অধ্যায় ৩: ষড়যন্ত্রের পটভূমি
ষড়যন্ত্রের পটভূমি
পাকিস্তান ধ্বংস হতে চলেছে এটা যেনো চোখে দেখেও আমার বিশ্বাস হতে চাইতো না। ১৯৪৭ সালের কথা। আমার মনে আছে যে উৎসাহ ও আশা নিয়ে লাখ লাখ নর-নারী এই নতুন রাষ্ট্রের আবির্ভাবকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলো সেটা আমার বয়সের লোকের ভুলবার নয়। ৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট আমি কোলকাতায় ছিলাম। এ কারণে ব্যক্তিগতভাবে ঢাকায় যে উন্মাদনাময় পরিবেশের মধ্যে পাকিস্তান জন্ম লাভ করে তাতে আমি অংশ গ্রহণ করতে পারিনি। কিন্তু মিছিল, শোভাযাত্রা ইত্যাদির বিবরণ পড়ে কল্পনার নেত্রে সে দৃশ্য অবলোকন করতে অসুবিধা হয়নি। তার একটা বড় কারণ, আমি নিজেও এ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আমরা বিশ্বাস করতাম যে ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক সমস্যার একমাত্র নির্ভরযোগ্য সমাধান এই উপমহাদেশকে বিভক্ত করে হিন্দু ও মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করা। ভাষা বা ভৌগলিক বৈচিত্রের কোন গুরুত্ব নেই, এ কথা কখনো আমরা বলিনি। কিন্তু ভাষা এবং আঞ্চলিক কালচারের ভিত্তি মেনে নিলে ভারতবর্ষকে অন্ততঃ বিশটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করার প্রয়োজন হবে, কারণ ‘ভারতীয়তা’ বলে কোন বস্তুর অস্তিত্ব ছিল বলে আমরা বিশ্বাস করতাম না। যদি বলা হয় যে পাঞ্জাবী মুসলিম বা পাঠান মুসলিমের সঙ্গে বাঙ্গালী মুসলিমের তফাত অনেক, এ কথা তো হিন্দু সম্প্রদায় সম্পর্কে আরো সত্য। মুসলমানের ধর্ম বিশ্বাস এবং ধর্মীয় আচার পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বিশেষ কোন পার্থক্য লক্ষ্য করা যাবে না। কিন্তু ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দু ধর্মের রূপ বিভিন্ন। যে সমস্ত দেবতা দক্ষিণ ভারতে বা পশ্চিম ভারতে অর্চিত হন, বাংলা বা আসামে তাদের কেউ পূজা করে না। রাম উত্তর ভারতে দেবতা বলে স্বীকৃত, বাংলায় তিনি রামায়ণের নায়ক মাত্র। এ রকমের আরো ভিন্নতার কথা উল্লেখ করা যায়। সে জন্য জওহরলাল নেহেরুর মতো যাঁরা সেকুলার ভারতীয়তার কথা বলতেন তাঁরা প্রকারান্তরে বুঝাতে চাইতেন যে ভারতীয় কালচারের অর্থ হিন্দু ধর্মভিত্তিক কালচার। ১৯৬২ সালে – ‘৪৭ সালের ১৫ বছর পর নেহেরুরর এক বক্তৃতায় যে কথা স্বকর্ণে শুনেছিলাম তাতে আমার ঐ উক্তির সমর্থনই ছিল। দিল্লীর এক সভায় দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন যে, ভারতীয় সংস্কৃতির সৌধ সম্পূর্ণভাবে সংস্কৃত ভাষার উপর প্রতিষ্ঠিত। অবশ্য এ কথাই ৪০-এর দশকে প্রকাশিত তাঁর ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ বইটিতে তিনি আরো সবিস্তারে বিবৃত করেছেন। ভারতবর্ষের যে রূপ তিনি আবিষ্কার করেছিলেন বলে দাবী করেন তার মধ্যে সাতশ’ বছর ধরে ভারতের বুকেই মুসলমানেরা যে সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলো তার কোন সন্ধান ছিলো না। এই সত্যের উপরই পাকিস্তান আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে। তাই তখন যে যাই বলুক ধর্ম বিশ্বাসকে আমরা এ অঞ্চলের মানুষের প্রধান পরিচয় রূপে স্বীকার করে নিয়েছিলাম এবং এই কারণেই উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতের অনেক মুসলমান যেমন পশ্চিম পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিলো তেমনি বিহার-উড়িষ্যা এবং আসাম থেকে বহু মুসলমান বিতাড়িত হয়ে পাকিস্তানে নীড় বাঁধবার চেষ্টা করে। ৭০-৭১ সালে আমরা শুনলাম যে এই নবাগতরা সবই বিদেশী, তাদের না তাড়ালে এ অঞ্চলের আদিবাসীদের পরিত্রাণ নেই।
আরো দুঃখ্য পেলাম এই ভেবে যে ১৯৪৭ সালে যারা এক রকম জোর করে আমাদের বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করতে বাধ্য করে এবং যারা তাদের রাষ্ট্রের ঐক্য এবং সংহতির খাতিরে নির্দ্বিধায় হিন্দীকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে তারাই সেদিন আমাদের শিখিয়েছিলো যে পাকিস্তানকে ভেঙ্গে ফেললেই আমরা সমস্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা থেকে রক্ষা পাবো। অথচ দিল্লীর শাসন বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশ আন্দোলনে যোগ দেয়ার কথা কেউ বলেননি।
পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ কোন সমস্যা ছিলো না তা নয়। দুই অঞ্চলের মধ্যে বৃটিশ যুগের দুঃশাসনের কারণে একটা অর্থনৈতিক বৈষম্যেরও সৃষ্টি হয় যার জের পাকিস্তানকে টানতে হয়েছে। ক্লাইভ ১৭৫৭ সালে এ অঞ্চলেই প্রথম বৃটিশ সাম্রাজ্যের পত্তন করেন। তারপরের দেড়শ’ বছরের কাহিনী শুধু বঞ্চনা, লুণ্ঠন এবং প্রতারণার কাহিনী – যে কাহিনীর সত্যতা কোনো বৃটিশ বা হিন্দু ঐতিহাসিকও অস্বীকার করেননি। পূর্ব বঙ্গের সম্পদ দিয়ে গড়ে উঠেছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী কোলকাতা। সারা পূর্ব বঙ্গে শহর বলে কোন কিছু ছিলো না। