প্ল্যান” যখন ঘোষিত হয় তখন একজন বৃটিশ সিভিলিয়ান টাইসন পূর্ব বঙ্গকে পাড়াগাঁয়ের বস্তি (রুরাল স্লাম) বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। বৃটিশ শাসনের থেকে উত্তরাধিকার হিসাবে এটাই আমাদের প্রাপ্য হলো। এই শাসনের প্রারম্ভকালে বৃটিশরা যেমন এ দেশের সম্পদ লুটে, এ দেশের মুসলমান সমাজকে ধ্বংস করে তাদের সাম্রাজ্যের পত্তন করেছিলেন এবং ইংল্যান্ডে এক নতুন বিত্তবান সমাজের উথানের পথ সুগম করেন, তেমনি এ দেশ থেকে বিদায় নেবার প্রাক্কালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়, ১৯৪৩ সালে তারা এক ভয়াবহ দূর্ভিক্ষ ঘটায়। সরকারী হিসাবে এই মন্বন্তরে ৩০ লক্ষ লোক প্রাণ হারিয়েছিলেন এবং সরকারী কমিশন বলেছিলো যে, এই দুর্ভিক্ষ ছিলো ম্যানমেড (কৃত্রিম)। এই বিধ্বস্ত অঞ্চলই ”৪৭ সালের ১৪ই অগষ্ট রুপান্তরিত হয়েছিলো স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানে। অথচ ৪৮ সাল থেকেই আবার শুনতে আরম্ভ করি যে আমাদের সমস্ত দুর্দশার কারণ করাচীস্থিত তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলা, উপেক্ষা এবং শোষণ। পাঞ্জাব বা সিন্ধু অঞ্চলে যেমন যুদ্ধের সময় কোনো দুর্ভিক্ষ হয়নি তেমনি ১৭৫৭ সাল থেকে উনিশ শতাব্দীর শেষ অবধি পর্যন্ত যে নির্যাতন বাংলার মুসলমানদেরকে সইতে হয়েছে তার নজির পশ্চিম পাকিস্তানের ইতিহাসে নেই। হান্টার সাহেবের সে বিখ্যাত বইয়ের কথা এখানে উল্লেখ করার হয়তো দরকার নেই। তিনি বলেছিলেন যে, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পূর্বে যারা ছিলেন বাংলার সম্ভ্রান্ত সমাজ তারাই পরিণত হলেন কাঠুরিয়া আর ভিস্তির শ্রেণীতে। আগে যেমন কোনো সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারের পক্ষে দারিদ্র্যের কবলে পতিত হওয়া অসস্তব ছিলো তেমনি ১৮৫৭-এর পর কারো পক্ষে স্বচ্ছলতা রক্ষা করাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এই তো হলো আমাদের ইতিহাস। উনিশ শতাব্দীতে বৃটিশ পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু সমাজে যে পুনর্জাগরণ বা রেনেসাঁস-এর সূত্রপাত হয়, যার প্রধান প্রতিনিধি হচ্ছেন মাইকেল মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র এবং ঠাকুর পরিবার সেই পুনর্জাগরণে মুসলমান সমাজের কোন ভূমিকা ছিল না এবং থাকবার কথাও নয়। এই বিধ্বস্ত সমাজকে নিয়ে ১৯৪৭ সালে আমাদের যাত্রা শুরু। ৪৩ সালে যে দুর্ভিক্ষের কথা একটু আগেই উল্লেখ করেছি তার ভয়াবহতার চিত্র আমার বয়সী কোনো লোকের মন থেকে মুছে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা ৭১ সালে ছিল না। জাপানীরা তখন বার্মা দখল করেছে। আরাকান পর্যন্ত থাবা বাড়িয়েছে। কোলকাতায় বোমা পড়ছে এবং যে কোনো মুহূর্তে তারা আসাম ও বাংলার একটা অংশ দখল করে নিতে পারে এই আশংকায় বৃটিশ সরকার পোড়ামাটি বা SCORCHED EARTH নীতি অবলম্বন করে। জেলে এবং কৃষকদের নৌকা ধ্বংস করে ফেলা হয়, ধ্বংস করা হয় খেত খামারের ফসল; একেতো তখন বার্মা থেকে চাল আমদানী বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো অন্য দিকে এ অঞ্চলে উৎপাদিত চাল সৈন্য বাহিনীর প্রয়োজনে ক্রয় করে উত্তর এবং মধ্য ভারতে চালান দেওয়া হয়। দুঃখের বিষয় এই প্রক্রিয়ায় কয়েকজন দুর্ণীতিপরায়ণ মুসলমান রাজনীতিবিদও জড়িত ছিলেন। মাড়োয়ারীদের সাথে জোগসাজশে এরা চাল পাচার করতেন। এ নিয়ে একটা মামলাও হয়। এই মামলার তথ্য উদঘাটন করতে গেলে এমন সব নাম আবিস্কৃত হবে যা শুনলে বর্তমান প্রজন্ম রীতিমত আঁৎকে উঠবে। কারণ এরা এদের পরম শ্রদ্ধেয় জাতীয় বীর হিসাবে চেনে। যাক সে সব কথা। তখন যুদ্ধের সময় সেন্সরশীপের কারণে দুর্ভিক্ষ কথাটা সংবাদপত্রে নিষিদ্ধ ছিল। এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন কোলকাতা স্টেটসম্যান পত্রিকার সম্পাদক ইয়ান স্টিফেন্স। তিনি এ সম্বন্ধে অনেকগুলো সম্পাদকীয় নিব্ন্ধ লিখে বাংলার অবস্থার দিকে দিল্লীর সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁর একটা মন্তব্য আমার এখনো মনে আছে। বলেছিলেন সুদূর দিল্লীতে মোটা মোটা (ফ্যাট) পান্জাবী অফিসারদের মধ্যে পরিবৃত্ত থেকে বৃটিশ সরকারের পক্ষে বাংলার দুর্ভিক্ষের নিষ্ঠুরতার অনুধাবন করা সম্ভব নয়। এ সমস্ত আলোচনার একটা সুফল দেখা দেয়। নতুন বড় লাট লর্ড ওয়েভল কোলকাতা আসেন স্বচক্ষে এই দুর্ভাগা প্রদেশের হালহকিকত দেখতে। স্টিফেন্স সাহেবের সে সময়কার প্রবন্ধগুলো আমার কাছে এখনও রক্ষিত আছে। ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় তখনো আমরা দুর্ভিক্ষের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সেই দুর্ভিক্ষের সময় প্রবর্তিত রেশনিং প্রথা ৪৭ সালের পরও চালু ছিল। কিন্তু ৪৭ এর আগস্টের পর ৭১ সাল পর্যন্ত অভাব অভিযোগ হলেও ব্যপক দুর্ভিক্ষ পূর্ব পাকিস্তানের কোন এলাকায়ও হয়নি। একবার বোধ হয় ৫০ সালে কয়েক দিনের জন্য একটা লবণ সংকট দেখা দিয়েছিল। কিন্তু এই সংকট কোন জীবন নাশের কারণ হয়নি এবং মাত্র কয়েকদিন স্থায়ী হয়েছিল।
(বইটির pdf version download করুন এখানে)