‘একাত্তরের স্মৃতি’ নিয়ে কথায় কথায় কিছু কথা
ক’দিন আগে একজন জুনিয়র বন্ধু ফোন করে বললেন যে তিনি একটি বই পুনর্মুদ্রন করতে চান। জুনিয়র বন্ধুটি যেহেতু ইতিমধ্যেই তিন তিনখানা সাহসী বই লিখেছেন-(১) আমি আলবদর বলছি, (২) দুই পলাশী দুই মীরজাফর, (৩) দুই পলাশী দুই আম্রকানন এবং যে কারণে আমি তার সাহসের এযাবৎকাল প্রায় দুই দশকব্যাপী প্রশংসা করে চলেছি, তাই এই নতুন সাহসী কাজে তার উৎসাহ এবং প্রশংসনীয় উদ্যোগে আমি না করতে পারিনি। যে বইটি পুনর্মুদ্রন করতে চান সেই বইটি জীবন স্মৃতির কিছু বিষয়ে লিখিত। মরহুম ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন এর ‘একাত্তরের স্মৃতি’।
বইখানির বিষয়াদি ১৯৯০ এর দশকের শুরুতে লিখিত। বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। এর আগে সেসব বিষয়াদি আশরাফ হোসাইন সম্পাদিত মাসিক ‘নতুন সফর’ এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। বস্তুতঃ আশরাফ হোসাইন লেখকের বাড়ীতে ১০৯নং নাজিমুদ্দীন রোডে গিয়ে বসে বসে দিনের পর দিন নোট লিখে নিতেন। তারপর ধারাবাহিকভাবে সেসব প্রতিমাসে ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করতেন। আমার মত অনেকেই সেসব পড়ে অভিভূত হতাম বটে। সৌভাগ্যবশতঃ আমরা মুসলিম রেনেসাঁ আন্দোলনের পক্ষে সেসব প্রকাশিত অংশবিশেষ সংকলিত করে লেখকের জীবিতকালেই বই আকারে (২০৭ পৃষ্ঠা) প্রকাশ করি। বইটি আমরা কোনরূপ বাণিজ্যিক কারণে প্রকাশ করিনি, করেছিলাম হরিয়ে যাওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য রেকর্ড করে রাখার জন্য। ভবিষ্যৎ বংশধরদের জানা-শোনার পরিধি-কিঞ্চিৎ হলেও সুস্পষ্ট করার কারণে। ভূরি ভুরি অসত্য, আধাসত্য, আজগুবি ও মনগড়া প্রপ্যাগান্ডার বিপরীতে সঠিক তথ্যাদি রেকর্ড করে রাখার উদ্দেশ্যে।
শুরুতে লেখকের কিছু পরিচিতি এবং আমার সাথে তাঁর সম্পর্কের কিছু জরুরী কথা বলা প্রয়োজন। সেসব বিষয় এখানে উলেখ করা এজন্য নয় যে, লেখকের অহেতুক একটি ইমেজের ছবি তুলে ধরা, বরং এজন্য যে তিনি ইতিমধ্যেই যেভাবে প্রায় হারিয়ে গেছেন-অথচ তাঁর মাপের একজন জ্ঞাণী-গুণী-মহান ব্যক্তির জীবন থেকে অনেক কিছুই শিখবার আছে। অনুকরণ করারও অনেক বিষয়ই আছে।
বর্তমান বাংলাদেশের মাগুরা জেলার আলোকদিয়া গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি বিগত শতাব্দীর ১৯২০ সালের ১৪ই জানুয়ারী জন্মগ্রহণ করেন। নিজস্ব মেধার কারণেই সেই সময়কালের পশ্চাদপদ মুসলমান সমাজের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবেই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পর্যায়ের লেখাপড়া কৃতিত্বের সাথে সম্পন্ন করে ১৯৫২ সালে ইংল্যান্ডের নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাত্র দু’বছরের গবেষণা কাজ শেষ করে বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইংরেজী সাহিত্যে পি.এইচ.