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা প্রভৃতি শহরকে আধুনিক অর্থে কেউ শহর বলতো না। আমার বেশ পরিস্কার মনে আছে, পঞ্চাশের দশকে যখন গুলিস্তানের রাস্তা নির্মিত হয়েছে এবং দু’ একটা বড় দালান-কোঠা আজিমপুর এবং মতিঝিলে গড়ে উঠেছে তখন আমার এক আমেরিকান বন্ধুকে নারিন্দা অঞ্চলে নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, আজ রুরাল বেঙ্গল সম্পর্কে একটা আইডিয়া করতে পারলাম। আমি চমকে উঠেছিলাম সত্য কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়েছিলো যে ইউরোপ বা আমেরিকাবাসীর কাছে নারিন্দা অঞ্চলের সঙ্গে তাদের পল্লীর তফাৎ থাকতে পারে না। বরঞ্চ অনেক ইউরোপীয় বা আমেরিকান গ্রাম আরো সুন্দর ও সুঠাম। এই ঢাকাই হলো আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীরা লাহোর এবং করাচীর মতো দু’টো বড় শহর পেলো। করাচী অপেক্ষাকৃতভাবে নতুন নগর কিন্তু লাহোরের বয়স পাঁচ ছ’শ বছরের। এ দু’টি শহরই ছিলো দু’টি প্রদেশের রাজধানী। কিন্তু হঠাৎ করে লাহোর এবং করাচীর সঙ্গে ঢাকার বৈষম্যের জন্য দায়ী করা হলো পাকিস্তানকে। আরো বলা হলো যে পাটের টাকা দিয়ে করাচী এবং লাহোর স্ফীত হয়ে উঠেছে। ঢাকার ভাগ্যে কিছুই জোটেনি। ১৯৫৬ সালে করাচীতে একদ্গন হঠাৎ করে একজন বিখ্যাত আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তাঁকে ৪৪ সাল থেকেই চিনতাম। আমি যখন ইসলামিয়া কলেজের লেকচারার শেখ মুজিবুর রহমান তখন সেখানে ছাত্র এবং আমাদের মতো তিনিও এককালে পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। যখন তিনিই বললেন, স্যার দেখেছেন, এলফিন্টস্টোন রোডের সমস্ত চাকচিক্যের মূলে রয়েছে পূর্ব বঙ্গের পাট, আমি বিস্ময়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে ভেবেছিলাম এ নতুন তথ্য তিনি আবিষ্কার করলেন কোথায়? এ রাস্তাটির বয়সও যেমন কমপক্ষে পঞ্চাশ-ষাট বছর তেমনি দোকানগুলিও প্রাক-পাকিস্তান যুগের। কিন্তু তিনি তখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে পশ্চিম পাকিস্তানের সবকিছুর মূলে রয়েছে বঞ্চিত, অবহেলিত, শোষিত পূর্ববঙ্গের দান। কিন্তু এই যুক্তি আমরা কিভাবে স্বীকার করি? অথচ ‘৭১ সালে যে বিষ্ফোরণ ঘটে তখন লাখ লাখ বাংগালী তরুণ এই বিশ্বাস নিয়েই সংগ্রামে নেমে ছিলো যে পাকিস্তানে থেকে তারা শোষণ ছাড়া আর কিছুই প্রত্যাশা করতে পারে না।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি আইয়ুব খানের আমলে এক সেমিনারে আঞ্চলিক বৈষম্যের কথা আমি নিজেও তুলেছিলাম। বলেছিলাম যে এ বৈষম্যের ঐতিহাসিক কারণ যাই হোক, বৈষম্য নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক আবহাওয়া ধোঁয়াটে হয়ে উঠেছে; জনসাধারণের মনে এই বিশ্বাস সৃষ্টি করা হয়েছে যে কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলা এই বৈষম্যের হেতু। আমি আরো বলেছিলাম যে বাস্তব রাজনীতিতে অনেক ক্ষেত্রে সত্যের চাইতে অনুভূতি প্রধান হয়ে ওঠে। পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের এক বিরাট অংশ যেখানে সত্য সত্যই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে বৈষম্যের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার দায়ী, সেখানে অবিলম্বে জাতীয় সংহতির খাতিরে কতকগুলি পদক্ষেপ নেয়া অত্যাবশ্যক। সিনিয়রিটির দোহাই দিয়ে যদি প্রশাসনে এবং মিলিটারিতে কোনো পূর্ব পাকিস্তানীকে স্থান দেয়া না হয় তবে তার পেছনে যত যুক্তিই দেখানো হোক তার ফলে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হবে, পাকিস্তানের ভিত্তিমূল দূর্বল হয়ে উঠবে। কিন্তু বৈষম্যের কারণে পাকিস্তানকে টুকরো করে নিজেদের পায়ে কুড়াল মারতে হবে এই ধারণা বা অশঙ্কা আমার মাথায় কখনো আসেনি। আমার সে বক্তৃতা পরদিন বড় হরফে ইত্তেফাকে বেরিয়েছিল।
বিহারী ও হিউগেনো
উর্দু ভাষী বিহারী যারা পূর্ব পাকিস্তানে ইন্ডিয়া থেকে হিজরত করে এসেছিলো তাদের আদর্শবাদিতা এবং কর্ম উদ্যমের সদ্ব্যবহারও করতে আমরা অক্ষম হয়েছিলাম। আমার মনে পড়ে, ফ্রান্সে ধর্ম বিরোধের কারণে যখন শত শত প্রটেস্টান্ট হিউগেনো ইংল্যান্ডে এসে আশ্রয় গ্রহণ করে, ইংল্যান্ড নানাভাবে উপকৃত হয়। এদের মধ্যে ছিলো অনেক দক্ষ কারিগর, অনেক দক্ষ শিল্পী। ইংল্যান্ডে অষ্টাদশ শতাব্দীতে যে শিল্প বিপ্লব ঘটে তার পেছনে হিউগেনোদের অবদান অপরিসীম। প্রথমে যারা এসেছিলো তারা ইংরেজী বলতে পারতো না। কিন্তু কয়েক দশকের মধ্যে তারা ইংরেজী ভাষী সমাজের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। এখনো বহু শিল্পের ইতিহাস উদঘাটন করলে দেখা যায় যে তার প্রতিষ্ঠা হয়েছে নির্বাসিত কোন হিউগেনো পরিবারের প্রয়াসে। কিন্তু ১৯৪৭-৪৮ এর অব্যবহিত পর যারা বিহার বা উত্তর প্রদেশ থেকে আসে তারা যেমন দূরদৃষ্টির অভাবে উর্দুর কৌলীন্যের কথা প্রচার করে আনন্দ পেতো তেমনি আমাদের অনেকে আশা করতে শুরু করেন যে পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে পা দিয়েই এরা উর্দুর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করবে। অথচ স্প্যানিশভাষী যারা আমেরিকার নিউ ম্যাক্সিকো অথবা ফ্লোরিডা অঞ্চলে বসবাস করে তারা আমেরিকার রাষ্ট্র ভাষা ইংরাজীর সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্প্যানিশ ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে চলেছে। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা এদের সন্তানেরা লাভ করে স্প্যানিশ ভাষায়। আমেরিকা রাষ্ট্রের একটি অংশ পুয়ের্টো রিকোর (Puerto Rico) রাষ্ট্র ভাষা স্প্যানিশ। অথচ আমার মনে পড়ে একদল লোক ১৯৪৯-৫০ সালেই নবাগত বিহারীদের শোষক বলে চিহ্নিত করছিলো। অনেক তরুণ বোধ হয় জানেই না যে রেলের এবং টেলিফোন টেলিগ্রাফ বিভাগের উর্দুভাষী কর্মচারী যদি অপশন দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে না আসতো এ অঞ্চলে প্রশাসন দাঁড় করবার কাজ বিঘ্নিত হতো। বাংলাভাষী সিনিয়র কোনো আইসিএস অফিসার ছিলেন না। কারণ বৃটিশ ভারতের ইতিহাসে কোনো বাঙ্গালী মুসলমান আই সি এস পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারেনি। মুষ্টিমেয় দু-তিন জন বাঙ্গালী যারা ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে ঢুকেছিলেন তারা চাকরি পেয়েছিলেন নমিনেশনের জোরে। শুধু এদের উপর নির্ভর করে পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনিক কাঠামো নির্মাণ করা যেতো না।
