আর্মির অবাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি 

১৩ই এপ্রিলের পরের যে সমস্ত ঘটনার কথা আমার বিশেষভাবে মনে পড়ে তার মধ্যে একটি হলো ২১ শে এপ্রিল ইকবালের মৃত্যূ দিবস পালন। হল বন্ধ। ক্যাম্পাসে ছাত্র ছিলো না। সুতরাং কয়েকজন শিক্ষককে অনুষ্ঠান করতে হলো। সভা বসলো ভাইস চান্সেলরের হল কামরায়। কয়েকজন মিলিটারী অফিসারও যোগ দিয়েছিলেন। প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ডঃ মতিয়ুর রহমান। আমাকেই সভাপতিত্ব করতে হলো। বক্তারা সবাই বললেন যে, বতর্মান অবস্থাতেও ইকবালের আদর্শ ম্লান হবার নয়। কারণ স্বাপ্নিক কবি এবং দার্শনিক হিসাবে তিনি যে বাণী রেখে গেছেন তার তাৎপর্য কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে আবদ্ধ নয়। আমরা জানতাম হয়তো ঢাকায় বা দেশের অন্যত্র ইকবাল দিবস পালন করা হবে না। কিছুদিন আগেই সম্ভবতঃ ফেব্রুয়ারীতে কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে গোলযোগের পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ইকবাল হলের নাম বদলিয়ে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল করেছিল। এ কাজের সমর্থন আমি কখনই করতে পারিনি। এ রকম উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে যদি রাস্তাঘাট বা কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম বদলাবার পালা শুরু হয় তবে তো প্রতি তিন চার বছর পর সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সব পাল্টিয়ে ফেলতে হবে। লন্ডনে-প্যারিসে বহু প্রাচীন নাম বহু শতাব্দী থেকে প্রচলিত রয়েছে। ফ্রান্সে যে রাজাদের বিরুদ্ধে ১৭৮৯ সালে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল তাদের নামও বহু রাস্তাঘাট, প্রতিষ্ঠান বহন করছে। আমাদের দেশের নাম পরিবর্তনের মধ্যে ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করার যে প্রবণতা লক্ষিত হয় সেটা যেমন দুঃখজনক তেমনি হাস্যকর। একটা নাম বদলিয়ে ফেললেই ইতিহাস বদলে যায় না। করাচীতে গান্ধী গার্ডেনস-এর নাম বদলাবার কথা তো কেউ কখনো ভাবেনি। আমাদের মধ্যে সাময়িক উচ্ছ্বাসের বশবর্তী হয়ে অতীতকে অস্বীকার করার এই যে দৃষ্টান্ত তার নজির অন্যত্র বিরল।

আর্মি ক্যাম্পাসে এসে অনেক শিক্ষক এবং অফিসারের ব্যাংক একাউন্ট ফ্রীজ করে দিয়েছিলো। এঁদের নিয়ে সমস্যায় পড়লাম। ইউনিভার্সিটি ব্যাংক চালু হওয়া সত্ত্বেও এঁরা কেউ টাকা তুলতে পারছিলেন না। ডক্টর মতিয়ুর রহমানের মারফত আর্মিকে জানানো হলো যে এ ব্যবস্থা চলতে পারে না। এঁরা টাকা-পয়সা নিয়ে পালিয়ে যাবেন তার কোনো সম্ভাবনা নেই। যারা ইতিমধ্যেই ইন্ডিয়ায় চলে গিয়েছিলেন তাদের কথা আলাদা কিন্তু যারা এই দূর্যোগের মধ্যেও দেশ ত্যাগ করেননি, ক্যাম্পাস ছেড়ে যাননি, তাদের অসুবিধা সৃষ্টি করা হবে কেনো? আর্মি শেষ পর্যন্ত সব একাউন্টই রিলিজ করে দেয়। শিক্ষক এবং অফিসার যাঁরা গ্রামে পালিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা কেউ কেউ ফিরে আসতে শুরু করলেন। কিন্তু অনেকেই ফিরে আসতে ভয় পাচ্ছিলেন। আমি যখন মে মাসে ঢাকা যাই তখন কয়েকজন শিক্ষক আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আর কোনো ভয় নেই এই আশ্বাস দিলে তারা প্রত্যাবতর্ন করতে শুরু করেন । কিন্তু সেটা পরের কথা।

