উপসংহার
পাকিস্তানে পাটকল, সুতার কল, টেক্সটাইল মিল ইত্যাদি যা প্রতিষ্ঠিত হয় সেটা নাকি শুধু বঞ্চনা এবং শোষণের প্রমাণ। পাকিস্তান আমলেই এ অঞ্চলে গ্যাস আবিষ্কৃত হয়। গ্যাস তো হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নি। বহু শতাব্দী ধরে মাটির নীচে মওজুদ ছিলো। কিন্তু বৃটিশ আমলে কখনোই পূর্ব বাংলায় গ্যাসের অনুসন্ধান করা হয়নি। পাকিস্তানে প্রথম গ্যাস আবিস্কৃত হয় সিন্ধুর সুই এলাকায়। তার অব্যবহিত পরে হরিপুর এবং বাখরাবাদে গাসের সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু এ তথ্যের মূল্যায়ন আওয়ামী লীগের কাছে পাইনি।
আগাগোড়াই বলা হয়েছে যে পাকিস্তান আমলে আমাদের ইতিহাস ছিলো শুধু বঞ্চনার ইতিহাস; কেন্দ্রীয় শাসনকর্তারা এ অঞ্চলটাকে যথাসম্ভব অনুন্নত রাখবার চেষ্টা করতেন। ”৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হবার পর সমাজবিজ্ঞান বিভাগের মিঃ হাসিব আমার সামনে তাঁর বৃটিশ স্ত্রীকে বলেন, এ অঞ্চলটা পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য হচ্ছে শুধু কাঁচামাল সরবরাহের কেন্দ্র। ঐ ভদ্র মহিলা প্রশ্ন করেছিলেন এ বিদ্রোহ কেন হচ্ছে? কৌতুকের কথা আমি জেল থেকে বেরুবার পর মিঃ হাসিব একদিন ঢাকায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। পরনে একটা পুরানো লুঙ্গি, গায়ে ময়লা শার্ট, পায়ে ছেঁড়া স্যান্ডেল এবং হাতে একটা ভাঙ্গা ছাতা। আমি বললাম, আপনার এ অবস্থা কেনো? জবাব দিলেন, আমি এই মাত্র রমনা মাঠ থেকে শেখ মুজিবের বক্তৃতা শুনে এলাম। জনসাধারণের সঙ্গে যাতে অবাধে মিশে থাকতে পারি তাই এই লেবাস পড়ে মিটিং-এ গিয়েছিলাম। কেউ আমাকে শিক্ষিত বলে ঠাওরাতে পারেনি। আমার সামনে ওরা নির্বিঘ্নে কথাবার্তা বলেছে। তিনি বললেন, আমি লক্ষ্য করলাম যে মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে এ দু”বছরের মধ্যেই একটা চাপা ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। আমি যেভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে ভেবেছিলাম যে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে এ অঞ্চলে সুখ-শান্তি ফিরে আসবে, অথচ দেখছি যে আমাদের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দুর্দশা শত গুণে বেড়ে গেছে। তেমনি সমাজ বিজ্ঞানী হিসাবে লক্ষ্য করলমে, জনসাধারণের মধ্যেও এই বিশ্বাস জন্মেছে যে ইন্ডিয়ার দালালরা তাদের ঠকিয়েছে।
হাসিব সাহেব কিছুকাল পর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। তাঁর বিদেশী স্ত্রী দু”টি মেয়ে নিয়ে বৃটেনে থেকে গেছেন। উনি বেঁচে থাকলে তাঁর প্রতিক্রিয়া আরো তীব্র রূপ ধারণ করতো বলে আমার বিশ্বাস। যাক, আসল কথায় ফিরে আসা যাক। যে মিথ্যা ইতিহাস রচনা করে পাকিস্তানের আদর্শের বিরুদ্ধে এ দেশের যুব সমাজকে ক্ষেপিয়ে তোলা হয়েছিলো সেটাই হলো পাকিস্তানের পতনের কারণ। শোষণ, অত্যাচার, গণতন্ত্রের অভাব এগুলি ছিলো নিছক ধুয়া। আমি আগেই বলেছি যে এই অভিযান শুরু হয় পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই। সুতরাং পাকিস্তানে যা কিছু ঘটেছে তার বিচার আমরা করেছি জন্ডিস রোগাক্রান্ত চোখ দিয়ে। উন্নয়ন যা হয়েছে প্রথম থেকেই বলা হতো যে প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিলো একান্তই অপর্যাপ্ত। যেনো দু”তিন বছরের মধ্যেই আমরা আমরা আগেকার দুশ বছরের অনগ্রসরতা অতিক্রম করে পাঞ্জাবের সমান হতে পারি। দেশ গড়তে যে সময় লাগে বিশেষ করে একটা উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে না উঠলে যে এ অঞ্চলের পক্ষে সমগ্রিকভাবে পাঞ্জাবের মোকাবেলা করা সম্ভব ছিলো না সে কথা ভুলেই বসেছিরাম বা সে কথা চাপা দেয়া হচ্ছিলো যেনো অল্প শিক্ষিত একজন কবিরাজকে মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপালের পদে বসিয়ে দিলে তিনি সুচারু রূপে তাঁর দায়িত্ব নিষ্পন্ন করতে পারবেন। কিন্তু এই নীতি ক্রমশঃ সিভিল সার্ভিসে, ইউনিভার্সিটিতে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অনুসৃত হাত থাকে। পূর্ব পাকিস্তানবাসীরা পদ অনেকগুলি পেলেন কিন্তু যে অভিজ্ঞতা এবং যোগ্যতা থাকলে তাঁরা পুরানো আইসিএস অফিসারদের সমকক্ষ হতে পারতেন, সেটা ছিলো কোথায়?