ডি. ডিগ্রী কৃতিত্বের সাথে লাভ করেন। এ সময়ে তিনি ঢাকা ইউনিভার্সিটি-এর ইংরেজী বিভাগের লেকচারার পদে আসীন ছিলেন। সেখান থেকেই ডেপুটেশনে উচ্চতর ডিগ্রীর জন্য ইংল্যান্ডে যান। এর আগে ১৯৪২ সালে ইংরেজীতে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে কৃতিত্বের সাথে এম.এ. ডিগ্রী করেন। এরপর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে লেকচারার পদে প্রথম কর্ম জীবনে পদার্পণ করেন। উলেখ্য যে সে সময়কালে কলকাতা এবং বিশেষ করে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এই সময়েই তিনি ওখানকার ইংরেজী কমরেড পত্রিকায় সম্পাদকীয় লিখতেন। কমরেড ছিল মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান আন্দোলনের ইংরেজী ভাষার মুখপত্র স্বরূপ। এর আগে যখন তিনি ঢাকায় এম.এ. ক্লাসের ছাত্র তখনই ঢাকায় যে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ গঠিত হয়-অর্থাৎ পাকিস্তান বাস্তবে হাসিল হবার কয়েক বছর আগেই-তখন তাঁকেই করা হয়েছিল এই পরিষদের প্রধান বা চেয়্যারম্যান। সৈয়দ আলী আহসান যিনি কিনা তার চেয়ে তিনমাসের বয়সে ছোট এবং চাচাতো ও খালাতো ভাই তিনি ছিলেন সেক্রেটারী। সহকারী সেক্রেটারী ছিলেন তাদের আরও একটু ছোট সৈয়দ আলী আশরাফ। অর্থ্যাৎ তারা সবাই ছিলেন একই পরিবারের। প্রত্যেকেই ছিলেন মেধাবী এবং ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র। পরবর্তী জীবনে প্রত্যেকেই শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন। কলকাতায় যখন সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন ইসলামিয়া কলেজের লেকচারার পদে যোগদান করেন, তখনই সেখানে যে পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি কায়েম হয়, তারও তিনি চেয়্যারম্যান হয়েছিলেন। খেয়াল করার বিষয় এই যে পাকিস্তান কায়েম হবার কয়েক বছর আগে থেকেই তিনি শুধু পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখার কঠোর কর্মীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন মুসলমানদের কালচারাল বিষয়ে নেতৃত্বের পর্যায়েও কঠোরভাবে কর্মরত। এরপর পাকিস্তান ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট কায়েম হলে পর তিনি বদলি হয়ে আসেন সিলেটের এম.সি. কলেজে। সেখান থেকেই বছর খানেকের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ঢাকা ইউনিভার্সিটিতেই তিনি বিশ বছর ইংরেজী বিভাগের লেকচারার পদ থেকে প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান পর্যন্ত পদে কাজ করার পর ১৯৬৯ সালে রাজশাহী ইউনিভার্সিটির ভি.সি. পদে আসীন হন। সেখানে প্রায় আড়াই বছর থেকে পরে ১৯৭১ এর জুলাই মাসে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে একই পদে বদলি হন। এরপর তাঁর জীবনের ঘটনাদির কিছু বিবরণ তিনি সেই সময়ের বিশ বছর আগে লিখিত উল্লেখিত বইটিতে লিখে রেখেছেন।