এপ্রিলের শেষে ঢাকায় কিভাবে যাবো সে ব্যাপার নিয়ে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। অথচ আগেই বলেছি যে, মিলিটারী কনভয়ের সঙ্গে ছাড়া যাতায়াতের উপায় ছিলো না। শেষ পর্যন্ত ১৭ই মে যে কনভয়টি ঢাকা যাচ্ছিল তারা আমাদের সঙ্গে নিতে রাজি হলো। সঙ্গে নেওয়ার অর্থ তাদের যানবাহনে নয়, আমরা নিজেদের গাড়ীতেই তাদের সঙ্গে শুধু থাকবো। আমার সঙ্গে ছিলো নিজের প্রাইভেট গাড়ীটি এবং ম্যাথামেটিক্স ডিপার্টমেন্টের এক শিক্ষক যে গাড়ীটি আমার জিন্মায় রেখে গিয়েছিলেন সেটা। লোক আমাদের অনেক। কারণ চাকরানীরা পর্যন্ত রাজশাহীর বাসায় আর থাকতে রাজী হলো না। ডঃ মতিয়ুর রহমান বললেন যে তার দুই আত্মীয়া আমাদের সঙ্গে যাবেন। তিনিই কনভয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন সুতরাং তাঁর অনুরোধ রক্ষা করতে হলো। কোন রকম ঠাসাঠাসি করে আমরা রওনা হলাম। আমার গাড়ীর সামনের সিটে আমার কোলে আমার দুই ছোট মেয়েকে নিতে হলো। পেছনের সিটে ছিলো বোধ হয় ছ’জন। অন্য গাড়ীটির অবস্থাও তাই। ডক্টর মতিয়ুর রহমান অবস্থা দৃষ্টে বললেন যে তা হলে তাঁর আত্মীয়াদের জন্য অন্য ব্যবস্থা করবেন। আমি বললাম, ওরা যদি একটু কষ্ট করতে পারে আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। সেভাবেই ১৭ই মে সকাল বেরা রাজশাহী থেকে যাত্রা করি। নাটোরে যুদ্ধ বিগ্রহের বিশেষ কোনো চিহ্ন চোখে পড়লো না। কিন্তু রাস্তায় মাঝে মাঝে ব্যারিকেড চোখে পড়লো। এগুলো সরিয়ে আর্মি ১২ই এপ্রিল রাজশাহী অভিমুখে এসেছিলো। দু’একটা কালভার্টও ভাঙ্গা ছিলো। সেগুলো সাময়িকভাবে মেরামত করে নেওয়া হয়েছিলো। পাবনা এসে টের পেলাম যে এখানে রীতিমতো সংঘর্ষ হয়েছে। পেট্রোল পাম্প বিধ্বস্ত ছিলো, ডিসির অফিস এবং ব্যাংকে গোলাগুলীর চিহ্ন ছিলো। ডিসি আগেই ইন্ডিয়া চলে যান। কিন্তু আর্মি নিষ্ফল আক্রোশে তাঁর অফিসে গোলা বর্ষণ করে।

আমরা রাজশাহীতে যে সামান্য পরিমাণ পেট্রোল সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম পাবনা পর্যন্ত এসে তা ফুরিয়ে যায়। আবার আর্মির শরণাপন্ন হতে হলো। ওরা শেষ পর্যন্ত কিছু পেট্রোল দিয়ে ঢাকা পর্যন্ত পৌছার ব্যবস্থা করে দিলো। নগরবাড়ী ফেরিতে আর্মি অফিসার দুজন আমার সঙ্গে ফার্স্ট ক্লাস সেলুনে এসে বসলেন। ওরা দেশের অবস্থার কথা তুলরেন। তাঁদের কথাবার্তা শুনে আমি শুধু আশ্চর্য হলাম না, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে রীতিমতো শঙ্কিত বোধ করলাম। একজন অফিসার বললেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্রই প্রায় সরকারী নিয়ন্ত্রণ পুনঃস্থাপিত হয়েছে। দেশে হিন্দু যারা রয়েছে তাদের তাড়িয়ে দিলেই ভবিষ্যতে আর কোনো গোলযোগের আশঙ্কা থাকবে না। সেই ‘সাফাই’-এর কাজই আর্মি শুরু করেছে। তখনও কিন্তু কোলকাতায় শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টি হয়নি। অল্প সংখ্যক লোক ইন্ডিয়া পালিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু এখন আর্মি আনুষ্ঠানিকভাবে হিন্দু বিতাড়নের যে প্রক্রিয়া শুরু করলো তার পরিণতি মঙ্গলজনক হতে পারে না এ কথা তো শিক্ষিত সবারই বোঝা উচিত ছিলো। পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুর সংখ্যা ছিলো প্রায় এক কোটি। এই এক কোটি লোককে দেশ থেকে তাড়িয়ে আর্মি শান্তি স্থাপন করার কথা ভাবছে এ কথা কানে শুনেও বিশ্বাস করা কঠিন ছিল। এই নীতির কারণেই অবশ্যম্ভাবীরূপে জুন মাসের মধ্যেই অসংখ্য শরণার্থী পশ্চিম বঙ্গ এবং ত্রিপুরায় আশ্রয় নিতে শুরু করে এবং ভারত দাবী করতে শুরু করে যে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা আন্তর্জাতিক রূপ পরিগ্রহ করেছ। ইউরোপ- আমেরিকায় এ বিশ্বাস সঞ্চারিত হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার এক নৈতিক অধিকার ভারতের জন্মেছে। এটা যে চরম অদূরদর্শিতার পরিচায়ক ছিলো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রসঙ্গতঃ আর একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। ২৫শে মার্চের পর শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্য নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনার সৃষ্টি হয়। সমস্তই গুজব। আওয়ামী লীগের এক দল দাবী করে যে তিনি আর্মির বিরুদ্ধে গোপন আস্তানা থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। কেউ বলছিলো তিনি কলকাতা চলে গেছেন এবং সময় মতো আত্মপ্রকাশ করবেন। অধিকাংশ লোকেরই বিশ্বাস ছিলো শেখ মুজিব ২৫ তারিখের রাতে আর্মির হাতে নিহত হয়েছেন। পাকিস্তান সরকার প্রথমে তাঁর সম্বন্ধে কোনো কথাই বলেননি। পরে একদিন ঘোষণা করা হলো যে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেখানে তাঁর বিচার হবে। অধিকাংশ লোকই মনে করতে শুরু করে যে ঘোষণাটি সর্বৈব মিথ্যা। একদিন এ সমস্ত জিজ্ঞাসার উত্তর এক তরুণ আর্মি অফিসারের কাছ থেকে পেলাম। তিনি বললেন, যে সেনাদলকে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করার হুকুম দেওয়া হয়েছিলো তিনি সেই দলে ছিলেন। ডন পত্রিকায় প্রকাশিত করাচী এয়ারপোর্টের ভিআইপি রুমের একঢি ছবি দেখালেন, সোফায় মুজিবুর রহমান বসা, দুপাশে দুজন অফিসার তার মধ্যে একজন এই বক্তা যিনি আমাকে গল্পটি শোনাচ্ছিলেন। আমি বাংলাভাষী সে কারণে বিদ্রুপের সঙ্গে বললেন, সেদিন দেখেছি আপনাদের নেতা কেমন। আমাদের দেখে তিনি চমকে উঠেছিলেন এবং ভয়ে কাঁপছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন আমরা তাঁকে গুলি করতে এসেছি।