আইয়ুব খানের আমলে এক পর্যায়ে যখন এ অভিযোগ প্রবল হয়ে দাঁড়ায় যে অবাঙালী অফিসারদের দিয়ে এ অঞ্চল সুচারুভাবে শাসন করা যাবে না তখন স্থির করা হয় যে বাঙালী অফিসারদের পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে আনা হবে এবং এখানে অবাঙালী যাঁরা ছিলেন তাদের পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরিত করা হবে। এটা করা হয়েছিলো আওয়ামী লীগ সমর্থিত জনমতের চাপে। কিন্তু এই নীতি গ্রহণ করে বিচ্ছিন্নতার বীজ আরো ভালো করে যেনো রোপণ করা হয়। ৬৯-৭০ সালের দিকে প্রশাসনিক দিক থেকেও চিফ সেক্রেটারী থেকে শুরু করে সব দপ্তরে প্রধান আমলা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানবাসী কোনো ব্যক্তি। এঁদের মধ্যে প্রথমে যে ব্যক্তি এ অঞ্চলের চিফ সেক্রেটারী হন তিনি ছিলেন কাজী আনোয়ারুল হক।
কথা হলো যে এ অঞ্চলের প্রশাসনিক দায়িত্ব অবাঙালী অফিসারদের উপর ন্যস্ত বলে আমাদের অনগ্রসরতা কাটছে না- এ অভিযোগ খন্ডন করার জন্যই আইয়ুব খান এ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কিন্তু তাতে অভিযোগ খন্ডানো যায়নি। কারণ অভিযোগের উদ্দেশ্য ছিলো তো অন্যকিছু। ”৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের পর আওয়ামী লীগ নেতারা নিজেরাই স্বীকার করলেন যে, পাকিস্তানকে ঘায়েল করার জন্য তারা বিভিন্ন পর্যায়ে নানা কৌশল অবলম্বন করেছিলেন।
আমি মাঝে মাঝে ভেবেছি যে ”৪৭ সাল থেকেই যদি কেন্দ্রীয় সরকার এ অঞ্চলে কোনো হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন তার ফলও অন্যরূপ হতো না। তখন হয়তো বলা হতো আমরা যে নৈতিক সাহায্য আশা করছিলাম তা পাচ্ছি না বলেই আমাদের কিছু হচ্ছে না। যদি ধরে নেয়া যায় যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী এখানে মোতায়েন না করা হতো, অবাঙালী কোনো আইসিএস অফিসারকে এখানে কোনো দায়িত্বে নিয়োগ না করা হতো তবে এ অঞ্চল কি অতিদ্রুত কয়েক মাসের মধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানের সমকক্ষ হয়ে উঠতো? ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু ৫০ সাল পর্যন্ত তিনবার পুলিশ এ্যাকশন করে পূর্ব পাকিস্তান দখলের পরিকল্পনা করেছিলেন। এ তথ্য ফাঁস করে দিয়েছেন নিরদ চৌধুরী। এক পর্যায়ে জয় প্রকাশ নারায়ণের মতো ব্যক্তিও সৈন্য ঢুকিয়ে পূর্ব পাকিস্তান গ্রাস করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের অংশ ছিলাম বলেই এসব দুর্ঘটনা ঘটেনি। আর যদি পাকিস্তান আর্মি এখানে না থাকতো ইন্ডিয়ান আক্রমণের বিরুদ্ধে এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকার মতো সামরিক শক্তি তো আমাদের ছিলো না। তবুও শুনলাম যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীও ২৩ বছর এ অঞ্চলটাকে শুষে খেয়েছে।
যাঁরা বিচ্ছিন্নতাবাদকে সমর্থন করতেন তাঁরা ছিলেন দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। এক শ্রেণী ছিলেন মরহুম আবুল হাশেম এবং মরহুম আবুল মনসুর আহমদের মতো। তাঁরা দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাস করতেন কিন্তু অত্যন্ত অবাস্তবভাবে এ বিশ্বাসও পোষণ করতেন যে প্রথম থেকেই এ অঞ্চলটাকে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া উচিত ছিলো। এ অঞ্চলের জনসম্পদ সামরিক শক্তি, অর্থনৈতিক অবস্থান এ সবদিকে তাঁরা ভ্রুক্ষেপ করেননি। শুধু বলেছেন, লাহোর প্রস্তাবে STATES বা একাধিক রাষ্ট্রের কথা ছিলো। অথচ তাঁরা যেনো ইচ্ছাকৃতভাবে এ কথা চেপে যেতেন যে ১৯৪০-এর পর যে পাকিস্তান আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে তার মধ্যে একাধিক রাষ্ট্রের কথা কেউ ভাবতো না। আমরাও ভাবিনি। আলাদা রাষ্ট্র হিসাবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্ব পাকিস্তান যে একমাসও টিকতে পারতো না তার উল্লেখ আবুল মনসুর আহমদ বা আবুল হাশেমের কোনো লেখা বা বিবৃতিতে পাইনি। ইন্ডিয়া যখন পাকিস্তানের প্রাপ্য ৯০ কোটি টাকা আটকে দেয় তখন পাকিস্তান টিকে থাকবে কিনা এই প্রশ্ন দেখা দেয়। হায়দরাবাদের নিজামের প্রধানমন্ত্রী মীর লায়েক আলীর চেষ্টায় নিজামের তহবিল থেকে এ টাকার ব্যবস্থা হলে সংকট কেটে যায়। এরপর অবশ্য অন্তর্জাতিক জনমতের চাপে ইন্ডিয়া ঐ টাকা ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছিলো। প্রশ্ন হলো ৪৭-৪৮ সালে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান এ রকম একটা সংকটের মোকাবেলা করতো কিভাবে?
তারপর ঠিক স্বাধীনতার প্রাক্কালে মাউন্টব্যাটেন আর একটি চাল দিয়েছিলেন। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যে তিনিই হবেন ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তানের যৌথ রাষ্ট্রপ্রধান। কায়েদে আজম এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ এ ক্ষেত্রে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতো না এবং মাউন্টবেটেন এবং কংগ্রেস সম্ভবতঃ প্ল্যান করেছিলেন যে এই কৌশলেই ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তানের বিভক্তি অচিরেই বাতিল হয়ে যাবে। স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্যেও তাই ঘটতো। এই অঞ্চলের বহু প্রবীণ রাজনীতিবিদের মুখেও শুনেছি যে মাউন্টবেটেনকে যৌথ গভর্নর জেনারেল হিসাবে মেনে নিলে পাকিস্তান আরো অনেক কিছু পেতো। এই বালসুলভ যুক্তি যে একেবারেই অসার পরবর্তী ইতিহাসে তার প্রমাণ আমরা পেয়েছিলাম।
তবুও শুনছি লাহোর প্রস্তাব সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি বলেই আমাদের যতো রাজনৈতিক দুর্দশার সৃষ্টি হয়েছিলো। এবং এ কারণেই নাকি শেষ পর্যন্ত পূর্বাঞ্চল পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
অন্যদিকে আরেক দল সমালোচক ছিলেন যারা কোনো কালেই দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাস করেননি এবং গোড়া থেকে পাকিস্তানকে প্রথমে ঘায়েল এবং পরে একেবারে ধ্বংস করে ফেলার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিলেন। কোন অসুবিধা বা সমস্যা দেখা দিলেই এরা বলতেন ভারত বিভক্ত না হলে এসব ঘটতো না। শতসহস্র মুসলমান বাঙালী নতুন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্পে এঁরা অগ্রসর হতে শুরু করলেন, মাড়োয়ারী আধিপত্যের অবসান ঘটলো, শিক্ষা ব্যবস্থাকে নতুন করে সংস্কার করার সুযোগ পেলাম- এ সমস্তই যেনো মিথ্যা কথা। অবশ্য আমি আগেই বলেছি শিক্ষা এবং শিল্প ক্ষেত্রে দেড়শত বছরের অনগ্রসরতার কারণে নতুন সুযোগগুলির সদ্ব্যবহার করতে পারিনি। আমি একটা উদাহরণ দিচ্ছি।