কলকাতার রাইটার্স বিন্ডিং-এ মুসলমান কর্মচারী-এরা সবাই ছিলো নিম্নস্তরের পদে-ঢাকায় অপশন দিয়ে আসবার পর রাতারাতি পদোন্নতি লাভ করে উচ্চতর পদে অধিষ্ঠিত হন। কেরানী কেউ সেকশন অফিসার হয়েছে, সেকশন অফিসার হয়তোবা এসিসট্যান্ট সেক্রেটারীর পদ পেহেছে। স্বভাবতই আই সি এস অফিসারদের জন্য নির্দিষ্ট উচ্চতম পদগুলো তারা পায়নি । এগুলি পূরণ করা হয় ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের আই সি এস অফিসার দিয়ে। বাঙ্গালী কর্মচারীরা মনে করতে শুরু করে যে এরা না এলে সমস্ত পদই তাদের দখলে আসতে পারতো। তাই দেখা গেলো আজিজ-আহমদ, এন এম খান, মদনী প্রমুখ উর্দুভাষী আই সি এস কর্মচারী যাঁরা কর্মজীবন শুরু করেছিলেন পূর্ববঙ্গে এবং যারা এ অঞ্চলের নাড়ি নক্ষত্রের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, তাদের কেন্দ্রীয় সরকারী এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। একদল লোক বলতে শুরু করে যে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কোন আনুগত্য তাঁদের নেই। প্রদেশটিকে শোষণ করার কাজে তাঁরা নিয়োজিত। এঁরা কোন ভুল-ভ্রান্তি করেননি তা হয়তো নয়, কিন্তু সামান্য কোনো ত্রুটি ধরা পড়লেই বলা হতো যে এঁরা অবাঙ্গালীর এজেন্ট হিসেবে দেশের রক্ত শুষে নিচ্ছেন। এই প্রচারণা ক্রমে ক্রমে বহু লোকের মধ্যে একটা বদ্ধমূল বিশ্বাসে পরিণত হয়। শেষ পর্যন্ত খুব সম্ভব গভর্ণর মোনেম খানের আমলে এক সর্বনাশকর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। স্থির হয়, পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনে অবাঙ্গালী অফিসার আর থাকবেন না। তেমনি যে সমস্ত বাঙ্গালী সি এস পি অফিসার পশ্চিম পাকিস্তানে বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তাদেরও এ প্রদেশে ফিরিয়ে আনা হবে, এর ফলে পাকিস্তানের দু’ অংশের মধ্যে ব্যবধান আরো বেড়ে গেলো।
ঠিক তেমনি ষাটের দশকে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে একদল অধ্যাপক ‘টু ইকনোমিজ’ বা পাকিস্তানের দু’টি আলাদা অর্থনীতি ব্যবস্থার কথা বলতে শুরু করেন। রাষ্ট্র একটি, তার কেন্দ্রীয় সরকার একটি অথচ ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে অর্থনৈতিক কাঠামোকে দ্বিধা বিভক্ত করার এই দাবী সুদূর প্রসারী প্রভাবের সৃষ্টি করে। ছাত্র সমাজের মধ্যে ধারণার সৃষ্টি হয় যে পুর্ব পাকিস্তানের টাকা বা পুঁজি এ অঞ্চল থেকে পাচার হতে না দিলে দেশের অর্থনীতিতে একটা পরিবর্তন সূচিত হবে। অথচ বৃটিশ ভারতে পুঁজি যাদের হাতে ছিলো তারা সবাই ছিলেন অবাংগালী। আগাখানী সম্প্রদায়কে আগাখান নিজে এ অঞ্চলে টাকা খাটাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন কিন্তু এঁরা অনেকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিকূল আবহাওয়ায় হতাশ হয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেন করাচীতে। পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম প্রথম যে ক’টি জুটমিল স্থাপিত হয় তার মধ্যে আদমজী মিল এবং ইস্পাহানী মিল প্রধান। এঁরা কোলকাতা অঞ্চল থেকে পুঁজি এবং তাঁদের শ্রমিক সঙ্গে নিয়ে ঢাকা আসেন। এ সমস্ত দক্ষ শ্রমিক- যারা ছিল অধিকাংশই বিহারী- না হলে কলকারখানা স্থাপন করা যেতো না। কারণ বলাবাহুল্য হঠাৎ করে একদল শ্রমিককে বসিয়ে দিলেই কারখানা চালু করা যায় না। তবে এক্ষেত্রেও কয়েক বছরের মধ্যে শুনতে পেলাম আদমজী, ইস্পাহানী, বাওয়ানী এঁরা বিশেয কিছু পুঁজি আনেননি। পুর্ব পাকিস্তান সরকারের অবাংগালী কর্মচারীদের সহযোগিতায় পাটের ব্যবসা কুক্ষিগত করেছেন। ৫৪ সালের পর আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার আমলে বাংগালী বিহারী দাঙ্গায় কয়েকশ’ লোক নিহত হয়। এর পেছনে ছিলো রাজনৈতিক উস্কানী। দেশ শিল্পায়িত হোক বা না হোক সেটা যেনো একেবারেই গৌণ হয়ে গেলো। শুধু শোনা গেলো অবাংগালী শ্রমিক এবং তাদের অবাংগালী মালিকেরা পূর্ব বঙ্গের রক্ত শুষে খাচ্ছে। অথচ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে যে- ক’টি পাটের কল অবিভক্ত বাংলায় ছিলো সেগুলো সব ছিলো কোলকাতায় এবং তাদের মালিক ছিলো সব মাড়োয়ারী ব্যবসায়ী। আদমজী-ইস্পাহানী এঁরা কয়েকজন ছিলেন এর ব্যতিক্রম। কলকাতায় মোট জুট মিলের সংখ্যা ছিল ৪০ বা ৪১। এসব মিলে পাট সরবরাহ হতো পূর্ব বঙ্গ থেকে। পাট ব্যবসায়ের কেন্দ্র ছিলো নারায়ণগঞ্জ। এখানে ফঁড়িয়াদের কাছ খেকে পাট ক্রয় করে নিতো মাড়োয়ারী। কিন্তু আশ্চর্য মাড়োয়ারী শোষণের কথা আমরা কখনো শুনিনি। পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭১ সালের দিকে জুট মিলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৭০ বা ৭১-এ দাঁড়ায়। এর অধিকাংশের মালিক ছিলো বাংগালী মুসলমান। কিন্তু যেহেতু আকার আয়তনে আদমজী ইস্পাহানী বাওয়ানী মিল ছিলো বড় সেহেতু বাংগালী মালিকেরা মুনাফা কি করছে সে প্রশ্ন কেউ তোলেনি। মুনাফার টাকা তারা পূর্ব পাকিস্তানেই রাখছে না সুইস ব্যাংকে জমা দিচ্ছে সে প্রশ্নও কেউ তোলেনি।