আমার সাথে তাঁর পরিচয়ের কোন সুযোগ হয়নি ১৯৭৯ সালের আগে যদিও আমি যখন একাত্তরের সেই ভয়ানক দিনগুলিতে আইনের ক্লাসের ছাত্র ছিলাম, এবং তিনি ভি.সি. ছিলেন। ঢাকায় তখন আমি এস এম হলের অনাবাসিক ছাত্র হিসাবে তাঁর সাথে সামনা সামনি দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি প্রায় নিয়মিত ল’ এর ক্লাস করার সময়ে। তবে নামে চিনতাম বৈকি।
১৯৭৯ এর শেষে কিংবা ১৯৮০ এর প্রথমে তাঁর সাথে ১০৯নং নাজিমুদ্দীন রোডে তাঁর একটি মেসেজ পেয়ে সেখানে তাঁর সাথে দেখা করতে গেলাম। মেসেজটি ছিল লন্ডনের আমার এক ঘনিষ্ঠজনের। সাজ্জাদ সাহেব তখন মক্কার উম্মুল কুরা ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজীর অধ্যাপকের চাকুরী করতেন। লন্ডন হয়ে ঢাকা আসবার সময় আমার সেই বন্ধু ডঃ মতিয়ুর রহমান তাঁর মাধ্যমেই আমাকে মেসেজটি পাঠিয়েছিলেন। আমার সৌভাগ্য হল যে আমি সেই সুযোগে তাঁর সাথে প্রথম পরিচিত হতে পারলাম। এর আগে একাত্তরের পর তাঁর মত আরও অনেক জ্ঞাণী-গুণীরা যে বাংলাদেশে ধিকৃত হয়ে চলেছিলেন তা আমাকে চরম ব্যাথা দিত। আমি তাঁদেরই একজনের সাথে সৌভাগ্যবশতঃ পরিচিত হতে পারলাম।
এরপর তিনি ক’দিন পর সৌদি আরবে চাকুরীতে চলে গেলে পর আমি পত্রে তাঁর সাথে যোগাযোগ রাখি। তিনিও নিয়মিত আমার পত্রের উত্তর দিতেন। ১৯৮২ সালের অক্টোবরে আমি একটি বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য লন্ডন চলে যাই। সেখানে গিয়ে তাঁর সাথে পত্রে যোগাযোগ একইভাবে করে চলি। মধ্যে আমি যখন ১৯৮৫ সালের এপ্রিলে ঢাকা ফিরে আসি, তখন তিনি শারীরিক অসুস্থ্যতার জন্য মক্কা থেকে পূর্ণ অবসর নিয়ে ঢাকা চলে আসেন। এ সময় বছর খানেক আমি ও উনি উভয়েই ঢাকায় থাকি। তখন মাঝে মধ্যেই দেখা-সাক্ষাৎ হত। কথাবার্তাও হত অনেক বিষয়ে। এরপর আমি আবার লন্ডন চলে যাই আমার সেখানে থিসিস এর কাজ শেষ করার জন্য। এই কাজ শেষ হতে অনেক সময় লাগে। একটি কারণ এই ছিল যে আমি এক্সটারনাল ছাত্র হিসেবে থিসিস করতাম পূর্ণকালীন ছাত্র হবার মত অর্থ-ফি দেয়ার সামর্থ ছিলনা এবং একই সাথে পার্ট টাইম কাজ করতে হত জীবন ধারণ এবং একই সাথে দেশে পরিবারের খরচপাতি যোগান দেয়ার জন্য। তবে তাঁর সাথে পত্র যোগাযোগে কোনরূপ গাফিলতি করিনি। আর তিনিও প্রতিটি পত্রেরই জবাব দিতেন বলা যায় তড়িৎ। কোন সময় একটু দেরী হলে এপোলোজি চাইতেন। আমি লজ্জা পেতাম, তাঁর সাথে এভাবে প্রায় ৮/৯ বছর যাবৎ যেসব পত্রালাপ করেছি তাঁর উত্তর ছিল মোট ৬৪টি। এসবের ৬২টি চিঠি পরে ২০০৪ সালের শেষে তাঁর ইন্তেকালের ১০ম মৃত্যু বার্ষিকীতে (১২/০১/০৫ইং) 62 Letters of Dr Syed Sajjad Husain এই শিরোনামে প্রকাশ করতে পেরে আমি আল্লাহর হাজার হাজার শোকরিয়া করেছিলাম। তাঁর যে দু”টি চিঠি এই বইটিতে সংযোজিত করতে পারিনি তার কারণ এই যে ঐ দু’টি তখন আমি অনেক খোঁজাখুঁজি করেও হাতের কাছে পাইনি, অনেক পরে বইটি ছাপানোর পর পেয়ে গিয়েছিলাম।