পাকিস্তান গঠিত হবার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় ইস্ট পাকিস্তান সেকেন্ডারী এড়ুকেশন বোর্ড স্থাপিত হয়। ”৪৭-এর ১৪ই অগস্টের পূর্ব পর্যন্ত ঢাকা শহর বাদ দিয়ে সারা বাংলার মাধ্যমিক শিক্ষা এবং পরীক্ষা পরিচালনার ভার ছিলো কলকাতা ইউনিভার্সিটির উপর। এই দায়িত্ব নতুন বোর্ডকে নিতে হয়। স্বাধীনতার পূর্বে ঢাকায় যে ইস্ট বেঙ্গল এড়ুকেশন বোর্ড ছিলো তার জুরিসডিকশন বা ক্ষমতা ঢাকা শহরের স্কুল-কলেজ এবং বাংলা প্রদেশের হাই মাদ্রাসাগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো। নতুন ইস্ট পাকিস্তান বোর্ড ব্যাপকতর ক্ষমতা নিয়ে আবির্ভূত হলো এবং এর প্রথম চেয়ারম্যান হিসাবে নিযুক্ত হন প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ। তিনি মুসলিম লীগ পন্থী রাজনীতিবিদ হিসাবে পরিচিত ছিলেন এবং বহুদিন করোটিয়া সাদত কলেজের প্রিন্সিপালের পদে অধিষ্ঠিত থেকে শিক্ষাবিদ হিসাবে সুনাম অর্জন করেছিলেন। কিন্তু এই ভদ্রলোক উৎসাহের আতিশয্যে এমন এক কান্ড করে বসলেন যাতে ইংরেজী শিক্ষার মান নিম্নমুখি হতে শুরু করলো। কলকাতা ইউনিভার্সিটি কর্তৃক প্রকাশিত বিখ্যাত ইংরেজ লেখকের রচনা সম্বলিত সংকলন বাদ দিয়ে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ এক নতুন সংকলন বোর্ডের নামে প্রকাশ করলেন। যার মধ্যে ছিলো স্থানীয় লেখকদের ইংরেজী নিবন্ধ। তিনি নিজেও কিছু কিছু লিখেছিলেন। এর ভাষা ছিলো নিকৃষ্ট, অসংখ্য ব্যাকরণ ভুলে জর্জরিত। আরো আশ্চর্য লাগলো যে সংকলনটিতে অর্ধেক ছিলো মুসলমান নেতাদের জীবনী আর অর্ধেকে এমন সব ভারতীয় হিন্দু নেতাদের জীবন আলেখ্য যাঁদের সংকীর্ণতা এবং সাম্প্রদায়িকতার কারণে শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের আলাদা রাষ্ট্রের কথা ভাবতে হয়।
আমি তখন সিলেটের এমসি কলেজের ইংরেজীর লেকচারার। সংকলনটি হাতে পেয়ে আমি হতাশ হয়ে ভাবলাম যে এভাবেই যদি পাকিস্তানের শিক্ষা জীবনের শুরু হয় ছাত্রদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হবে। কলকাতা ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ভুল ইংরেজী বাংলা শেখাবার উদ্দেশ্যে তো আমরা পাকিস্তান আন্দোলন করিনি। তাড়াহুড়া করে কলকাতার সংকলন বাদ দেবার কোনো কারণই ছিলো না। দেশপ্রেমের নামে নিকৃষ্ট বইপত্র প্রচলন করে কি হয় তার প্রমাণ তো গত চার দশকে আমরা প্রচুর পেয়েছি। আমি সিলেট থেকে প্রকাশিত ইস্টার্ন হেরালড নামক ইংরেজী সাপ্তাহিকে এ সম্বন্ধে বেনামীতে দু”টি প্রবন্ধ লিখি। ১৯৪৮ সালে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেবার পর একদিন বোর্ডের মিটিং-এ ইবরাহীম খাঁ সাহেব অনুযোগের স্বরে আমাকে বললেন, দেখুন, কে এক ভদ্রলোক বোর্ডের সমালোচনা শুরু করে দিয়েছেন। আপনিই বলুন, এ বই-এ সবচেয়ে ত্রুটিপূর্ণ অংশ কোনগুলি? আমি জানতাম না যে কিছু কিছু অংশ তাঁর নিজের রচনা। আমি বললাম যে বইটির কোনো প্রবন্ধই ছাত্রদের পাঠ্য হবার যোগ্য নয় আর বিভিন্ন অংশের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য সম্পাদকীয় মন্তব্যগুলি রচনা শৈলী, স্টাইল এবং ব্যাকরণের দিক থেকে সবচেয়ে দূর্বল। আমি তখন জানতাম না যে এগুলি তারই রচিত। প্রিন্সিপাল সাহেব আমার জবাবে একটু হতাশ হলেন। পরে এই সংকলনটি বাতিল করা হয়।
ঘটনার আমি উল্লেখ করছি এই জন্য যে শুধু দেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে শিক্ষাগত অযোগ্যতা ঢাকা যায় না। প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ বাংলার লেখক হিসাবে প্রসিদ্ধ কিন্তু নিজের অপটু ইংরেজী রচনা ছাত্রদের উপর কেনো চাপিয়ে দিয়েছিলেন সেটা আমার পক্ষে বোধগম্য হয়নি।
নিকৃষ্ট শ্রেণীর পাঠ্য পুস্তকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ১৯৫৫ সালে আবার পাকিস্তান অবজারভারে একটি প্রবন্ধ লিখি। এখানেও আমার বক্তব্য ছিলো এই যে নিকৃষ্ট রচনা নিকৃষ্ট কাগজে ছেপে পাঠ্য পুস্তকের অভাব মোচনের যে চেষ্টা আমরা করছিলাম তা সুফলপ্রসু হতে পারে না। আসল কথা হলো, শিক্ষাক্ষেত্রে এবং অন্যান্য এলাকায়ও পূর্ব পাকিস্তানে যাঁদের উপর দেশ গঠনের গুরু দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিলো তাঁরা ছিলেন অপেক্ষাকৃতভাবে অনভিজ্ঞ এবং অযোগ্য। প্রথম থেকেই বাঙালী, অবাঙালীর প্রশ্ন তুলে অবাঙালী অফিসারদের বিশ্বাস করা হতো না। আজিজ আহমদ, এন এম আহমদ, জিএম মাদানী প্রমুখ আইসিএস অফিসার যাঁরা কর্মজীবনের শুরু থেকে এ অঞ্চলের সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হয়েছিলেন তাঁদের সম্পর্কে শুনেছি যে তাঁরা নাকি পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনিতে পরিণত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। শেষ পর্যন্ত যখন অবিশ্বাস প্রচারণার ফল আরো তীব্র হয়ে উঠে, এরা সব এ অঞ্চল ত্যাগ করে যান। আমরা আরো অপটু কর্মচারীর খপ্পরে পড়ি।
একদিকে ছিলো এক শ্রেণীর মধ্যে পাকিস্তানের আদর্শের প্রতি অশ্রদ্ধা, অন্যদিকে অপটুত্ব এবং অকর্মণ্যতা। কাজেই কয় বছরের মধ্যে নিন্দুকের দল তাদের সমালোচনার সপক্ষে এমন সব যুক্তি-প্রমাণ বের করতে পারলেন যার দ্বারা জনসাধারণকে বুঝানো যায় যে সত্যি এ অঞ্চলে কিছু হচ্ছে না।
কোটার ভিত্তিতে আমাদের অঞ্চলের অর্থনীতিবিদরা কেন্দ্রীয় প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য হয়েছেন, কিন্তু এঁরা ঢাকায় এসে অনেক কথা বলতেন, যাতে মনে হতো যে পশ্চিম পাকিস্তানী আফিসারবৃন্দ পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য অধিকার স্বীকার করতে একেবারেই নারাজ ছিলেন। এ রকম কথা স্টেট ব্যাংকের গভর্নর রশীদ, প্রফেসর নূরুল ইসলাম, ডক্টর নুরুল হুদা প্রমুখর মুখে শুনেছি। একবার আমি যখন রাজশাহী ইউনিভার্সিটির ভাইস চান্সেলর তখন পদাধিকার বলে আমাকে একবার ইকনমিক কাউন্সিল জাতীয় একটা কমিটির অধিবেশনে যোগ দিতে হয়। কাউন্সিলটির নাম এ মুহূর্তে আমার ঠিক মনে পড়ছে না তবে সম্ভবতঃ এটা ১৯৭০ সালের প্রথম দিকের ঘটনা। সভায় সভাপতিত্ব করলেন এম এম আহমদ। পাকিস্তানের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তাঁর সুনাম ছিলো। সবচেয়ে আশ্চর্য হলাম আমাদের সদস্য নুরুল ইসলাম তাঁর প্রস্তাবগুলির একটুও সমালোচনা করতে সাহস পেলেন না। আমি তাঁর দিকে তাকিয়েছিলাম। কথা ছিলো কোনো ভোটাভুটি হলে আমরা তাঁর সমর্থন করবো, কিন্তু উনি যখন কোনো কথাই বললেন না তখন ভোটাভুটির প্রশ্নই উঠেনি, এই ছিলো শোষণের আসল চিত্র। মিটিং শেষ হবার পর আমি নুরুল ইসলামকে জিজ্ঞেস করলাম যে প্রস্তাবগুলি সম্বন্ধে তিনি ব্যক্তিগতভাবে যে সমস্ত আপত্তির কথা বলেছিলেন সেগুলি উত্থাপন করলেন না কেনো? আমরা তাঁকে সমর্থন করতাম। এর কোনো সদুত্তর পাইনি। এম এম আহমদের ব্যক্তিত্বের সামনে তিনি এতই সংকুচিত হয়ে পড়েছিলেন যে কোনো কথা বলবার সাহস তাঁর হয়নি। অথচ এই ব্যক্তি ঢাকায় অনেক কথা বলতেন যে যার মানে হলো যে পশ্চিম পাকিস্তান অনবরত আমাদের। শোষণ করে যাচ্ছে।