কাগজের কলের ব্যাপারেও একই কথা শুনেছিলাম। পূর্ব পাকিস্তানে প্রাথমিক পর্যায়ে নুরুল আমিন সাহেবের আমলে যে কয়েকটি শিল্প স্থাপন করা হয় তার মধ্যে একটি ছিলো চন্দ্রঘোনা পেপার মিল। কাগজ তৈরির কোনো অভিজ্ঞতা আমাদের ছিলো না। সরকার অনেক খোঁজ খবর করে দক্ষিণ ভারতের হায়দারাবাদ থেকে মিঃ আলী বলে একজন কাগজ বিশেষজ্ঞকে মিল স্থাপনের কাজে নিয়োগ করেন। তিনি মহাউদ্যমে কাজ শুরু করেছিলেন, কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই শোনা গেলো বাংগালী অফিসার এবং শ্রমিক বিদ্রোহ করে তাঁকে মেরে টুকরো করে কর্ণফুলী নদীতে ভাসিয়ে দেয়। তাঁর লাশের আর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। বলাবাহুল্য এর ফলে মিলটি চালু হতে অনেক বিলম্ব ঘটে। মিঃ আলীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত যাদের ফাঁসির হুকুম হয়েছিলো তাদের মধ্যে ডিপুটেশনে ছিলেন সিলেট সরকারী কলেজের কেমিস্ট্রির অধ্যাপক এখলাস উদ্দিন আহমদ। তিনি হাইকোর্টে আপিল করে দন্ডমুক্ত হয়ে চাকরিতে পুনর্বহাল হোন। তিনি ছিলেন রাজশাহীতে আমাদের ডেভলপমেন্ট অফিসার।
বাংগালী-অবাংগালীর মধ্যে এই বিরোধ রাজনৈতিক উস্কানীর ফলে দানা বেঁধে উঠতে থাকে, তার ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের আবহাওয়া বিষাক্ত হয়ে ওঠে। এই উস্কানী যে উদ্দেশ্যমূলক ছিলো এবং যারা এতে ইন্ধন যোগাতো তারা যে সুদূর প্রসারী একটা চক্রান্তের খপ্পরে পড়েছিলো অথবা ইচ্ছা করেই সে চক্রান্তে যোগ দিয়েছিলো এ সম্বন্ধে ‘৭১ সালে আমার মনে আর সন্দেহ রইলো না। আমি মাড়োয়ারীদের কথা বলেছি। মুসলমান প্রজারা অমুসলমান জমিদারদের হাতে কিরুপে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হয়েছে ‘৪৭ সালের পর সে তথ্যটি যেনো কোথায় মিলিয়ে গেলো। যেনো সব শোষণের সূত্রপাত হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। জনসাধারণের স্মৃতি শক্তি কোন কালেই প্রখর হয় না। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আপাতঃ দৃষ্টিতে উচ্চবর্ণের হিন্দু এবং মাড়োয়ারীদের শোষণ ও শাসনের অবসান ঘটবার সঙ্গে সঙ্গে সেই ইতিহাসও সবাই যেনো বিস্মৃত হলো। অথচ আমার মনে আছে ১৯৩৫ সালে যখন ঋণ সালিশী বোর্ড আইন পাশ হয় তার আগে অসংখ্য মুসলমান কৃষক অমুসলমান মহাজনের ঋণে জর্জরিত হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করতে বাধ্য হতো। বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে মূল ঋণের বহুগুণ টাকা শোধ করেও কৃষক ঋণ থেকে রেহাই পেতো না। সুদ বৃদ্ধি পেতো চক্রবৃদ্ধি হারে। এবং ঐ আইন প্রবর্তিত না হলে পূর্ব বঙ্গের অবস্থা কি হতো তা কল্পনা করাও কঠিন। জমিদারের শোষণ ও অত্যাচার এবং মাড়োয়ারী শোষণের কাহিনী চাপা পড়ে যায় উর্দু ভাষীদের প্রতি উদ্রিক্ত বিদ্বেষে।
ব্যক্তিগতভাবে কোনো হিন্দুর বিরুদ্ধে আমার কোনো কালেই কোনো আক্রোশ ছিলো না। আমার দেশের বাড়িতে আমাদের কর্মচার্রী সবাই ছিলো হিন্দু। আমাদের গ্রামের ডাক্তার যাদের চিকিৎসায় আমরা লালিত বর্ধিত হয়েছি তাঁরাও সব ছিলেন হিন্দু। চাকরি জীবনে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ব্রাহ্মণ মিঃ বি সি রয়ের সঙ্গে যে হৃদ্যতা ছিলো তা কোনো মুসলমান সহযোগীর সঙ্গেও নয়। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং রাজনৈতিক সমস্যা দু’টো আলাদা জিনিস। পাকিস্তান আন্দোলন যখন আমরা করি, আমরা চেয়েছিলাম হিন্দু মুসলিম সমস্যার একটি সমাধান। ব্যক্তিগতভাবে কোনো হিন্দুর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ নিয়ে আমি বা আমার বন্ধু-বান্ধব এ আন্দোলনে যোগ দিইনি।
‘৭১-এর বিষ্ফোরণ যদি পশ্চিম পাকিস্তানীদের অত্যাচার অবিচার এবং শোষণের কারণেই ঘটে থাকে তবে আমার নিজের প্রত্যক্ষ করা কতগুলি ঘটনার যুক্তিযুক্ত অর্থ বের করতে পারছিলাম না। ‘৪৭-এর ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পনেরো দিন পর যাঁরা তমুদ্দুন মজলিস গঠন করেন তাঁদের উদ্দেশ্য ছিলো কি? তখন তো রাষ্ট্র ভাষার কথা কেউ তোলেনি এবং সেটা তুলবার সময়ও নয়। পাকিস্তানের কাঠামো তখন নড়বড়ে কিন্তু তমু্দ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতারা ঘোষণা করলেন যে বাংলা ভাষাকে সংরক্ষণ করাই তাঁদের লক্ষ্য। অবিভক্ত ভারতে বা অবিভক্ত বাংলার বাংলাভাষা বিপন্ন হয়েছে বলে আমরা কখনো শুনিনি। যদি ভাষার বিশুদ্ধতা এবং পবিত্রতা রক্ষাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কারণ হয়ে থাকে তা হলে তো পাকিস্তানই হয়েছিলো একটা মস্ত ভূল, অথচ বাংলা সম্পর্কে কোনো কথা কেউ বলবার আগেই তারা এমন একটি পদক্ষেপ নিলেন যার ফলে অবশ্যম্ভাবী রূপে ভাষা সমস্যার সৃষ্টি হলো। এই বিরোধিতা করার একটি উপায় হিসেবে তমুদ্দূন মজলিস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো তার জবাব কি?