আমি লন্ডন থেকে ১৯৮৯ এর শেষে ঢাকা ফিরে আসার পর আর মাত্র পাঁচটি বছর তিনি বেঁচে ছিলেন। এ সময় প্রায়ই দেখা সাক্ষাৎ হত। দেশ নিয়ে আলোচনাও করতাম। এ সময় তিনি লেখালেখি করতেন। আমি প্রায়ই ডিকটেশন নিতাম বিশেষ করে ইংরেজী ডিকটেশনগুলি যা আমি নিজেই কম্পিউটারে টাইপ করে দিতাম। আমি নিজেও কোন কিছু লেখা তাকে দেখাতাম বিশেষ করে ইংরেজী শুদ্ধ করার জন্য। এ সময়েই তাঁর ইংরেজীতে লেখা জেলখানায় বসে মেমোইরস আকারের পান্ডুলিপিটি লন্ডনের সেই একজন ঘনিষ্ঠজনের হেফাজত থেকে উদ্ধার করা হয়। ওটির একটি ফটোকপি বাঁধাই করে তিনি আমার হাতে দেন। আমি কিছু বন্ধু-বান্ধবদের কাছে ধর্ণা দিয়ে ওটি মুদ্রিত বই আকারে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করি। ওটির প্রুফ উনি দেখে দিচ্ছিলেন। দুর্ভাগ্য এই যে ওটির সম্পূর্ণ প্রুফ দেখে শেষ করার আগেই ১৯৯৫ সালের ১২ই জানুয়ারী তিনি অকস্মাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ৭৫বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। এর আগের দিন ১১ই জানুয়ারী সন্ধ্যার আগে আমার সাথে তাঁর শেষ সংক্ষিপ্ত দেখা হয়। সে দিনই প্রায় ঘন্টাখানেক আগে তিনি একটি সুদীর্ঘ ইংরেজী নিবন্ধ লিখে লন্ডনের ইংরেজী পাক্ষিক ইমপ্যাক্ট এর ঢাকায় আগত একজন সাংবাদিকের হাতে দিয়ে দেন। ঐ পত্রিকায় তিনি ছদ্মনামে লিখতেন। তবে সেই নিবন্ধটি সেভাবেই প্রকাশিত হলে পর সম্পাদক সেই আইটেমটির শেষে নোট দিয়ে তার আসল নামঠিকানা প্রকাশ করে তাঁর ইন্তেকালের খবরও দেন। সেই পাক্ষিকটি-ইমপ্যাক্ট ইন্টারন্যাশনাল-এ আমি নিজেও মাঝে মধ্যে ছোট-খাটো নিবন্ধাদি লিখতাম এবং তাই সেই সম্পাদকের সাথে পরিচয় ছাড়াও মরহুম সাজ্জাদ সাহেবের কয়েকটি ছদ্মনামও আমি জানতাম। একটি ছিল নাসিম হায়দার। ঢাকায় প্রকাশিত তার লেখায় ছদ্মনাম ছিল আল-বোগদাদী, (বাগদাদ থেকে পূর্ব পুরুষরা এসেছিলেন), আলতাফ আলী (তাঁর দাদার নাম) ইত্যাদি। আমার সাথে পত্রালাপেও তিনি কোন কোন সময় আলতাফ আলী ব্যবহার করতেন। এ ধরণের ছদ্মনাম ব্যবহারের কারণ আন্দাজযোগ্য। একদিকে সাবধানতা, অন্যদিকে ভীতিও। তাঁর শেষ জীবনে আমার যে প্রায় ১৫ বছরের যোগাযোগ তাতে আমার মনে হয়েছে যে শত ভয়-ভীতি, হুমকি, জীবন-জীবিকা নিয়ে অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর মুসলিম জাতিসত্ত্বার এবং সেই কারণে পাকিস্তান কায়েমের মূল আদর্শ এবং লক্ষ্য থেকে তিলমাত্রও নড়চড় হননি। একই সাথে ১৯৭১ উত্তর বাংলাদেশ যেন সেই সত্ত্বার ভিত্তিতেই টিকে থাকে, তাইই তিনি কামনা করতেন। তবে এও মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদের চতুর্মূখী আগ্রাসী থাবা-যে থাবারই অংশ ছিল সেনা আক্রমণ-তা থেকে তুলনামূলকভাবে অতি ক্ষুদ্র বাংলাদেশ আত্মসম্মান নিয়ে চিরস্থায়ীভাবে সার্বভৌম অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকবে তাতে তিনি গভীর সন্দেহ পোষন করতেন। তাঁর ইন্তেকালের ক’দিন আগে সেই নাজিমুদ্দিন রোডের বাড়ীতে বসেই তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি তো চলে যাচ্ছি (অর্থাৎ পরপারে) এরপর যাদের রেখে যাচ্ছি তারা স্বাধীনভাবে বাঁচবে নাকি গোলাম হবে, সে দুশ্চিন্তা