আমি এ সমস্ত কথা বলছি এই যুক্তির সমর্থনে যে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ এবং অর্থনীতিবিদরা হয় এমন উদ্ভট প্ল্যান উপস্থিত করতেন যা পাকিস্তানের অস্তিত্বের বিরুদ্ধেই হুমকিস্বরূপ। অর্থাৎ যার মধ্যে রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানের স্বীকৃতি নেই। অথবা যেখানে ন্যায়সঙ্গত আপত্তির কোনো কারণ ছিলো সেখানে ভয়ে কোনো কথাই বলা হতো না আর একটা উদাহরণ দিচ্ছি।
আইযুব খান ক্ষমতায় আসার পর একদিকে যেমন রাইটার্স গিল্ড গঠন করে দু” অঞ্চলের বুদ্ধিজীবীদের তাঁর নিজের রাজনৈতিক আদর্শে দীক্ষিত করার চেষ্টা করেছেন- (সে ঘটনা আগেই উল্লেখ করেছি) তেমনি শিক্ষা ব্যবস্থাকে নতুন আঙ্গিকে সাজাবার একটা প্রক্রিয়াও শুরু করেন। শরিফ কমিশন এই প্রক্রিয়ারই ফল। এই কমিশনের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসাবে প্রফেসর আতাউর হোসেন এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির ভাইস চান্সেলর ডক্টর আবদুর রশীদ যুক্ত ছিলেন। কমিশন একজন বা একাধিক আমেরিকান বিশেষজ্ঞকে শিক্ষা সংস্কারের দায়িত্বে নিয়োগ করে। কয়েক মাস পর তাদের রিপোর্ট যখন প্রকাশিত হয় আমরা স্তম্ভিত হলাম। কমিশনের সুপারিশগুলোর মধ্যে একটি ছিল এই যে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার দায়িত্ব কলেজের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে স্কুলের উপর ন্যস্ত করতে হবে। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব ছিলো যে বিএ পাস কোর্সের মেয়াদ দু”বছরের জায়গায় বাড়িয়ে তিন বছর করা হবে। অনার্সের মেয়াদও হবে আগের মতো তিন বছরই তবে অনার্সের পর যারা এম এ-এমএসসিতে ভর্তি হবে তারা অনার্স ডিগ্রী থাকলে এক বছরের মধ্যেই এম এ-এমসি-এমকমের জন্য পরীক্ষা দিতে পারবে। আর বিএ পাস ডিগ্রী প্রাপ্ত ছাত্ররা দু”বছরের কোর্স নিবে। মানে হলো একই ডিগ্রীর জন্য এক শ্রেণীর ছাত্রের লাগবে দু”বছর আর আরেক শ্রেণীর ছাত্রের লাগবে এক বছর।
শরীফ সাহেব যখন ঢাকায় এসে ভাইস চান্সেলর মাহমুদ হোসেন সাহেবের বাসায় ইউনিভার্সিটির প্রফেসরদের সঙ্গে তাঁর কমিশনের সুপারিশগুলো নিয়ে আলোচনা করেন, আমরা অনেকেই তাঁকে বুঝাবার চেষ্টা করেছি যে তিনি যে সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছেন তা অত্যন্ত অবাস্তব এবং তার ফলে শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশৃংখলা ঘটবে। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার ভার গ্রহণের ক্ষমতা কেনো স্কুলের নেই। এবং তাদের উপর নতুনভাবে এই ক্ষমতা ন্যাস্ত করতে গেলে অরাজকতার সৃষ্টি হবে। তাছাড়া এম এ ডিগ্রীর মেয়াদে যে তারতম্য তারা ঘটিয়েছেন সেটা ছাত্র সমাজের কাছে মোটেই যুক্তিযুক্ত মনে হবে না। অতিরিক্ত এক বছরের ব্যয়ভার গ্রহণ করাও সাধারণ পরিবারের পক্ষে সম্ভব হবে না।
এ কথা সবাই জানেন যে, শেষ পর্যন্ত শরীফ কমিশনের সমস্ত সুপারিশ পরিত্যক্ত হয়। কিন্তু যে দু”তিন বছর এ সংস্কার চালু ছিলো তার প্রভাবে অনেক অনাবশ্যক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিলো। আর এরই বিরুদ্ধে সবচেয়ে তীব্র প্রতিবাদ উঠেছিলো পূর্ব পাকিস্তানে। অথচ কমিশনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি যাঁরা ছিলেন তাঁরা অকপটে শরীফ সাহেবকে সমর্থন জানিয়ে এসেছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের মোকাবিলায় তারা সংকুচিত বোধ করতেন।
শরীফ সাহেব যে ইচ্ছাকৃতভাবে একটা সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলেন, তা নয়। অকৃতদার এই ব্যক্তি এক স্বপ্ন জগতে বাস করতেন। তিনি ভাবতেন মার্কিন বিশেষজ্ঞরা যে সমস্ত পরামর্শ দিয়েছেন তা গৃহীত হলে দেশ শনৈ শনৈ অগ্রসর হবে।
আমি নিজে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে সংস্কার উপর থেকে চাপিয়ে না দিয়ে নীচের ক্লাস থেকে শুরু করলে ছাত্ররা নতুন নিয়মে পরীক্ষা দিতে এবং পড়াশোনা করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। এখানেও দেখরাম কমিশনের পূর্ব পাকিস্তানী সদস্যরা শরীফ সাহেবকে সমর্থন জানিয়ে বললেন যে, এদেশে ধীরে সুস্থে কিছু করতে গেলে কাজ হয় না; নতুন সরকারের হাতে যখন নিরংকুশ ক্ষমতা রয়েছে একই সঙ্গে নিম্নতম শ্রেণী থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েট ক্লাস পর্যন্ত চালু করা সমীচীন হবে। অর্থাৎ যে সমস্ত ছাত্র দু”বছরের বিএ কোর্সে ভর্তি হয়েছে তাদেরও আরেক বছর ক্লাস করতে হবে। যখন এই নিয়ে প্রচন্ড আপত্তি উঠতে থাকে তখন ভাইস চান্সেলর মাহমুদ হোসেন সাহেব এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। তিনি বললেন যে, যারা দু”বছরের কোর্স শেষ করেছে তারা নীতিগতভাবে পরীক্ষা ছাড়াই ডিগ্রী পাওয়ার যোগ্য। কারণ তারা তাদের কোর্স সমাপ্ত করেছে। এভাবে তখন কয়েক হাজার ছাত্র-ছাত্রী বিনা পরীক্ষায় বিএ, বিএসসি, বিকম ডিগ্রী পেয়েছিলো। পরীক্ষা দিলে কেউ ফার্স্ট, কেউ সেকেন্ড আবার কেউ থার্ড ডিভিশন পেতো। আবার কেউ ফেল করতো। কিন্তু ঢালাওভাবে বিনা পরীক্ষায় ডিগ্রী প্রাপ্তির এই ঘটনা নজিরবিহীন। এবং এর কুফল থেকে আমরা এখনো রক্ষা পাইনি।
শরীফ কমিশন নিয়ে হৈচৈ এখানেই সমাপ্ত হয়নি। কমিশনের রিপোর্ট সংশোধন করার জন্য পরবর্তী সময়ে জাস্টিস হামিদুর রহমানের নেতৃত্বে আরেকটি কমিশন গঠিত হয়েছিলো। তাঁর সুপারিশের বিরুদ্ধেও প্রবল আপত্তি সৃষ্টি হয়। এবং শেষ পর্যন্ত এই দুইকমিশনই একটা প্রহসনে পরিণত হয়। এদেঁর রিপোর্টে যে কোন সুষ্ঠ সুপারিশ ছিলো না তা নয়। কিন্তু কতগুলি ভুলের জন্য শিক্ষা সংস্কারের এ চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। পাকিস্তান বিরোধী দলের মধ্যে এ দু”টি কমিশনকেই পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করা হতো। দ্বিতীয় কমিশনের চেয়ারম্যান জাস্টিস হামিদুর রহমান ছিলেন এ অঞ্চলেরই অধিবাসী। আর শরীফ কমিশনেও পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ছিলেন। যদি এই কমিশনগুলোর সুপারিশ সত্যিই বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য ক্ষতিকর হয়ে থাকে, আমাদের প্রতিনিধিরা আগে মুখ খুললেন না কেনো?