আবার আগের কথায় ফিরে যাচ্ছি। ঐ মিলিটারী অফিসার আমাকে জানালেন যে ঢাকার রমনা ময়দানে যে দু’টি হিন্দু মন্দির ছিলো সে দু’টোকে ওরা কামান দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন। আবার আমার মনে হলো যে মন্দির ধ্বংস করে বীরত্ব প্রকাশ করার এই যে নমুনা এও তো দেশের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। ভারতের প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে সে কথা এরা ভাবেনি। তা ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানে এবং বিভাগ পূর্ব বাংলায় কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামার সময়ও মন্দির ধ্বংস করার ইতিহাস নেই। এ অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি শহরে এবং কোনো কোনো গ্রামেও অগণিত মন্দির ছড়িয়ে আছে। তাছাড়া আছে মঠ। আমরা চিরকালই গর্ব করতাম যে মুসলমান শাসনকর্তারা ধর্মের ব্যাপারে অত্যন্ত সহিষ্ণু ছিলেন। যে কারণে মুসলিম শক্তির প্রাণ কেন্দ্র দিল্লীতেও হিন্দু প্রাধান্য। পাকিস্তান পূর্ব ঢাকাতেও হিন্দুদের সংখ্যা ছিলো বেশি। রমনা ময়দানের বড় মঠটির কাছাকাছি একটি মসজিদ অবস্থিত ছিলো। কিন্তু এ নিয়ে কোন বিরোধ হয়নি। ঢাকেশ্বরী মন্দির যে এলাকায় অবস্থিত তার চারদিকে মুসলিম বস্তি। এখানেও কোনো উপদ্রব ঘটেনি। আমার মনে আছে, আমি একবার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে প্রবেশ করেছিলাম। এটা নাকি শিবের মন্দির। এক কক্ষে দেখলাম শিব পার্বতীর Phallic Symbols। সঙ্গে সঙ্গে আমি সরে আসি। আর কেউ কাছে থাকলে লজ্জা পেতাম। কয়েকশ’ বছর ধরে ঢাকার মতোই মুসলিম প্রধান অঞ্চলে এ রকম একটা জিনিস বিদ্যমান ছিলো, কিন্তু কেউ সেটা ভাঙ্গতে যায়নি। সে জন্য পাকিস্তান আর্মি এবার যে কান্ড করে বসলো তার সুদূরপ্রসারী পরিণতির কথা ভেবে আমি শিউরে উঠেছিলাম। আমি যখন বললাম যে দু’টো-একটা মঠ বা মন্দির ভেঙ্গে আপনারা কোন সমস্যার সমাধান করবেন? তখন অফিসারটি বললেন যে, রমনা মঠে নাকি অস্ত্র-শস্ত্রের একটা আড্ডা ছিলো। বিদ্রোহীরা এখানে ট্রেনিং নিতো। এ অভিযোগ কতটা সত্য তা জানার আর উপায় ছিলো না।