নিয়েই যেতে হচ্ছে’। প্রসঙ্গতঃ একটি ঘটনা বোধ করি এখানে উলেখ করা যায়। ঘটনাটি আমি ওনার ইন্তেকালের অনেক পর কিছুদিন আগে শুনেছি। যার মুখে শুনেছি এবং রিকনফার্ম করেছি তিনি এখানও সুস্থ সবল ভাবে বেঁচে আছেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরতও আছেন শেষ বয়সে। তিনি একাত্তরের পর স্বল্প সময়ের জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হাজতবাস করেছিলেন, কেননা, তিনি একজন ইসলামী বিষয়ে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার পদে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি বা শেষ সময়ে যখন সাজ্জাদ সাহেব ইংল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কাজে ফেলোর অফার পান, তখন তাঁর পাসপোর্ট নেয়ার প্রয়োজন হয়। কিন্তু যেহেতু তিনি ‘দালাল’ আইনে অভিযুক্ত হয়ে জেলে হাজতবাস করেছেন দুটি বছর তাই তার পাসপোর্ট পাবার জন্য খোদ প্রাধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের লিখিত ক্লিয়ারেন্স নেয়ার নিয়ম ছিল। এই ক্লিয়ারেন্স নেয়ার জন্য সেই লেকচারার সাহেব সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। প্রধানমন্ত্রী সেই লেকচারারকে যেহেতু ঘনিষ্ঠভাবেই চিনতেন, তাই তিনি ক্লিয়ারেন্স লিখে দেন। সেই সাথে প্রধানমন্ত্রী এও নাকি আফসোস করে বলেন যে ‘আমার বাংলাদেশে আমার শিক্ষকই থাকতে পারছেন না’। বলাবাহুল্য যে এই তিনি যখন ১৯৪০ এর দশকে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র, তখন সাজ্জাদ সাহেব ঐ কলেজেরই ইংরেজীর লেকচারার ছিলেন। এই একই রাজনীতিকের একটি উদ্ভট উক্তি, করাচীর এল্ফিস্টোন রোডের মত অতি পুরাতন রাস্তা নাকি পূর্ব পাকিস্তানের পাটের টাকায় সুদৃশ্য করা হয়েছিল, তার উলেখ একাত্তরের স্মৃতি’তে লেখক নিজেই উলেখ করেছেন। এটি ১৯৫৬ সালের কথা। ওখানে ঘটনাচক্রে করাচীর সদর এলাকায় দেখা হওয়াতে তিনি তেমনটি মন্তব্য করেছিলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শের প্রতি তার গভীর আস্থা ও বিশ্বাসের সাথে সাথে তিনি পাকিস্তানের শাসকদের অবিবেচক এবং নির্বুদ্ধিতার বিষয়ও শুধু ঐ বইটিতেই নয়, বরং আরও অনেক জায়গাতেই বিশেষণ করে দেখিয়েছেন। আমাকেও মাঝে মধ্যে বুঝিয়ে বলতেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর জেলখানায় বসে ইংরেজীতে দু’বছরকাল ব্যাপী লেখা অনেকটা আত্মজীবনীমূলক বইখানি- THE WASTES OF TIME: REFLECTIONS ON THE DECLINE AND FALL OF EAST PAKISTAN (1995)– ঐতিহাসিকভাবে সেসব অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সমাহার বটে। এই বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ পাকিস্তানে প্রকাশিত হয়েছিল বলে আমি জেনেছিলাম। এখানেও একটি দ্বিতীয় সংস্করণ বের করতে পারলে ভাল হত। সাজ্জাদ সাহেবের জীবিতকাল নয়, বরং তাঁর ইন্তেকালের ১০ মাস পর ঐ পরিবারেই আমাদের বড় ছেলে বিয়ে করে। এ কারণে ঐ পরিবারের অনেক তথ্যাদি পরে