আসল কথা হচ্ছে যে আমাদের আমলা, শিক্ষাবিদ প্রমুখ যাঁরা পাকিস্তানের কারণে, বহুক্ষেত্রে কোটার জোরে, গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন, অভিজ্ঞতায় এবং কর্মক্ষমতায় তাঁদের অধিকাংশই অবাঙালী কর্মচারীদের সমকক্ষ ছিলেন না। তাঁদের সামনে এঁরা কাবু হয়ে পড়তেন এবং নিজেদের অযোগ্যতা ঢাকবার উদ্দেশ্যে বাইরে এসে অভিযোগ করতেন যে ওঁদের ষড়যন্ত্রের কারণে তাঁরা কিছু করতে পারেননি। ষড়যন্ত্রের অজুহাত দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের পশ্চাদপদতা ব্যাখ্যা দেবার প্রবণতা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়ায় যে ষাটের দশকে এসে শেখ মুজিব এবং তাঁর সহকর্মীরা যত্রতত্র ষড়যন্ত্রকারীদের সন্ধান পেতেন। অথচ সত্য কথা হচ্ছে পাকিস্তানে গণতন্ত্র এবং শাসনতান্ত্রিক বৈধতার বিরুদ্ধে যতগুলি ষড়যন্ত্র হয়েছে তার মূলে ছিলেন এ অঞ্চলের নেতৃবৃন্দ। এঁদের সমর্থন নিয়েই গোলাম মোহম্মদ প্রথম গণপরিষদ ভেঙ্গে দিয়েছিলেন।
১৯৫৮ সালে ইস্কান্দর মির্জা এবং জেনারেল আইয়ুব খানের ষড়যন্ত্রের সঙ্গেও পূর্ব পাকিস্তানের বগুড়ার মোহম্মদ আলী এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী জড়িত ছিলেন। মোহাম্মদ আলী তো বটেই সোহরাওয়ার্দী সাহেবও ইস্কান্দর মির্জার অধীনে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করতে রাজি হয়ে তাঁর আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মতো ব্যক্তি যাঁকে তাঁর স্তাবকেরা গণতন্ত্রের মানসপুত্র ও অতন্দ্র প্রহরী বলে চিহ্নিত করে রেখেছে তিনি কোন যুক্তিতে ইস্কান্দর মির্জার মতো গণতন্ত্রের শক্রর সঙ্গে সহযোগিতা করতে গিয়েছিলেন, সেটা আমার কাছে রহস্যময়। সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রী সভায় আবুল মনসুর আহমদের মতো ব্যক্তিও ছিলেন। এঁদের সহযোগিতা ও সাহায্য না পেলে মিলিটারি শাসন স্থায়ীভাবে কায়েম হতে পারতো না। যে ব্যক্তিটিকে গোলাম মোহাম্মদ বরখাস্ত করে প্রথম গণপরিষদ ভেঙ্গে দিয়েছিলেন সেই নাজিমুদ্দিন সাহেবকে আওয়ামী লীগ মহলে নানাভাবে কুৎসিত ভাষায় গালাগালি করা হয়। অথচ তিনি একবারও ক্ষমতার লোভে কোনো মন্ত্রিত্বও গ্রহণ করেননি এবং সামরিক শাসনের সঙ্গে সহযোগিতাও করেননি। বরঞ্চ মোহতারিমা ফাতেমা জিন্নাহ যখন আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ইলেকশনে দাঁড়িয়ে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর সবচেয়ে বড় সমর্থক ছিলেন খাজা নাজিম উদ্দিন। অদৃষ্টের এমন পরিহাস যে বাংলাদেশের ইতিহাসবেত্তারা তাঁকে বলছেন পশ্চিম পাকিস্তানের তাবেদার, গণতন্ত্রের দুশমন ইত্যাদি।
১৯৫৮ সালে যে ক্যুর মাধ্যমে শাসনতন্ত্র একেবারে বাতিল করে ইস্কান্দর মির্জা এবং আইয়ুব খান ক্ষমতা অধিকার করেন তার পিছনেও রয়েছে এক কলংকের ইতিহাস। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জানে না যে ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান যখন একক ক্ষমতার মালিক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং ইস্কান্দর মির্জাকেও সরিয়ে দেন তার পিছনে জনমতের একটা বিরাট অংশের সমর্থন ছিলো। দেশের দুই অংশেই চরম অরাজকতার ফলে একটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিলো। সে বছরই পূর্ব পাকিস্তানে ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলী আওয়ামী লীগের কতিপয় সদস্যের হাতে নিহত হন। তাছাড়া পূর্ব পাকিস্তানে শহীদ সাহেবের দল প্ল্যান করেছিলো যে যেমন করেই হোক তারা ইলেকশনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করবে। দেশের সর্বত্র গুন্ডা বাহিনী নিয়োজিত করা হয় যাদের উপর ভোট কেন্দ্র দখল করে ব্যালট বক্স ছিনতাই করার দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। এ রকম গুজব সারা পূর্ব পাকিস্তানে ছড়িয়ে গিয়েছিলো। নেজামে ইসলাম পার্টির সদস্য সৈয়দ কামরুল আহসান-যাঁর নাম আমি আগে উল্লেখ করেছি-তাঁর আত্মজীবনীমূলক PORTRAITS FROM MEMORY নামক বইয়ে লিখেছেন যে আওয়ামী লীগের এই ষড়যন্ত্র না হলে আইযুব খান জনমতের সমর্থন লাভ করতে পারতেন না। আজ ৩৩-৩৪ বছর পর এ সমস্ত কথা অনেকেই ভুলে গেছেন। যাদের বয়স পঞ্চাশের নীচে তাদের এ সমস্ত কথা জানবারও কথা নয়।
কিন্তু কেনো এবং কি উপায়ে ষাটের দশকের শেষদিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটা গণবিক্ষোভ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছিলো সেটা বুঝতে হলে এ সমস্ত ঘটনার উল্লেখ করা একান্ত প্রয়োজন।
১৯৬৫ সনের যুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তানে অবাঙালী বিরোধী মনোভাব যখন তীব্রতর হতে শুরু করে তখন আগাখানী এবং বোহরা সম্প্রদায়ের অনেক ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতি বাড়ীঘর এবং ধন-সম্পত্তি বিক্রয় করে এ অঞ্চল থেকে সরে পড়েন। তাঁরা এসেছিলেন স্থায়ীভাবে এখানে বসবাস করে ব্যবসা-বাণিজ্য করবেন এ উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু তার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল আওয়ামী লীগের অবাঙালী বিরোধী অভিযান। এর ফলে এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক অবস্থার আরো দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে।