ফেরী জাহাজের উপর থেকে যমুনা নদীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে আগের মতন স্বাভাবিকভাবে বহু নৌকা চলাচল করছে। আরিচাতে এসে আবার আমরা গাড়ীতে উঠলাম এবং তিন ঘন্টার মধ্যেই ঢাকা এসে পৌছানো গেলো। রাস্তার কোনো জায়গায়ই কোনো যুদ্ধ-বিগ্রহের চিহ্ন চোখে পড়েনি। শহরের কাছে এসে আর্মির ট্রাকগুলো ক্যান্টনমেন্টের দিকে চলে গেলো। আমার দু’টি গাড়ী মীরপুর রোড ধরে নিউ মার্কেটের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। আমি ড্রাইভারদের হুকুম দিলাম প্রথমে ইকবাল হলের কাছে যেতে। আর্মির লোকের মুখেই শুনেছিলাম যে, হলের কিছু নেই। তাই বাসায় যাবার আগেই অবস্থাটা স্বচক্ষে দেখবার আগ্রহ জন্মেছিলো। ষাটের দশকে বছর দেড়েক আমি এই হলের প্রভোষ্টের কাজ করেছি। হলটির প্রতি স্বাভাবিকভাবেই একটু বেশী মমতাও ছিলো। কাছে এসে গাড়ী থেকে দেখলাম হল যেমন ছিলো তেমনি আছে। প্রায় অক্ষত। তবে উপরতলার কিছু জানালার কাঁচ ভাঙ্গা। মনে হলো গোলাগুলী হয়েছিলো। আমি অবশ্য তখন ভিতরে যাইনি। কিন্তু যে গল্প আমি শুনেছিলাম তা যে সস্পূর্ণ অতিরঞ্জিত তা বুঝতে পারলাম। অথচ এই অতি রঞ্জনের সূত্র আর্মি নিজেরাই। যে অফিসার আমাকে ইকবাল হল সম্পর্কে খবরটি দিয়েছিলেন তিনি যে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা কথা বলেছিলেন তা বোধ হয় নয়। সম্ভবতঃ তিনি কখনো ইকবাল হল এলাকায় যান নাই, গুজব শুনেই বিশ্বাস করেছিলেন যে, ইউনিভার্সিটির দালান-কোঠা আর অবশিষ্ট নেই।

ইকবাল হল থেকে সোজা বাসায় এলাম, ১০৯ নাম্বার নাজিমুদ্দিন রোডে। রাস্তায় বিশেষ অস্বাভাবিকতা চোখে পড়লো না। তবে গাড়ীর সংখ্যা কম ছিলো। কিন্তু প্রচুর লোক পায়ে হেঁটে ঘোরাফেরা করছিলো। ঢাকা এসে প্রথমেই ইউনিভার্সিটিতে কারা নিহত হয়েছেন তার খবর নিলাম। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, মুনির চৌধুরী, ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের এম এ মুনিম এরা সবাই অক্ষত দেহে বেঁচে আছেন শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। নিশ্চিতভাবে খবর পেলাম যে, পঁচিশে মার্চের রাত্রে আর্মির গুলীতে যাঁরা মারা গেছেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ফিলসফির ডঃ জি সি দেব এবং স্ট্যাটিসটিকসের ডঃ মনিরুজ্জামান। আরো দু’জন ছিলেন। এঁদের প্রায় সবার সঙ্গেই আমার ভালো পরিচয় ছিলো এবং এঁরা রাষ্ট্রদ্রোহী কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন এ কথা আমার কখনোই বিশ্বাস হবে না। আর্মি চেয়েছিলো বেপরোয়াভাবে কিছু লোককে হত্যা করে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে। সাময়িকভাবে একটা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিলো সত্য কিন্তু এ হত্যাকান্ডের ফলে আর্মির যে ইমেজ হলো তার ফলে বহু লোকের মনে পাকিস্তানের আদর্শের প্রতি একটা চরম ঘৃণা জন্মাল, যারা কখনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা ভাবেনি তারাও আর্মির নৃশংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল। কয়েক দিনের মধ্যেই টের পেলাম যে, আমার বন্ধু-বান্ধব যাঁরা গভীরভাবে পাকিস্তানের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন তাঁদের সে বিশ্বাসের ভিত নড়ে গেছে। তাঁরা বলতে শুরু করেছেন যে, আর্মির এই শাসনই যদি পাকিস্তান রক্ষার একমাত্র উপায় হয় তবে সে পাকিস্তানের দরকার আমাদের নেই। এ সমস্ত ঘটনার মধ্যে পাকিস্তানের পটভূমি, ঐতিহাসিক প্রয়োজন, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের ইতিহাস সবই তলিয়ে গেলো। স্বভাবতঃই ইন্ডিয়া থেকে বলা হলো যে, পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানী আর্মির বিরুদ্ধে যে লড়াই শুরু হয়েছে সেটা হচ্ছে বাংগালী জাতির আত্ম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।