আমার জানার সুযোগ হয়েছিল। ঐ পরিবারের একই আলোকদিয়ার বাড়ীতে যারা চাচাতো ও খালাতো ভাই-বোন হিসেবে বড় হয়েছিল, তাদেরই সবচেয়ে বয়সে যিনি বড় ছিলেন, অর্থ্যাৎ আমার বড় ছেলের বউ এর নানী তার মুখেই শুনেছি যে সাজ্জাদ সাহেব সেই ছোট বেলাতেই সবচেয়ে বেশী বুদ্ধিমান ছিলেন। সৈয়দ আলী আহসান তাঁর তিন মাসের বয়সে ছোট ছিল এবং কম বুদ্ধিমান ছিল। একই সাথে পরবর্তীতে আমরা যা দেখি তা হল, অন্য অনেকের মত তিনি আদর্শিক প্রশ্নে কোন কমপ্রোমাইজ করতেন না। অটল অনড় থাকতেন। অন্যদিকে ক্ষণিকের বাহবা পাবার জন্যও তিনি সস্তা কোন কথা বলতেন না। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন এই মহামানবটি কোনরূপ ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরোধী ছিলেন। পরিবারে পীরমুরিদীর রেওয়াজ বা সিলসিলা থাকলেও তিনি তা পছন্দ করতেন না। অথচ নিজে ছিলেন মনে-প্রাণে পাক্কা ঈমানদার মুসলমান। একই সাথে আধুনিক চিন্তা, চেতনা এবং অভ্যাসের একজন উন্নত রুচির মানুষ। বাইরের কোন দাওয়াতে এমনকি ইফতার পার্টিতে গেলেও তিনি তার জামার পকেটে ফর্ক-স্পুন ও টিস্যু পেপার নিয়ে যেতেন-হাত-ধোয়া মোছার জন্য পানির খরচ বাঁচাবার এবং কাউকে বিরক্ত না করার জন্য। অনেকে এতে আড়চোখ করত। কিন্তু তিনি কোন কিছু মনে করতেন না। ১৯৭৪ সালের শেষে এবং পঁচাত্তরের প্রথম দিকে সাজ্জাদ সাহেব ইতিহাসের ডঃ মোহর আলী, রাজনীতি বিজ্ঞানের ডঃ হাসান জামান কিছু কিছু ছোটখাট গবেষণার কাজ নিয়ে ইংল্যান্ডে যান। তখনও আমি লন্ডনে থাকতাম। এ সময়ে সাজ্জাদ সাহেবের সাথে কোন যোগাযোগ আমার হয়নি; কেননা, উনি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে একজন গবেষণা ফেলো হিসেবে যোগদান করেছিলেন। তবে মোহর আলী এবং হাসান জামান যেহেতু লন্ডনেই ছিলেন কিছুদিনের জন্য তাই এদের দু’জনের সাথে আমার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছিল। একদিন মনে পড়ে হাসান জামানকে একটি দোকান থেকে সস্তায় হোমিওপ্যাথি ঔষধ কিনে দিয়েছিলাম। আর একদিন ডঃ মতিয়ুর রহমান তার অর্থ কষ্ট কিছুটা হলেও কমানোর জন্য মাত্র ১০টি পাউন্ড এর একটি নোট আমার হাতে করেই তাকে পৌঁছিয়েছিলেন। ঐ সময়ে সাজ্জাদ সাহেবের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ পরিচয় না হলেও পরে ১৯৮৪ সালে তিনি যখন মক্কা থেকে চাকুরীতে ছুটি নিয়ে লন্ডন হয়ে ঢাকা যাচ্ছিলেন, তখন সেখানে তিনি উঠেছিলেন ডঃ মতিয়ুর রহমানের বাড়ীতে ৬৫ এলফিনস্টোন স্ট্রীটের ঠিকানায়। তার বছর আড়াই আগেই মতিয়ুর রহমান ইন্তেকাল করেছিলেন। উনার ঐ বাড়ীতে উঠার একটি কারণ এই ছিল যে তিনি মতিয়ুর রহমানের সর্বশেষ বইটির পান্ডুলিপি সংশোধন করছিলেন, এ বিষয়টি তিনি আমাকে সরাসরি বলেননি, নির্ভরযোগ্য সূত্রে শুনেছি খুব সম্ভব ইতিহাসের অধ্যাপক ওয়াহিদুজ্জামান ভাই এর কাছে। আরও শুনেছি যে তিনি মতিয়ুর রহমান এর ছ’টি মূল্যবান ঐতিহাসিক বই এর সবগুলিই দেখে দিয়েছিলেন ইংরেজী ভাষায় বিভিন্ন উন্নত