এমন কি ঢাকা ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন ভাইস চান্সেলর ডক্টর মাহমুদ হাসান ও ডক্টর মাহমুদ হোসেন যাঁরা উভয়েই ঢাকায় বাড়ীঘর তৈরী করেছিলেন, তাঁরা এসব বিক্রি করে ফেলেন। ডক্টর আহমদ হাসানদানীর মতো অধ্যাপক যিনি প্রথমে পূর্ব পাকিস্তানে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং যাঁর চেষ্টায় পাকিস্তান এশিয়াটিক সোসাইটি স্থাপিত হয়, তিনিও চলে যান। এ রকম আরো অনেকে যাঁদের সুবিধা ছিলো, পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে যান। এঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যে এ অঞ্চলে একটা বিশেষ দল যে জাতি বিদ্বেষ সৃষ্টি করে যাচ্ছে তাতে একটা বিস্ফোরণ ঘটবার আশংকা সৃষ্টি হচ্ছিলো। আগে সেখানে কাবুলী, পেশোয়ারী, বিহারী, উত্তর প্রদেশের আগ্রা-দিল্লীর লোকেরা ঢাকায় এবং অন্যান্য স্থানে অবাধে বসবাস ও ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারতো এবং তাদের কেউ বিদেশী মনে করতো না। কারণ তারা ছিলো মুসলমান। সেই পরিবেশে একটা আমূল পরিবতর্ন ঘটছিলো। আমি যে বাসায় শিক্ষা জীবন কাটিয়েছি সেখানে চাকর-বাকর সবই ছিলো বিহারের দার ভাঙ্গ এবং মুংগের জেলার। একজন হিন্দু উড়িয়া মালিও ছিলো। বাড়ীতে দারোয়ান বা নৈশ প্রহরী ছিলো একজন পাঞ্জাবী। কখনো মনে হয়নি এরা বিদেশী। কারণ ঐ উড়িয়াকে বাদ দিলে আর সবাই ছিলো মুসলমান। আমরা মনে করতাম ঐ উড়িয়া মালিই বিদেশী। আর অন্য সবাই এক জাতের।
৬০ দশকের ক্রমাগত প্রচারণার ফলে এবং ভাষা আন্দোলনের প্রভাবে পাকিস্তানের ভিত্তিমূল ক্রমশঃ দূর্বল হয়ে পড়তে থাকে। উর্দূভাষী একজন সাধারণ কুলিকে দেখলেও বলা হতো এরা শোষকের দলের লোক। বৃটিশ আমলে এবং পাকিস্তানের প্রথম দিকে রেলওয়ে স্টেশনে, স্টিমারঘাটে বহু উর্দূভাষী গরীব বিহারী কুলিগিরি করতো। বাস্তবিক পক্ষে কুলিদের সঙ্গে উর্দুতেই কথা বলতে হয়। এই অভ্যাস প্রায় সবারই হয়ে গিয়েছিলো। ১৯৪৭ সালের পর আরো কয়েক লক্ষ মোহাজের বিহার-উড়িষ্যা এবং কোলকাতা থেকে পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় গ্রহণ করে। তখন ৪০/৫০ বছর আগে থেকে যে সমস্ত উর্দূভাষী এ অঞ্চলে স্থায়ী বসবাস করছিলো এবং স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরেছিলো। তাদেরও এখন চিহ্নিত করা হলো চক্রান্তকারী দুশমন হিসাবে। অল্প পুঁজির ব্যবসায়ীদের কথা জানতাম যারা ঢাকার চকবাজার, মৌলবীবাজার, উর্দু রোড, মোগলটুলি প্রভৃতি এলাকায় জর্দার দোকান, পান-বিড়ির দোকান, টুপির দোকান প্রভৃতি ছোট ছোট ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করতো, তারাও হলো আমাদের দুশমন। এবং ৭১ সালে এরা অনেকে তথাকথিত মুক্তিবাহিনীর হাতে নির্মমতার শিকার হয়েছে।
এ কথা স্বীকার করবো যে ৪৭-এর আগে যে সমস্ত অবাঙালী অফিসার বা সাধারণ লোক কোনো কালে পূর্ব বাংলায় আসেনি তাদের একটা ধারণা ছিলো যে বাংলাভাষী মুসলমানরা সম্ভবত ভালো মুসলমান নয়। তারা কেউ কেউ ইসলাম এবং উর্দুকে সমান করে দেখতো। এরকম কথাবার্তায় অনেক বাংলাভাষী ক্ষুদ্ধ হতো। ফিরোজ খান নুন, যখন এই প্রদেশের গভর্নর নিযুক্ত হোন তিনি এই ধারণা নিয়ে এসেছিলেন যে এ অঞ্চলে মুসলমানদের মধ্যে খতনা প্রথা নেই। তিনি আরো এক কান্ড করেন। বিনা মূল্যে গ্রামে গ্রামে কোরআন বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়। যেনো এ অঞ্চলের মুসলমানরা ভালো করে কোরআন শরীফের সাথে পরিচিত নয়। অথচ পূর্ববঙ্গের এমন কোনো পাড়া-গাঁ নেই যেখানে মসজিদে এবং অধিকাংশ মুসলমান বাড়িতে কোরআন পাওয়া যেতো না। কোরআন বিতরণ করা কোনো দোষের কাজ নয়, কিন্তু যে ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি কোরআন প্রচারের প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছিলেন সেই ধারণার মূলে সত্য কিছুই ছিলো না। আবার সঙ্গে সঙ্গে ফিরোজ খান নুন-(যিনি ইংরেজীতে একটা উপন্যাস এবং একটি আত্মজীবনী প্রকাশ করেন এবং পরে এককালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন)-এটা বুঝতেন যে পূর্বাঞ্চলের ভাষা বাংলার সঙ্গে পরিচিত না হলে এখানে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করা দুরূহ। আমার পরিচিত ঢাকা ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগের এক অধ্যাপককে তাঁর জন্য বাংলা টিউটার নিযুক্ত করা হয়। ঢাকায় ভিকারুননেসা স্কুলটি তাঁর বৃটিশ স্ত্রীর প্রচেষ্টার ফল।
তাই বলছিলাম যে এ অঞ্চলের ভাষা এবং কালচার সম্পর্কে অজ্ঞতা থেকেই কোনো কোনো অবাঙালী অফিসার বা প্রশাসক যে সমস্ত মন্তব্য করতেন বলে শুনেছি সেগুলি পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে ইন্ধন হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এঁদের সংখ্যা ছিলো মু্ষ্টিমেয়। কিন্তু তবুও তাঁরা যে অজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছিরেন তাকে কোন রূপেই মার্জনীয় মনে করা যায় না। পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম এডুকেশন সেক্রেটারী এক অবাঙালী আইসিএস মিঃ ফজলে করীম প্রস্তাব করে বসেন যে বাংলা আরবী লিপিতে লেখা উচিত। একথা আমরা অনেকেই ভুলে গেছি যে হরুফুল কোরআন বলে একটা আন্দোলন অনেক দিন থেকে এ অঞ্চলে চালু ছিলো। এক মওলানা সাহেব আরবী লিপিতে চাটগাঁ থেকে একটা বাংলা সাপ্তাহিক প্রকাশ করতেন। এ কথা সত্য যে এ আন্দোলনের পিছনে বাংলাভাষী কিছু কিছু লোকের সমর্থন ছিলো। কিন্তু অবাঙালী আইসিএস অফিসার যখন এ প্রস্তাব উত্থাপন করলেন তখন সবাই বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন তুললো যে বাংলা কিভাবে লিখিত হবে সে সম্বন্ধে কথা বলার অধিকার তাঁর কোথায়? পশ্চিম বঙ্গের বিখ্যাত পন্ডিত সুনীতি চ্যাটার্জী বিশ্বাস করতেন যে ভারতবর্ষের সমস্ত ভাষাগুলির জন্য একটা সাধারণ লিপি গৃহীত হওয়া বাঞ্ছনীয়। এবং তিনি বলতেন রোমান লিপির কথা। সুভাষ চন্দ্র বসুও কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হিসাবে তাঁর অভিভাষণে ঐ প্রস্তাবের পুনরাবৃত্তি করেন। তারপর একথাও শুনেছি যে তারাশংকর বন্দোপাধ্যায় নাকি তাঁর উপন্যাসগুলি দেবনাগরী অক্ষরে ছাপাবার পক্ষপাতী ছিলেন। এ সমস্ত প্রস্তাব যাঁদের কাছ থেকে এসেছিলো তাঁরা সবাই ছিলেন বাংলাভাষী। সুতরাং অবাঙালীরা কেউ বাংলা ভাষার চরিত্র বদলাবার চক্রান্তে নেমেছে তখন এ কথা বলা চলতো না। কিন্তু মিঃ ফজলে করীম ফজলীর প্রস্তাবে যারা আরবী লিপির সমর্থন করতো তারাও অস্বস্তিবোধ করেছে। তারপর ইতিমধ্যেই ৪৭ সালের ১লা সেপ্টেম্বর থেকে তমুদ্দুন মজলিস গঠিত হওয়ায় বাংলা ভাষা নিয়ে একটা পাকিস্তান বিরোধী ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত হয়ে গিয়েছিলো। সেই পরিস্থিতিতে যখন ফজলে সাহেবের প্রস্তাব শোনা গেলো সেটা চক্রান্তকারীদের জন্য হলো সোনায় সোহাগা।