বাস্তবিকপক্ষে ২৫ মার্চের পর দু’এক সপ্তাহ ভয়ে হোক আতঙ্কে হোক আর্মির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করার কথা কেউ ভাবেনি। বা সে রকম কোনো কথা আমরা শুনিনি। কিন্তু যখন দেখা গেলো যে আর্মি তার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে তখন এই যুদ্ধ এক নতুন মোড় নিলো এবং এটা বোধ হয়, জুন মাস থেকে। গৃহযুদ্ধের পরিকল্পনা অনেক আগে থেকেই করা হয়েছিলে। সে কথা আগেই বলেছি। বিভিন্ন এলাকায়, বিশেষ করে বিভিন্ন ছাত্রাবাসে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিলো। তাছাড়া মার্চ মাসে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বিরুদ্ধে যে অবরোধ ঘোষণা করা হয় সেটাও ছিলো প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। আর্মি উত্তেজিত হয়ে একটা কিছু করে বসুক এর অপেক্ষাই যেনো একদল লোক করছিলো। আর্মি যদি ধৈর্য সহকারে এবং আরো বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে পারতো তা হলে কি হত তা নিয়ে শুধু জল্পনা-কল্পনাই করা চলে, কিন্তু আর্মি কমান্ড আওয়ামীদের খপ্পরে পড়ে পঁচিশে মার্চে নাটকীয় হামলা শুরু করে। অথচ আশ্চর্যের কথা যারা গৃহযুদ্ধের পরিকল্পনা করছিলো এবং আর্মির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণের উস্কানী দিয়ে যাচ্ছিলো তাদের কাউকে গ্রেফতারও করা হয়নি। রহস্যের কথা ২৫শে মার্চের পর আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সকলে সীমান্ত অতিক্রম করে ইন্ডিয়া চলে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর্মি যে কোনো সুপরিকল্পিত প্ল্যান নিয়ে ২৫শে মার্চে হত্যাকান্ডে লিপ্ত হয়নি এটা তারই প্রমাণ। বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধেও মূর্খ অফিসারদের কাছে কোনো তথ্য ছিলো না। তারা শুধু শুনেছিলো যে ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা জয়বাংলা সংগ্রামে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিলে। তাই সেই অতর্কিত আক্রমণ। তবে এটাও মনে হয়েছে যে, আক্রমণ এভাবে শুরু হবে আওয়ামী লীগ বোধ হয় সে জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত ছিলো না। এই কারণেই ২৫শে মার্চের অব্যবহিত পর আর্মির সঙ্গে গুরুতর কোন সংঘর্ষের খবর আমরা পাইনি। ৭১ সালের মে মাস পর্যন্ত আমার নিজের যে ধারণা ছিলো আমি সে কথাই বলছি। এখন শুনছি আওয়ামী লীগের প্রতিরোধ নাকি ২৬শে মার্চ থেকেই চট্টগ্রাম ও উত্তরবঙ্গের অনেক অঞ্চলে আরম্ভ হয়।

অতিরঞ্জিত

রাজশাহীতে ঢাকার ঘটনাবলী সম্পর্কে অনেক আজগুবি কাহিনী শুনেছিলাম। তার অধিকাংশই মিথ্য। তার মধ্যে একদিকে ছিলো আর্মির নৃশংসতার কাহিনী অন্যদিকে ঢাকাবাসীর প্রতিরোধের কাহিনী। আমি শুনেছিলাম যে ইউনিভার্সিটির কয়েক হাজার ছাত্র-শিক্ষক নিহত হয়েছেন। নিহত শিক্ষকের সংখ্যা আগেই দিয়েছি। নিহত ছাত্রদের সংখ্যা যোগাড় করা সস্তব হয়নি। তবে হাজার হাজার ছাত্র পঁচিশের রাত্রে মারা পড়ে, এ কাহিনী সত্য ভিত্তিক নয় এ কথা সবাই আমাকে বললেন। ছাত্ররা প্রায় সবাই ৭ই মার্চের পর হল ত্যাগ করে। সারা ক্যাম্পাসে একশ’ ছাত্রও ২৫ তারিখের রাত্রে ছিলো না।

নিহত শিক্ষকদের মধ্যে স্ট্যাটিসটিকস ডিপার্টমেন্টের ডঃ মনিরুজ্জামানের নাম শুনে অভিভূত হয়ে গেলাম। ডক্টর হাসান জামানের বড় ভাই। অত্যন্ত সৎ লোক। লেখাপড়া ছাড়া আর কিছুই বুঝতেন না। শুধু তিনিই নন, তাঁর বড় ছেলে এবং ভাগ্নে আর্মির গুলীতে মারা যায়। শুনেছি যে আর্মি এসে যখন তার নাম ধরে ডাকাডাকি করে তখন তিনি কোরআন তেলাওয়াত করছিলেন। ছেলেদের নিয়ে বেরিয়ে আসতেই আর জিজ্ঞাসাবাদ না করে তাকে গুলী করা হয়। আর্মি যে কোন স্থির পরিকল্পনা নিয়ে পঁচিশের এ্যাকশনে লিপ্ত হয়নি ডক্টর মনিরুজ্জামানের মর্মান্তিক মৃত্যূ তার অকাট্য প্রমাণ। পরে ভুল বুঝতে পেরে তাঁরা অনেক অনুশোচনা করেছে।

আরো শুনেছিলাম যে জগন্নাথ হলে আর্মির সঙ্গে রীতিমতো লড়াই হয়। ঢাকা এসে শুনলাম এটাও একটা অলীক কাহিনী। আর একটি লোমহর্ষক কাহিনী কানে এসেছিলো। শুনেছিলাম যে আর্মি যখন নাকি ট্যাঙ্ক নিয়ে রাস্তায় বের হয় তখন একটি মেয়ে জয় বাংলা বলতে বলতে একা ট্যাঙ্কের সামনে দাঁড়ায় এবং নিষ্পেষিত হয়ে মারা যায়। ঢাকার সবাই বললেন যে এমন কোনো ঘটনা ঢাকায় হয় নাই।