শৈলী-সংযোজন করার জন্য। মতিয়ুর ১৯৫০ এর দশকের শুরুতে ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ছিলেন, তিনি মরহুম আবুল কাসেম এর সাথে বাংলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস-প্রিন্সিপ্যালও ছিলেন। ছাত্রলীগ করতেন। তবে ১৯৮২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী লন্ডনে ইন্তেকাল করলে পর তারই ইচ্ছা অনুসারে তার নিজের জন্মস্থান আহম্মদপুর-নবীনগর ব্রাহ্মনবাড়িয়া নয়, বরং ইসলামাবাদের জাতীয় কবরস্থানে দাফন করা হয় (কবর নং ৪/৩১)। এক সময় ২০০৩ সালে আমি সে কবর জেয়ারত করেছি, একই সাথে পাবনার সাংবাদিক ফজলুর রহমানের কবরও। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে সেই একই কবরস্থানে জেয়ারত করি মরহুম মাহমুদ আলীর কবরও। উপরে যে ক’জন ক্ষনজন্মা পুরুষের নাম করলাম তারা সাজ্জাদ সাহেবের মতই একই মুসলিম জাতিসত্ত্বার আদর্শে বিশ্বাস করতেন। যেমন পাকিস্তান জাতিসত্ত্বার চিরন্তন রূপে বিশ্বাস করার কারণেই চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় সেই একাত্তরের পর এখানও বাংলাদেশে ফিরেন নাই। তাঁর মা বিনীতা রায় এবং ছেলে দেবাশীষ রায় পালাক্রমে বাংলাদেশের মন্ত্রীর পদে আসীন হলেও। আমার সাথে ত্রিদিব রায়ের ইসলামাবাদে দেখা হয় সর্বশেষ ২০০৪ এ। এত বয়সেও তার মানসিক সাহস দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। সাজ্জাদ সাহেবের মধ্যে স্বাতন্ত্র চেতনা খুবই তীক্ষ্ণ ছিল। এ কারণে তিনি বিগত শতাব্দীর নব্বই এর দশকের শুরুতে ইন্তেকালের অল্প কিছুদিন আগে একখানা ইংরেজী-বাংলা ডিকসনারী তৈরী ও সম্পাদনায় হাত দেন। এটির বাংলা শব্দাদির ব্যবহারে তিনি স্বাতন্ত্র্যের সচেতন দৃষ্টি রেখেছিলেন। সেটির কাজ তিনি শেষ করেছিলেন বটে, তবে আজও মুদ্রিত আকারে সেটি আলোর মুখ দেখেনি। দেখবে কিনা এখানো বলা যাচ্ছে না। তাঁর এ ধরণের স্বাতন্ত্র্য চেতনা এবং কাজ কর্মকে অনেকে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ লেবেল দিতে চেয়েছে। এ কারণে আরও তার বিরুদ্ধে দোষারোপ করা হয় যে তিনি ঢাকা হাই মাদ্রাসা পড়া ছাত্র ছিলেন। অথচ আমি অনেক উদাহরণ দেখেছি যে তার অনেক উচ্চশিক্ষিত অমুসলমান ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব ছিল। তার ইন্তেকালের আগে দেখতাম যে তাঁরই বাসার বৈঠকখানায় একজন প্রৌঢ় হিন্দু ভদ্রলোক তার ছেলের ইংরেজী পি.এইচ.ডি. থিসিস নিয়ে কোন কোনদিন একা এবং কোনদিন ছেলেসহ আলোচনাদি করতেন। এজন্য তিনি কোন পারিশ্রমিক নিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। তাঁর মুখেই শুনেছিলাম তার কোন কোন প্রাক্তন ছাত্র ইংরেজীর অধ্যাপক হয়ে নাস্তিক মার্কসিষ্ট হয়েছিলেন তাতে তিনি কষ্ট পেলেও মেনে নিতেন। ১৯৮৪ সালেরই ঘটনা। একদিন লন্ডন থেকে ট্রেনে করে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে তাঁরই কাজে তাকে সঙ্গ দিয়েছিলাম। তিনি ১৯৭১ এর পর লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতেন একটি পায়ে জোর পেতেন না। সেই ট্রেনেই একজন ভারতীয় হিন্দু অধ্যাপকের সাথে অল্পক্ষণের মধ্যেই খুব খাতির জমিয়ে বসলেন। সেদিনই কেমব্রিজের একটি লাইব্রেরী থেকে তিনি আমাকে কয়েকটি বই কিনে উপহার দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ছিল ড্যমিনিক ও ল্যাপ্যারির ‘ফ্রিডম এ্যাট মিড নাইট’। সেই চুরাশির জুনে তিনি যখন বেশ কদিন লন্ডনে ছিলেন, তখন কেউ কেউ তার সাথে দেখা করতে চাইলে আমিই সময় ফিক্স করে দিতাম। তবে মনে পড়ে একজনের সাক্ষাৎকারে তিনি রাজী হননি, ব্যক্তিটি ছিলেন তার একাত্তরের ঢাকার শেষ সময়ের ভিসি এর পি.এ., তিনি তখন কোন একটি সংক্ষিপ্ত কোর্স করার জন্য লন্ডনেই ছিলেন এবং আমার সাথে পরিচয় ছিল। লন্ডনের আর একদিনের ঘটনা আমার মনে পড়ে। তিনি আমাকে নিয়ে অক্সফোর্ড ষ্ট্রিটের মার্কস এন্ড স্পেনসারের দোকান থেকে একশ পাউন্ড দামের একটি স্যুট কিনেন, এবং চার্চ স্যু এর দোকান থেকে ষাট পাউন্ড দিয়ে এক জোড়া জুতা কেনেন। মার্কস এন্ড স্পেন্সার মধ্যবিত্তদের পোষাকের দোকান হলেও চার্চ স্যু কিন্তু তা ছিল না, এখনও নয়। চার্চ স্যু’ই আমি যতটুকু জানতাম লন্ডনের সবচেয়ে দামী এবং অভিজাত জুতার দোকান। পরনের কাপড়-চোপড় এর ব্যাপারে তাঁকে খুবই কেতাদুরন্ত দেখা যেত। একই সাথে খাবার ব্যাপারে বেশ চুজি ছিলেন। এ কারণেই কিনা তিনি খুব ভাল কিছু রান্না-বান্না নিজেই করতেন। এমনকি নাজিমুদ্দীন রোডের বাড়ীতেও ভিন্ন অনেক কাজের এবং রান্না-বান্না করার লোকজন থাকা সত্ত্বেও বিশেষ করে মেহমানকে খাওয়ানোর জন্য। তার এ ধরণের কেতা দুরস্ত হাব-ভাবের জন্য অনেকেই তাঁর বিরূপ সমালোচনা করত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন তিনি শিক্ষকতা করতেন তখনও তার নিন্দুকের অভাব ছিল না। এমনকি ঘোর পাকিস্তানপন্থীরাও। কেননা, তাঁর কাছে অন্যায়-যেই করুক না কেন, অন্যায় বলেই তিনি তেমন খারাপ কাজের জন্য সবাইকে তিরস্কার করতেন। যেমন করতেন ভূল ইংরেজী উচ্চারণের জন্যও। একাত্তর সালে যখন তিনি নিজের আদর্শিক রাজনৈতিক অবস্থান নেন, তখন তাঁর বিরুদ্ধে প্রচারণাগুলি আরও মারাত্মক আকার ধারণ করে। তাই ঐ সময়ে কলকাতা বেতার থেকে সরাসরি দেবদুলালরা নয় বরং আখতার মুকুল ধরনের অনেকেই তাঁকে শাসাতে থাকে যে তাঁকে তাঁর অফিসেই খুন করা হবে। সেই খুনটিই ওরা সেই অফিসেই না করতে পারলেও সেই ইউনিভার্সিটিরই একটি কক্ষে তেমনটি করে মৃত মনে করে ২০শে ডিসেম্বর (৭১) অতি ভোরে তার ‘মৃতদেহ’ গুলিস্তানের সেই মুসলমান আমলের যুদ্ধে ব্যবহৃত কামানের পাশে ফেলে রেখেছিল। কেমন করে সেই মৃত লাশটি বেঁচে গিয়ে আরও প্রায় ২৪টি বছর বেঁচে থেকে এদেশের অসংখ্য অজ্ঞ মানুষের জন্য বেশ কিছু শিক্ষনীয় বিষয় লিখে রেখে গেছেন-তাঁর একাত্তরের স্মৃতি বইখানি তারই একটা উজ্জ্বল নমুনা বলেই আমি বিশ্বাস করি।
মোহাম্মদ তাজাম্মুল হোসেন তারিখঃ ২৩শে মে, ২০০৯ইং ঢাকা-১২০৬’
(বইটির pdf version download করুন এখানে)