এ সমস্ত ছোটোবড়ো নানা ঘটনার সমন্বয়ে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছিলো যে যখনই কোনো পূর্ব পাকিস্তানী রাজনীতিবিদ বা কর্মচারী অবাঙালী কোনো অফিসারের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতেন, সঙ্গে সঙ্গে অবাঙালী ব্যক্তিটিকে পূর্ব পাকিস্তানের চরম শক্র বলতে দ্বিধা করেননি। ফলে অনেক অবাঙালী অফিসার হতাশ হয়ে এ অঞ্চল থেকে ট্রান্সফার নেয়ার চেষ্টা করতেন। নতুবা রাগের মাথায় ঝগড়া-বিবাদ করতে শুরু করতেন। এ ঘটনা পরম্পরাও হলো চক্রান্তকারীদের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। বাঙালী অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদ, আমলা, কারিগর যে পর্যাপ্ত সংখ্যায় নেই এ কথা যেনো পাকিস্তান সৃষ্টির কয়েক বছরের মধেই চাপা পড়ে গেলো। তখন কোন কোন রাজনীতিকের মাথায় এই বুদ্ধি এলো যেকোন রকমে এই অবাঙালী ও কারিগরদের তাড়িয়ে দিলে পূর্ব পাকিস্তানের উন্নতির পথে সমস্ত অন্তরায় অপসারিত হবে। এ সমস্ত রাজনীতিক সবাই যে সজ্ঞানে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চক্রান্তে নেমেছিলেন, মোটেই নয়। কিন্তু যে পরিপ্রেক্ষিত জ্ঞান এবং বাস্তবতাবোধ থাকলে- তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানের সত্যিকারের ভবিষ্যৎ কোথায় তা বুঝতে পারতেন, সেটা তাঁদের ছিলো না। বাংলায় আমরা বলি ফলেন পরিচয়তে অর্থাৎ ফল দিয়ে বৃক্ষের পরিচয়। এদেঁর দূরদৃষ্টি অভাবজনিত সমস্যার কারণে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষিত হলো না। এই অনস্বীকার্য সত্যের আলোকে পূর্ববর্তী ২২ বছরের ইতিহাস বিচারের অপেক্ষা রাখে। এঁদের মধ্যে যাঁরা এখন সমস্ত দোষ পশ্চিম পাকিস্তানের উপর চাপিয়ে দিয়ে প্রমাণ করতে চান যে তাঁরা হলো একমাত্র দেশপ্রেমিক তাদের নিজেদের কর্মকান্ডের বিশ্লেষণ করলেই এই যুক্তি আর টেকে না।
”৭৩ সালে ডিসেম্বর মাসে কারাগার মুক্ত হয়ে ”৭৫ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দেশে ছিলাম। তারপর জীবিকার অন্বেষণে বিদেশে যেতে হয়। ”৭৪ সনে দেশে যে অশনি সংকেত দেখেছি তখন হয়তো সমালোচকের দল বলতে পারতো যে ওটা আমার ব্যক্তিগত হতাশার প্রতিলফন মাত্র। কিন্তু আজ ১৯৯২ সালে যখন এ সমস্ত কথা লিখছি তখন এ বিশ্বাসই বদ্ধমূল হয়ে যাচ্ছে যে ”৭৪ সনে যে আশংকায় ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভীত হয়ে উঠেছিলাম সেটা মোটেই অমূলক ছিলো না। বাংলাদেশের বয়স বিশ বছর হলো। এখনও আমাদের জীবন সম্পূর্ণ নির্ভর করে ভিক্ষার উপর। সাহায্যদাতা দেশগুলির দয়া না পেলে আমাদের পক্ষে কোনো কিছুই করা সম্ভব নয়। আমাদের পাট, চা, চামড়া এ সমস্ত কাঁচামাল নিয়ে নাকি পাকিস্তানীরা ব্যবসা-বাণিজ্য করে আমাদের সম্পদ শোষণ করতো তা সবই রয়ে গেছে কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই আমাদের কোন উন্নতি হয়নি। আজ অধিকাংশ কলকারখানা হয় একেবারে বন্ধ হয়ে আছে, নচেৎ প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা লোকসান দিয়ে সেগুলো চালু রাখা হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের বৃহত্তম জুট মিল আদমজী মিলে নাকি দৈনিক প্রায় এক কোটি টাকার মতো লোকসান হয়। এ মিলটি বাংলাদেশ সরকার জাতীয়করণ করেছিলেন। সুতরাং উৎপাদন হোক বা না হোক শ্রমিকদের বেতন এবং বোনাস দিতে হয়। চিনিতে এককালে পূর্ব পাকিস্তানে সারপ্লাস ছিলো অর্থাৎ উৎপাদিত চিনি আমরা রপ্তানী করতে পারতাম। সেখানে আজ রয়েছে চিনির অভাব। আমদানী করে ঘাটতি মেটাতে হয়। পাটের আন্তর্জাতিক বাজার ইন্ডিয়া দখল করে নিয়েছে এবং সেটা বিচিত্র কিছু নয়। বিদেশী ক্রেতারা যেখানে সুবিধা বেশি পাবেন সেখানেই যাবেন। অন্যান্য পণ্যের ব্যাপারেও আমরা প্রতিযোগিতায় ইন্ডিয়ার সঙ্গে পেরে উঠছি না। কারণ স্থানীয় প্রায় প্রত্যেকটি বস্তুর দাম আমদানীকৃত পণ্যের চেয়ে বেশি। শিল্পপতিরা বলেন যে, এর কারণ এখানে বিদ্যুৎ, গ্যাস, ফোন প্রভৃতি খাতে তাঁদের ইন্ডিয়ার চেয়ে দ্বিগুণ এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তিন-চার গুণ বেশি চার্জ দিতে হয়। ভারতের পণ্য চোরাপথে আমদানী করেও তার চেয়ে সস্তা দরে বাজারে বিক্রয় করা সম্ভব। কৃষিক্ষেত্রে অবস্থা এতো শোচনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে পেয়াজ-রসুন, আদা, মরিচ সবই আমাদের আমদানী করতে হচ্ছে। এমন কি আজকাল আমরা সুপারীও আমদানী করি।