একদিন গেলাম নিউমার্কেটে। লক্ষ্য করলাম বেশ কিছু দোকান তখনও বন্ধ। পরিচিত একটি বইয়ের দোকানে এক ছোকরা বললো, কর্ণেল ওসমানীর নেতৃত্বে বাংগালীরা প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসছে। এই প্রথম পঁচিশের রাত্রের ঘটনা প্রসঙ্গে কর্ণেল ওসমানীর নাম কানে এলো। ছেলেটি বিশেষ কিছু জানে না। যা শুনেছে সেই খবর দিলো। এই প্রতিরোধ পরে কি রূপ পরিগ্রহ করবে তখন তা ধারণা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

সৈয়দ আলী আহসানের ফ্যামেলির কেউ কেউ আমার সঙ্গে দেখ করতে এসেছিলো। তারা তখনো সঠিকভাবে জানতো না যে আলী আহসান সীমান্ত অতিক্রম করে ইন্ডিয়া চলে গেছে। আলী আহসানের ছোট ভাই সৈয়দ আলী তকী ময়মনসিংহের এক কলেজে অধ্যাপনা করতো। ২৫শের পর এরা তার কোনো সন্ধান পাচ্ছিলো না।

আমাদের আত্মীয়-স্বজন আরো যাঁরা প্রদেশের অন্যত্র ছড়িয়ে ছিলেন তাঁদের সম্বন্ধেও সঠিক খবর যোগাড় করা গেলো না। কারণ ডাক যোগাযোগ একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছিলো। উল্লেখযোগ্য যে, ডাক চলাচলে অনিয়ম শুরু হয় ফেব্রুয়ারী মাস থেকেই। মার্চ মাসের গোড়ায় আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক বয়কট ঘোষণা করেছিলো। বলা হয়েছিল কেউ যেনো কোনো ট্যাক্স খাজনা সরকারী তহবিলে জমা না দেয়। ব্যাংকের উপর নির্দেশ জারী করা হলো যে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য টাকা তারা যেনো একটি আলাদা একাউন্টে আটক করে রাখে। বস্তুতঃ ৭ই মার্চের পর থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ দেশে একটি প্যারালাল সরকার কায়েম করেছিলো। এটা সম্ভব হয়, বিশেষ করে গভর্ণর আহসানের চরম অকর্মণ্যতার কারণে। সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটা সমঝোতা হওয়ার আগেই তিনি কার্যতঃ আওয়ামী লীগের উপর শাসনভার ছেড়ে দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি নাকি প্রশাসন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। একাধিক বার শেখ মুজিবের বাসায় যেয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এ সব নিশ্চয়ই করা হয়েছিলো ইয়াহিয়া খানের অনূমতিক্রমেই। কিন্তু এর ফলে দেশের সর্ব সাধারণের মনে অবশ্যম্ভাবী রূপে যে বিশ্বাসের সঞ্চার হয়েছিলো তা হলো এই যে, ইয়াহিয়া সরকার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে প্রস্তুত। এবং এই দলকে দেশের ভাবী শাসক হিসাবে মেনে নিয়েছে। আমি নিজে একবার এই নিয়ে অত্যন্ত বিব্রত হয়ে পড়ি। প্রাদেশিক গভর্ণর ছিলেন ইউনিভার্সিটির চান্সেলর এবং এ জন্য অনেক ব্যাপারে তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করতে হতো। আমি প্রশাসনিক সমস্যা নিয়ে গভর্ণর আহসানের অভিমত জানতে চেয়ে চিঠি লিখি। তিনি তো কিছু করলেনই না, শুনেছি সে চিঠি তিনি আমাকে না জানিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বাস্তবিক পক্ষে প্যারালাল সরকারকে ইয়াহিয়া এবং গভর্ণর আহসান যেভাবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন তারপর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করার যেমন যৌক্তিকতা ছিলো না তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর সাহায্য ব্যতিরেকে আর্মি পাকিস্তানকে আয়ত্তে আনতে পারবে এ বিশ্বাসও ছিলো ওদের চরম মূর্খতা ও অদূরদর্শিতার পরিচায়ক।

ডাক যোগাযোগ ভেঙ্গে পড়ায় অন্যান্য অসুবিধের মধ্যে একটা বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন আমাকে হতে হয়। আমেরিকা থেকে প্রকাশিত Encyclopaedia Britannica -র জন্য ফেব্রুয়ারী মাসে পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে ওদেরই অনুরোধে একটি নিবন্ধ রচনা করেছিলাম। মার্চ মাসে গোলমালের মধ্যে সেটা পাঠানো সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত ১৩ই এপ্রিলের পর আর্মির সাহায্যে ওটা পাঠাবার ব্যবস্থা করি। নিবন্ধটি যথাসময়ে ঐ বিশ্বকোষে প্রকাশিত হয়।