আমার আরো মনে হয়েছিলো ১৯৫৪ বা ৫৫ সালের একটি কথা। তখন এ প্রদেশে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা ছিলো। আতাউর রহমান খান চিফ মিনিস্টার। ঐ সময় চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ঢাকায় আসেন। তাঁর সম্মানার্থে রাস্তায় রাস্তায় অনেক তোরণ নির্মাণ করা হয়। কার্জন হলের রাস্তায় একঢি তোরণের কথা আমার বিশেষভাবে মনে ছিলো। সেটি হলো নালন্দার বৌদ্ধ মন্দিরের তোরণের অনূকরণ। আমি চমকে উঠেছিলাম। সঙ্গে ছিলেন পলিটিকাল সায়েন্সের একজন সিনিয়র শিক্ষক প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক। তাঁকে বললাম যেখানে স্থাপত্যে মুসলমানদের একটি বিখ্যাত ঐতিহ্য বিদ্যমান সেখানে নালন্দার অনূকরণ কেনো? পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত কোনো হিন্দু মন্দির বা বৌদ্ধ প্যাগোডার অনুকরণ হলেও এটার যুক্তিযুক্ততা একটা বের করা যেত, কিন্তু ভারতের নালন্দার প্রতি এই আনুগত্য বা প্রীতি প্রদর্শনের মধ্যে পাকিস্তানের আদর্শের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের কি কোনো ইঙ্গিত ছিলো না? আমার সঙ্গী অবশ্য হেসে ওটাকে হালকাভাবে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ৭১-এর ঘটনার সঙ্গে ১৯৫৪-৫৫ সালের ঐ ঘটনার কি কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক নেই? তখনতো পাকিস্তানের বয়স হয়েছিলো সাত বছর মাত্র, ৫৬ সালে করাচী এয়ারপোর্টের যে ঘটনা আগে উল্লেখ করেছি ৫৪-৫৫ সালের এ ঘটনাও তেমন ইঙ্গিতবহ।
‘৭১ সালের আরো একটি ঘটনার কথা আমার বিশেষ করে মনে পড়ে। এটা ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময়ের কথা। ভারত হঠাৎ করে লাহোর ফ্রন্টে আক্রমণ করে যখন এই যুদ্ধ শুরু করে তখন পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে ওঠে, ঠিক তখনই একদিন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আমার অফিসে আব্দুর রাজ্জাক সাহেব প্রবেশ করে প্রস্তাব করেন যে আমি যেনো বাঙ্গালী জাতির ইতিহাস একটি লিখি। আমি তাঁকে বলেছিলাম আমরাতো দু’টি বাংগালী জাতির কথা জানি। হিন্দু বাংগালী জাতি এবং মুসলিম বাংগালী জাতি। এদের মধ্যে ভাষাগত এবং কিছুটা নৃতাত্ত্বিক মিল ছাড়া আর তো কোনো ঐক্য নেই, এবং বহুকাল ধরে রাজনীতির ক্ষেত্রে এদের বিরোধ বাংলার ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছে। সুতরাং ঐক্যবদ্ধ একটি বাংগালী জাতির পরিচয় কোথায়? এ প্রশ্নের সোজাসুজি কোনো জবাব না দিয়ে অধ্যাপক বললেন যে পাকিস্তানের আদর্শ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে সুতরাং নতুন করে একটি সমাধান খুঁজতে হচ্ছে। তিনি মনে করেন, বাংলা আসামকে নিয়ে একটি বাঙ্গালী রাষ্ট্র কায়েম করেই এ সমস্যার সমাধান করা যাবে। কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে উঠলাম। যে জবাব দিয়েছিলাম তাও আমার স্পষ্ট মনে আছে। আমি তাকে বলি, পাকিস্তান আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন আমরা ছাত্র, আপনাদের মতো শিক্ষকেরাই এ আন্দোলনে আমাদের টেনে এনেছিলেন। সুতরাং কেনো পাকিস্তানের প্রয়োজন হয়েছিলো তা আপনার কাছে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আমার নেই, আজ পাকিস্তানের বয়স মাত্র ১৭ বছর। আপনি কি বলবেন, যে আদর্শের অনুপ্রেরণায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, সতেরো বছরের মধ্যেই তার চুড়ান্ত পরীক্ষা হয়ে গেছে? আর যদি কোনো জাতি প্রতি ১৭ বছর তার রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙ্গে-চুরে নতুন করে গড়তে চায় তা হলে এর শেষ কোথায়? পরবর্তী ১৭ বছরের পর আর এক জেনারেশনের তরুণেরাও তো প্রশ্ন করতে পারে, যে বাংগালী রাষ্ট্রের কথা আপনি বলছেন তাও আমাদের রাজনৈতিক উপযুক্ত সমাধান নয়। এই ভাঙ্গা-চোরার প্রক্রিয়া কি নিরন্তরই চলতে থাকবে? পাকিস্তানের বয়স যদি অন্ততঃ পঞ্চাশ বছর হতো এবং পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে আপনি ঘোষণা করতেন যে ঐ আদর্শ নিষ্ফল বা ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে, আপনার কথার কিছুটা গুরুত্ব দিতাম, কিন্তু ১৭ বছরের মধ্যেই আপনি মত পাল্টালেন কেনো?