পাকিস্তান আমলে শুনতাম কর্ণফুলী মিলের কাগজ আর খুলনা নিউজপ্রিন্ট পাকিস্তানীরা আমাদের ঠকিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যেতো। এবং ওগুলো আবার চড়া দরে আমাদের কাছে বিক্রয় করতো। আজ এক দিস্তা সাদা কর্ণফুলী কাগজের দাম কমপক্ষে দশ টাকা। ষাট পৃষ্ঠার একটা খাতার দাম নয় থেকে দশ টাকা। টাইপের কাগজ ৫০০ শিটের এক বান্ডিল ১২০ টাকা। ষাটের দশকে বাজারের সেরা লুঙ্গি কেনা যেতো ১৪/১৫ টাকায়, একটু কম দামের লুঙ্গি ৫/৬ টাকায় পাওয়া যেতো। এখন ভালো লুঙ্গি একটা কিনতে হলে লাগে প্রায় ৩০০ টাকা। অতি সাধারণ লুঙ্গির দাম ১৫০/১৭৫ টাকা। ভালো চালের দর উঠেছে ৬৫০/৭০০ টাকা। পঁচিশ টাকা কিলোর নীচে পোলাও এর চাল পাওয়া যায় না। মুসুরির ডালের দাম ২৫/২৬ টাকা কিলো। চিনি কিলো প্রতি ২৫ থেকে ৩০ টাকা। এ রকম নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস যা না হলে জীবনধারণ করাই অসম্ভব তা চলে গেছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। পাকিস্তান আমলের তুলনায় জিনিসপত্রের দাম কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৭/৮শ” গুণ বেড়ে গেছে। আমি যখন প্রথম পরিবারের জন্য হরলিক্স কিনতে শুরু করি তখন প্রতি বোতলে লাগতো পঞ্চাশ পয়সা। ১৯৭০ সালে এক বিয়ে উপলক্ষে দশ টিন ডানো দুধ কিনেছিলাম দুইশ” আশি টাকায়, প্রতি টিন আটাশ টাকা হিসাবে। এখন দুইশ” আশি টাকায় এক টিনও কেনা সম্ভব নয়।
পৃথিবীব্যাপী ইনফ্লেশনের প্রভাব এই ব্যাপারে অবশ্যই আছে। কিন্তু বাংলাদেশে দুর্নীতি, প্রশাসনিক অযোগ্যতার কারণে আমাদের যে খেসারত দিতে হচ্ছে তার নজির ইন্ডিয়া বা পাকিস্তানে নেই। ইন্ডিয়ার বাজারে তুলনামূলকভাবে কাপড়-চিনি, চাল, আটা সবই সস্তা। আরো একটা ব্যাপার এখানে উল্লেখ করবো। বর্তমানে নাকি বছরে ৫০০ কোটি টাকার গুঁড়ো দুধ আমদানী করা হয়। কারণ দু”টো। প্রথম হলো দেশে দুধের উৎপাদন বিপজ্জনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। দ্বিতীয়তঃ গুঁড়ো দুধের ব্যবসা যারা করে তারা ষড়যন্ত্র করে এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছে যাতে দুধ উৎপাদনে কেউ উৎসাহী না হয়ে উঠতে পারে। এ রকমভাবে দেখছি যে সর্বক্ষেত্রেই দেশের উৎপাদন হয় একেবারে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বা এমন পর্যায়ে নেমে এসেছে যে বাধ্য হয়েই নূন্যতম চাহিদা মেটানোর জন্য এটা-ওটা-সেটা আমদানী করতে হয়। অসংখ্য ভুঁইফোঁড় ব্যবসায়ী এলসি খুলে দেশ থেকে টাকা পাচার করেন অথচ যে সমস্ত জিনিস আমদানী করার কথা তা বাজারে দুষ্প্রাপ্য। তার মানে মুষ্টিমেয় অসাধু ব্যবসায়ীর শিকারে পরিণত হয়ে বাংলাদেশ এমন অবস্থায় নেমে এসেছে যে প্রতিবছর সাহায্যদাতা কনসর্টিয়ামের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। বতর্মানে কোন সরকার কনসর্টিয়াম থেকে আবেদন-নিবেদন করে ভিক্ষা করে কি পরিমাণ ডলার আনতে পারেন সেটাই সে সরকারের কৃতিত্বের বড় মাপকাঠি। ১৯৯১ সালে যে জলোচ্ছ্বাসে কয়েক হাজার লোক প্রাণ হারায় তখন আমরা বিদেশ থেকে অনেক সাহায্য পেয়েছি, সে জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহতা সবাই আমরা জানি। কিন্তু দুঃখ্য লাগলো যখন আমাদের ভিক্ষা প্রবণতার প্রতি তীর্যক ইঙ্গিত করে বিদেশী কাগজে মন্তব্য করা হলো যে বাংলাদেশ থেকে প্রাণহানির যে সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে তা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ এ রকম দুর্ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে ভিক্ষার পরিমাণ বৃদ্ধি করার ব্যাপারে বাঙালীরা ওস্তাদ।
আরো আশ্চর্যের কথা যে তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা যারা ”৭১ সালে তাদের ভূমিকা নিয়ে গর্ব করে বেড়ায় তারাই আবার দেশের অভাব, অরাজকতা প্রভৃতির অজুহাত তুলে খোলাখুলিভাবে বলতে শুরু করেছে যে বাংলাদেশের পক্ষে ইন্ডিয়ার একটা প্রদেশ হিসাবে পুনঃপ্রত্যাবর্তনই হবে তার ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে মঙ্গলজনক। আশ্চর্য যুক্তি বটে! তার মানে তারা কোন দিনই এ অঞ্চলের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেনি। যে বাংলা ভাষা নিয়ে এতো লম্ফঝম্ফ তা নিয়েও তাদের মাথা ব্যথা নেই। তারা নিশ্চয়ই জানে যে ভারতের অংশ হিসাবে বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা হবে হিন্দী। তাহলে পাকিস্তান বিরোধী যে আন্দোলনের পরিণতি হিসাবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, একদল লোক এটাকে পূর্ব পাকিস্তানের ভারতভুক্তির প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে কাজে লাগিয়েছে। এরাই বলছে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কারণে একটা অবাস্তব স্বপ্ন মাত্র। যারা ৪০ দশকে পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলো তারা চেয়েছিলো এমন একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা যাতে এই উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায় আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। পাকিস্তান থেকে এ অঞ্চল বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এর নৃতাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক চরিত্র বদলায়নি। সুতরাং বাংলাদেশ যদি বর্তমান প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে পারে তা হলে ৪০ দশকে আমরা যে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলাম তা অন্ততঃ আংশিকভাবে বাস্তবায়িত হবে। বাংলাদেশে তাই এক অদ্ভুত রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে। ”৭১ সালে যারা বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরোধিতা করেছিলো তাঁরাই বর্তমানে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রকৃত-সপক্ষ শক্তি। ”৭১ সালে যে চক্রান্তের বিরুদ্ধে তারা রুখে দাঁড়িয়েছিলো তার আসল রূপ বদলায়নি। শুধু বদলেছে কতগুলি লেবেল। দু”পক্ষের মধ্যে এই সংঘাত কিরূপ নেবে তার ওপর নির্ভর করছে এদেশের ১২ কোটি জনগণের সত্যিকার ভবিষ্যৎ।
(বইটির pdf version download করুন এখানে)