বিবৃতি

একদিন মাহে নও অফিস থেকে একজন পরিচিত ব্যক্তি হেমায়েত হোসেন আমার বাসায় এসে উপস্থিত হলেন। তাঁর হাতে টাইপ করা ইংরেজী একঢি বিবৃতি। আর একটি কাগজে অনেকগুলো দস্তখত। নাম প্রায় সবগুলিই আমার পরিচিত। এঁদের মধ্যে ছিলেন মুনীর চৌধুরী, নুরুল মোমেন, শাহেদ আলী, ফররুখ আহমদ, আসকার ইবনে শাইখ প্রমুখ। আমাকে বলা হলো ওটাতে সই দিতে। পড়ে দেখলাম ২৫ তারিখের রাত্রে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আর্মি যে এ্যাকশন এটা তারই একটা ব্যাখ্যা। বিদেশে বিশেষ করে আমেরিকার শিক্ষক সম্প্রদায়ের মধ্যে ঢাকা ইউনিভার্সিটির ঘটনার বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিলো। শিক্ষক এবং ছাত্র সম্প্রদায়ের উপর হামরার নিন্দায় অনেক মার্কিন অধ্যাপক মুখর হয়ে ওঠেন। বিবৃতিটি তারই জবাব। বেশ সরস ইংরেজীতে লেখা। বলা হয়েছিলো আসল ঘটনা অত্যন্ত অতিরঞ্জিত হয়ে বিদেশে প্রচার হয়েছে। ক্যাম্পাসে ব্যাপক হত্যাকান্ড কিছুই ঘটে নাই। দু’একজন শিক্ষক বা ছাত্র যাঁরা দুষ্কৃতিকারীদের সঙ্গে আর্মির বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিলেন তাঁরাই শুধু মারা গেছেন। অন্যান্য শিক্ষক ও ছাত্র ভয় ও আতঙ্কে গ্রামে পালিয়ে গেছেন- এই কারণে ইউনিভার্সিটি বন্ধ। আমি বললাম, ঢাকা ইউনিভার্সিটি সংক্রান্ত বিবৃতিতে আমার সই কেন? আমি তো তখন রাজশাহীতে এবং এ সম্বন্ধে আমি ব্যক্তিগতভাবে কিছুই জানি না। হেমায়েত সাহেব বললেন যে সরকার থেকে আমার দস্তখত সংগ্রহে আদেশ দেওয়া হয়েছে। অফিসারদের করণীয় কিছুই নেই। আমি আরো বললাম যে বিবৃতিতে এমন অনেকগুলো বাক্য সংযোজিত যাতে সই করলে যারা জানে যে আমি ঐ তারিখে ঢাকায় ছিলাম না তাদের কাছে আমি হাস্যাস্পদ হবো। ঐ বাক্যগুলি অবশ্যই সংশোধিত করতে হবে। দেশের সংকট মুহুর্তে পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন জানাতে আমার আপত্তি নেই কিন্তু জেনে শুনে মিথ্যা কথার সমর্থন কিভাবে করবো? সেদিন আমি হেমায়েত সাহেবকে ফিরিয়ে দিই। পরদিন তিনি আবার এসে হাজির। কয়েকটি কথা দেখলাম বদলানো হয়েছে এবং ঐ ভদ্রলোক বললেন যে বর্তমান অবস্থায় আমি যদি দস্তখত দিতে অস্বীকার করি চরম ভূল বোঝাবুঝির আশংকা দেখা দেবে। বিশেষতঃ যেখানে সবাই জানতো, আমি পাকিস্তান আদর্শে বিশ্বাসী সে ক্ষেত্রে অন্যান্য বুদ্ধিজীবীর মতো সই না দিলে নানা প্রশ্ন উঠবে। শেয পর্যন্ত ভেবে চিন্তে সই দিলাম। অদৃষ্টের এমনই পরিহাস যে তেহাত্তর সালে যখন আমাকে স্ক্রিনিং কমিটির সামনে হাজির করা হয়, কমিটির চেয়ারম্যান বললেন যে, ৭১-সালের ঐ বিবৃতিটি আমি লিখেছি বলে কর্তৃপক্ষের ধারণা। আমি জবাবে বলেছিরাম যে, অভিযোগটি সর্বৈব মিথ্যা। মুসাবিদাটি এসেছিলো ইসলামাবাদ থেকে। রচয়িতার পরিচয় আমরা জানতাম না।