আমার যুক্তির কোনো উত্তর তিনি সেদিন দেননি। তবে এর পর থেকে তিনি আমার সঙ্গে বাক্যালাপ প্রায় বন্ধ করে ফেলেন এবং এর কিছুদিন পর আমাকে দেখলে রীতিমতো মুখ ঘুরিয়ে ফেলতেন। এই ঘটনা ‘৭১ সালে যেমন বারংবার আমার মনে হয়েছিলো তেমনি এখনো হয়। আমার বিশ্বাস যে, এক দল লোক ইচ্ছা করেই একটার পর একটা সমস্যা সৃষ্টি করে গেছে। নানা বিভ্রান্তিকর যুক্তি উত্থাপন করে পাকিস্তানের অসারতা প্রমাণিত করতে চেষ্টা করেছে; বাংগালী-অবাংগালীর মধ্যে হিংসার উদ্রেক করেছে। তবে এ কথাও স্বীকার করবো যে, কেন্দ্রে যে সরকার কায়েম ছিলো তারা হয় এ সমস্যা সম্পর্কে অবহিত ছিলো না অথবা কি সূক্ষ্ম যুক্তি প্রয়োগে পাকিস্তানের ভিত্তিমূলকে দূর্বল করে ফেলা হচ্ছিল তা বুঝবার মতো বুদ্ধি তাদের ছিলো না। আমার আরো দু’টি ঘটনার কথা ‘৭১ সালে বেশ স্পষ্টভাবে মনে পড়ছিলো।
প্রথমটি পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা। সন-তারিখ এখন আমার ঠিক মনে নেই। তখন জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের উজিরে আজম বা প্রধানমন্ত্রী। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রাঙ্গণে ছাত্র সমাবেশে বক্তৃতা করতে আসেন। আমি উপস্থিত ছিলাম এবং আরো বেশ কিছু সংখ্যক ইউনির্ভাসিটি টিচারও ছিলেন। মিটিং শুরু হওয়ার তখন মাত্র দু’তিন মিনিট বাকী। শহীদ সাহেবের দেখা নেই। হঠাৎ শোনা গেলো হেলিকপ্টারের শব্দ। হলের প্রাঙ্গণের এক কোণায় হেলিকপ্টার থেকে সোহরাওয়ার্দী সাহেব অবতরণ করে সোজা মঞ্চের উপর উঠে এলেন। বক্তৃতায় এই আওয়ামী লীগ নেতাই সুস্পষ্ট ভাষায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবীর তীব্র নিন্দা করলেন। বললেন, পূর্ব পাকিস্তান বতর্মানে যতটুকু স্বায়ত্তশাসন ভোগ করছে তার অধিক কিছু নিষ্প্রয়োজন। পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যাপারে শতকরা ৯৮ ভাগ ক্ষমতারই অধিকারী, অথচ আশ্চর্যের কথা, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পূর্বে আওয়ামী লীগের প্রধান হিসেবে তিনি অনেক বার কেন্দ্রের বঞ্চনার কথা বলেছেন। এর পরিষ্কার অর্থ এই যে সত্যিকার অর্থে দু’একজন ছাড়া প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের মানে কি তা তারা উপলব্ধি করতেন না, নিজেরা কেন্দ্রের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে শহীদ সাহেরের মতো প্রশ্নটাকে অবান্তর বলে উড়িয়ে দিতেন আবার ক্ষমতাচ্যূত হলে প্রদেশের অধিকারের জন্য অশ্রুপাত করভে দ্বিধা করতেন না।
আইয়ুব শাহীর আমলে যখন আওয়ামী লীগের কেউ কেন্দ্রে কোনো গদিতে আসীন ছিলেন না তখন আনুষ্ঠানিকভাবে শুধু টু ইকনমিজ বা দু’ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছিলো দু’ মুদ্রানীতির কথাও। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দু’রকমের কারেন্সি প্রচলিত থাকবে, এ দাবীও উঠেছিলো। আর এ দাবীও উঠেছিলো যে তাদের পররাষ্ট্রনীতিও হবে ভিন্ন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা এ কথাও বলতেন যে পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্ট করার দুরভিসন্ধি তাদের নেই। কিন্তু দুই কারেন্সি এবং ভিন্ন পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কোনো রাষ্ট্র কিরূপে তার সংহতি রক্ষা করতে পারে তা আমার বুদ্ধির অগম্য ছিলো। ‘৭১ সালে অবশ্য উপলব্ধি করি যে, বিচ্ছিন্নতার জন্য জনমতকে প্রস্তুত করা ছিলো এ সমস্ত দাবীর মূল উদ্দেশ্য। তরুণ সমাজ ক্রমান্বয়ে বিশ্বাস করতে শুরু করে যে ভৌগোলিক দূরত্ব হেতু পাকিস্তানের দু’অংশের দুই রকমের মুদ্রানীতি ও বৈদেশিক নীতি থাকা অস্বাভাবিক নয়।
যারা ভৌগোলিক দূরত্বের উপর জোর দিয়ে বুঝাতে চেয়েছেন যে পাকিস্তান একটি অস্বাভাবিক রাষ্ট্র, তারা অতি কৌশলে পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রের উদাহরণের কথা এড়িয়ে যেতেন। গ্রীস, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিনস অনেকগুলি দ্বীপের সমষ্টি। এদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে এক অংশের সঙ্গে অন্য অংশের দূরত্ব হাজার মাইলের মতো। ইন্দোনেশিয়ার কথা বিশেষভাবে মনে পড়তো আমার। জাভা এবং সুমাত্রার মধ্যে যে সামুদ্রিক ব্যবধান সে পথ দিয়ে বিদেশী জাহাজও অনবরত চলাচল করে। কারণ এই সমুদ্রের প্রশস্ততা এতো অধিক যে এর উপর আন্তর্জাতিক আইনে ইন্দোনেশিয়ার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব স্বীকৃত নয়। যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই স্টেটের সঙ্গে মূল ভূখন্ডের দূরত্ব কয়েক হাজার মাইল। অবশ্য মাঝামাঝি এলাকায় আর কোনো রাষ্ট্র নেই। তবে মনে রাখা দরকার মূল আমেরিকান ভূখণ্ডের সঙ্গে হাওয়াই এর নৃতত্ত্বগত কোনো মিল নেই। এককালে হাওয়াই স্বাধীন ছিলো। কিন্তু রাজনৈতিক বিবর্তনের পর হাওয়াই এর অধিবাসীরা স্বেচ্ছায় যুক্তরাষ্ট্রে যোগদান করে। আলাস্কাও যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। মাঝখানে কানাডা। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষাগত এবং নৃতত্ত্বগত তফাৎ নেই সে কথা আমরা কখনো বলিনি, কিন্তু ৪৭ সালে এক পাকিস্তান কায়েম করার যে সিদ্ধান্ত তা কেউ আমাদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়নি। বেংগল এসেমব্লির মুসলিম সদস্যরা স্বেচ্ছায় ভোট দিয়ে পাকিস্তানে যোগ দিয়েছিলেন। অথচ ষাটের দশকের শেষদিকে বহুবার শুনেছি যে জিন্নাহ সাহেব নাকি জোর করে আমাদের পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে বাধ্য করেন। যেনো জিন্নাহ সাহেবের আজ্ঞাবহ কয়েক লক্ষ সৈন্যের হুমকিতে ভীত হয়ে বাংগালী মুসলমানেরা পাকিস্তানে যোগ দিয়েছিলো, এ যুক্তি যেমনি অসার তেমনি উদ্ভট।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের যে দূরত্বের কথা বলা হতো আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে সেটা ছিলো মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যাপার। ঢাকা থেকে রাজশাহী ট্রেনে যেতে লাগে ১২/১৩ ঘন্টা কিন্তু জেট প্লেনে করাচী থেকে ঢাকা আসা যেতো মাত্র দু’ঘন্টায়। হ্যাঁ, ভারতের উপর দিয়ে উড়ে আসতে হতো। কিন্তু এটা তো সবাই জানে যে আধুনিক বিমানের যুগে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে আকাশ সীমা পরিক্রমণের একটি অধিকার সর্বত্রই স্বীকৃত। এ অধিকার আছে বলেই লন্ডন থেকে অন্তত এক ডজন রাষ্ট্রের উপর দিয়ে কয়েক ঘন্টার মধ্যে ঢাকায় আসা যায়। তা ছাড়া সমুদ্র পথে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে যাতায়াত করতে কোনো অসুবিধা ছিলো না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর জিন্নাহ সাহেব যখন প্রথম পূর্ব পাকিস্তানে আসেন, তিনি ভারতীয় এলাকার উপর দিয়ে না এসে এসেছিলেন শ্রীলংকা ঘুরে। কয়েক ঘন্টা সময় বেশী লেগেছিল এই মাত্র। আসল কথা, পাকিস্তানকে সংহত এবং ঐক্যবদ্ধ রাখার সদিচ্ছা থাকলে ভৌগোলিক দূরত্বের প্রশ্ন আধুনিককালে একেবারেই অর্থহীন।
আর একটি কথা ‘৭১ সালে আমার বারংবার মনে হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানে যেমন এক শ্রেণীর লোক সুকৌশলে নানা মিথ্যা যুক্তির সাহায্যে পাকিস্তানের ভিত্তি মূলে আঘাত হানতে দ্বিধা করেনি, তেমনি পশ্চিম পাকিস্তানেও একদল লোক ছিলো যারা দূরদৃষ্টির অভাবে নানা অদ্ভুত কথা বলতে শুরু করেছিলো। একটা সেমিনারের কথা মনে আছে। এটা অনুষ্ঠিত হয় ডক্টর মাহমুদ হোসেনের মালিরস্থ জামেয়া মিল্লিয়ায়। ডক্টর মাহমুদ হোসেন যতো দিন ঢাকায় ভাইস চান্সেলর ছিলেন তিনি আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে যেতেন এই বার্ষিক সেমিনারে। আমার বেশ মনে আছে সেবারকার আলোচ্য বিষয় ছিলো Education and National Integration অর্থাৎ শিক্ষা ও জাতীয় সংহতি। আমি একটি প্রবন্ধ পড়ি। সে বছর ডেলিগেশনে আলী আহসানও ছিলো বলে আমার মনে আছে। সেমিনারের শেষ দিনে প্রধান বক্তা ছিলেন ডক্টর ইশতিয়াক হোসেন কোরেশী। তিনি তখন করাচী ইউনিভার্সিটির ভাইস চান্সেলর। এক কালে পাকিস্তান ক্যাবিনেটের সদস্য ছিলেন। তা ছাড়া ঐতিহাসিক হিসেবে খ্যাত। উর্দূ এবং ইংরেজীভে চমৎকার বক্তৃতা করতেন। কিন্তু সেদিনের বক্তৃতা আমাকে বিস্মিত করে। ডক্টর কোরেশী প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বক্তৃতায় পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সংহতির কথা বললেন না। অথচ পাকিস্তানের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সংহতির অর্থ ছিলো দেশের দুই অংশের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন সুদৃঢ় করা। কোরেশী সাহেব বললেন বিভিন্ন শ্রেণীর সংহতির কথা। পাকিস্তানের গরীব এবং ধনীর প্রভেদ বেড়ে গেছে বলে তিনি আক্ষেপ করে বললেন এই পাকিস্তানের কোনো সার্থকতা নেই। বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর হঠাৎ ডক্টর মাহমুদ হোসেন সাহেব বলে উঠলেন যে পূর্ব পাকিস্তানের ডেলিগেশনের পক্ষ থেকে এবার ডক্টর মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসায়েন কিছু বলবেন। আমাকে পূর্বাহ্নে ঘুনাক্ষরেও বলা হয়নি যে শেষ অধিবেশনে আমাকে বক্তৃতা করতে হবে।
আমি মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললাম যে ডক্টর কোরেশীর মতো অভিজ্ঞ সুবক্তার ভাষণের পর আমি যা বলবো তা হবে একটা অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স। বললাম যে ডক্টর কোরেশীর বক্তৃতা শুনে আমার মনে হয়েছে যে ষাটের দশকে এসে পাকিস্তান তিন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে গেছে। ডক্টর কোরেশীর মতো বয়স্ক ব্যক্তি যারা পাকিস্তান আন্দোলনে শরীক হয়েছিলেন, তাঁরা মনে হয় তাঁদের বিশেষ একটি ইচ্ছা পূরণ হবে বলে এ আন্দোলন সমর্থন করেছিলেন। কেউ ভেবেছেন উর্দুর কথা, কেউ ভেবেছেন অর্থের সমবন্টনের কথা। এ রকম কোনো ইচ্ছা বা স্বপ্ন এখনো বাস্তবায়িত হয়নি বলে ডক্টর কোরেশীর মতো তাঁরা বলছেন যে পাকিস্তানের কোন সার্থকতা নেই। তাঁরা সহজেই হতাশ হয়ে পড়েছেন। অন্যদিকে এক শ্রেণীর তরুণ যারা পাকিস্তানের জন্ম লগ্নে ছিলো একেবারেই শিশু তারা বলতে শুরু করেছে যে, যে হিন্দু-মুসলিম বা শিখ-মুসলিম বিরোধের কথা তারা ইতিহাসের বইতে পড়ছে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ বাস্তব জীবনে দেখেনি। সুতরাং তারা বলত যে পাকিস্তান আন্দোলন করে দেশে যে রক্তপাত এবং সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছিলো তার কোন কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এসব না হলেই তো ভালো হতো, শান্তি বিঘ্নিত হতো না। মাঝখানে রইলাম আমরা যারা মধ্যবয়সী এবং যারা কখনো ভুলিনি যে পাকিস্তানের আদত লক্ষ্য ছিলো মুসলমান জাতির জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম করা, যে রাষ্ট্রে তারা নিজেরা নিজেদের ঐতিহ্য এবং আদর্শের আলোকে জাতীয় জীবন ব্যবস্থাকে পূনর্গঠিত করতে পারবে; যে রাষ্ট্রে হরহামেশা সাংস্কৃতিক নিষ্পেষণ বা অনৈসলামিক ধমীঁয় অনুশাসনের ভয়ে শঙ্কিত হতে হবে না। এ রাষ্ট্রের অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি বা সংস্কৃতি কিরূপ পরিগ্রহ করবে সেটা নির্ভর করবে মুসলিম জাতির মৌলিক আদর্শগুলোকে আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করবো তার উপর। আমাদের আবাসভূমির উপর আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষিত হলে রাষ্ট্র পরিচালনার স্বাধীনতা আমাদের থাকবে। আমরা কখনো মনে করি না যে দশ-পনেরো বছরে আমাদের মৌলিক লক্ষ্যগুলো অর্জিত হবে। কিন্তু তাই বলে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হতাশা বা নৈরাশ্য প্রকাশ করার প্রবণতা আমদের মধ্যে নেই, কেননা আমরা মনে করি পৃথিবীর অন্যত্র যা হঠাৎ করে সম্ভব হয়নি তা পাকিস্তানেও অনতিকালবিলম্বে দেড় দশকের মধ্যে বাস্তবায়িত হওয়া অসম্ভব। Trial and error অর্থাৎ নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং ভুল-ভ্রান্তির মধ্যদিয়েই মানুষকে অগ্রসর হতে হয়। তাই আমি ডক্টর কোরেশীর মতো সিনিক হতে রাজী নই।
বক্তৃতা মঞ্চ থেকে আমি যখন নেমে এলাম। লক্ষ্য করলাম শ্রোতারা অধিকাংশই খুশী হয়েছেন। কেউ কেউ বললেন আমার আরো কিছু বলা উচিৎ ছিলো। কিন্তু করাচী শহরে প্রকাশ্য সভায় ডক্টর কোরেশীকে সিনিক বা নৈরাশ্যবাদী বলায় মনে হলো তিনি অপমানিত বোধ করেছেন। ডক্টর মাহমুদ হোসেনও ক্ষুণ্ণ হলেন বলে মনে হলো। দু’জনের একজনও আমার সাথে কথা বললেন না। আমার এই বক্তৃতা পরদিন ডন পত্রিকায় বেশ বিস্তারিত ভাবে বেরিয়েছিলো।
পূর্ব পাকিস্তানে যেমন একদল নানা কারণে পাকিস্তানের আদর্শ বর্জন করতে বসেছিলেন তেমনি ডক্টর কোরেশীর মতো অনেক ব্যক্তি পশ্চিম পাকিস্তানেও পাকিস্তানের একঢি সংকীর্ণ ব্যাখ্যা দিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিলেন। কায়েদে আজম জিন্নাহ যখন গণ পরিষদের প্রথম অধিবেশনে ঘোষণা করেন যে পাকিস্তানে মুসলমান হিন্দু শিখ খৃষ্টান সবার সমান নাগরিক অধিকার থাকবে, তখনও একদল সংকীর্ণমনা ব্যক্তি এই বলে আপত্তি তুলেছিলেন যে এই ঘোষণার দ্বারা নাকি দ্বিজাতি তত্তের উপর আঘাত করা হয়। আমার কখনো তা মনে হয় না। কারণ আমরা কখনো ভাবিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে মন্দির-গীর্জা বা গুরুদ্বার সব ভেঙ্গে নস্যাৎ করে দিতে হবে। সংখ্যালঘুদের কোন স্বাধীনতা থাকবে না এ রকম কোনো নীতির উপর কোনো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হতে পারে না, কিন্তু ভারতবর্ষে ১০ কোটি মুসলমানকে কৃত্রিমভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পদে নামিয়ে আনবার যে ষড়যন্ত্র ছিলো পাকিস্তান ছিলো তারই বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা প্রতিবাদ।
যারা বলতো যে পঁচিশে মার্চ আর্মি অতর্কিতভাবে আক্রমণ করার ফলে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিলো, তার কোনো প্রমাণ এপ্রিল মাসে পাইনি। ২৬শে মার্চের আগের রাতে আওয়ামী লীগের লোকজনের কাছে শুনেছিলাম যে আর্মি কোনো একশন বা পদক্ষেপ নেবার আগেই যেনো রাস্তায় ব্যারিকেড করে রাখা হয় এবং গাছ কেটে ব্যারিকেড করার জন্য মার্চ মাসের গোড়াতেই কনট্রাক্ট দেওয়া হয়। তার মানে একদল লোক আর্মির সঙ্গে সংঘাতের জন্য আগে থেকেই তৈরি হয়েছিলো।
এ সমস্ত কথা ভেবে বারংবার নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম, এই গৃহযুদ্ধ কি অনিবার্য ছিলো? আমরা কি কোনো রূপেই একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে পেতাম না? ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে বাংগালী বৈমানিকরা অসম বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলো। যে পাকিস্তানের জন্য এই সৈনিকেরা এবং অন্যান্য বাংগালীও আত্মত্যাগ করেছে, সংগ্রাম করেছে, রক্ত দিয়েছে হঠাৎ করে সেটা হয়ে উঠলো আমাদের শত্রু- এ কথা আমার মতো ব্যক্তির পক্ষে বিশ্বাস করা সস্তব হবে কিভাবে? ৪০ থেকে ৪৭ সালে পাকিস্তান সংগ্রামে আমার মতো লক্ষ লক্ষ মুসলিম তরুণ ঝাপিয়ে পড়েছিলো হঠাৎ একটি রাজনৈতিক দলের ঘোযণার ফলে তারা হয়ে উঠলো জাতিদ্রোহী। একেই বলে অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস। এই পরিহাসের শিকার হয়ে যারা একাত্তর সালের ধ্বংস যজ্ঞে আত্মনিয়োগ করেছিলো তাদের মনোবৃত্তি বোঝা ছিলো আমার সাধ্যাতীত। পরিচিত অনেক বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে এই যে ব্যবধান তৈরি হয়ে গেলো, এটা অতিক্রম করে কখনো আমরা সুস্থ চিন্তায় প্রত্যাবর্তন করতে পারবো কিনা এই দুশ্চিন্তা আমাকে অনবরত পীড়িত করেছে।
(বইটির pdf version download করুন এখানে)