২৫শে মার্চের আর্মি এ্যাকশনের আগে যদিও কোনো রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে পরামর্শ করার কথা ইয়াহিয়া সরকার ভাবেননি, তাঁরা অতি সত্ত্বরই টের পেয়েছিলেন যে জনসমর্থন পেতে হলে নেতৃবৃন্দের সহানুভূতির প্রয়োজন। তাই এই সময় নুরুল আমিন সাহেব এবং আরো অনেক নেতার স্বাক্ষরিত বিবৃতি প্রচার করা হয়। এগুলো যে তাঁরা আর্মির চাপের মুখে প্রচার করতে বাধ্য হন তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিলো না। ফল হয় উল্টো। আর্মির ভূমিকা সম্পর্কে জনগণের মনে আরো সংশয়ের সৃষ্টি হয়। এই কারণে পিস কমিটিগুলোও দেশে শান্তি-শৃংখলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সফল হয়নি। আর্মিও তাদের বিশ্বাস করতো বলে মনে হয় না। প্রায়ই শোনা যেতো যে তাদের সুপারিশ উপেক্ষা করে অনেক কিছু করা হয়, অনেক লোককে গ্রেফতার করা হয়, যার ফলে পিস কমিটির প্রতি জনগণের মনে একটা করুণার ভাব সঞ্চারিত হয়। এরা আর্মির হাতের পুতুল, এই সন্দেহ বদ্ধমূল হতে থাকে। পিস কমিটিতে অনেক সৎলোক ছিলেন যাঁরা চেয়েছিলেন যে দেশে শান্তি ফিরে আসুক এবং এ দেশের অখন্ডতা যেন রক্ষা পায়। কিন্তু স্বাধীনভাবে তাঁদের কাজ করতে দেওয়া হচ্ছিলো না- এ অভিযোগ বহু অঞ্চল থেকে শুনতে পাই।

আর্মির অবিশ্বাসের হেতু যে একেবারে ছিলো না, তা নয়। শুনেছি যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন অনেক লোক ভালো মানুষ সেজে পিস কমিটিতে যোগ দিতো যারা আওয়ামীদের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করতো, অনেক তথ্য ফাঁস করে দিতো। এসব নিয়ে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিলো যে, চারিদিক অবিশ্বাস ও সন্দেহে ধোঁয়াটে হয়ে উঠেছিলো। আমি একথা শুনেছিলাম যে, আর্মি যে রাজাকার বাহিনী গঠন করে তাদেরও কেউ কেউ অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে যেতো। আবার এ কথাও শুনেছি, রাজাকার হয়ে কেউ কেউ ব্যক্তিগত শক্রতার শোধ নিতো। এ সব ঘটনা সম্পর্কে কোনো কোনো সময় তদন্ত হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তিও দেয়া হয়েছে, কিন্তু সব ক্ষেত্রে নয়।

প্রবাসী সরকার

আমি ঢাকায় থাকতেই শুনলাম, কোলকাতায় বাংলাদেশ সরকার নামক একটি সরকার গঠিত হয়েছে এবং পাকিস্তান সরকারের বাংগালী কর্মচারী কেউ কেউ এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে শুরু করেছে। প্রথম যে ব্যাক্তির নাম শুনি সে হলো সৈয়দ আমজাদ হোসেন। আমার ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের পুরানো ছাত্র, আমি তাকে খুব স্নেহ করতাম। সে দিল্লীতে পাকিস্তান মিশনে কার্যরত ছিলো। যখন সে ইউনিভার্সিটিতে পড়তো তাকে পাকিস্তান আদর্শে বিশ্বাসী বলে জানতাম। সে যখন প্রতিবাদ করে চাকরী ত্যাগ করে তখন ইসলামাবাদ থেকে একদল অফিসার দিল্লীতে এসেছিলেন আমজাদ হোসেনের মতো কর্মচারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। দিল্লী সরকার কোনো বাংগালী অফিসারকে ওদের সঙ্গে মিলিত হতে দেয়নি। আমজাদ হোসেন তখন এমন একটি বিবৃতি দিয়েছিলো যা পড়ে আমি খুব ব্যথিত হয়েছিলাম।

এ রকম আর একজন পরিচিত লোক যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তখনও খুব বিস্মিত হয়েছিলাম। তিনি হলেন হোসেনআলী। ফরেন সার্ভিসের অফিসার, কোলকাতায় ডেপুটি হাইকমিশনার ছিলেন। তিনি নাটকীয়ভাবে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে কলকাতার পাকিস্তান মিশনটিকে কার্যত একটি ইন্ডিয়ান প্রচারণার কেন্দ্রে পরিণত করেন। হোসেন আলীকে চিনতাম ১৯৪৭ সাল থেকে। ‘৪৭ সালে আমরা যে ক’জন তরুণ শিক্ষক পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গ অঞ্চল থেকে সিলেটের এম সি কলেজে যোগ দিয়েছিলাম হোসেন আলী তাদের অন্যতম। তার ডিগ্রী ছিলো কেমিস্ট্রিতে। সিলেটের আম্বরখানায় আমি যে বাসা ভাড়া করেছিলাম প্রথম কয়েকদিনের জন্য তিনি সেখানে উঠেছিলেন। আমার সঙ্গে আরও ছিলেন ইংরেজীর অধ্যাপক মঈদুল ইসলাম। তিনি বাসায় রয়ে গেলেন। হোসেন আলী এক রিক্সাওয়ালার সাথে মেস করেন। এ সময় অর্থাৎ ‘৪৭ সালের শেষ দিকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সেন্ট্রাল সার্ভিসের জন্য অনেক অফিসার রিক্রুট করা হয়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা অনুষ্ঠানের সময় ছিল না। কারণ তখনই কিছু লোক ট্রেনিং এর প্রয়োজন দেখা দিলো। এ প্রসঙ্গে বলা বোধ হয় প্রয়োজন যে, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালী আই সি এস অফিসার একজনও ছিলেন না। সুতরাং শুধু ইন্টারভিউ করে কাউকে ফরেন সার্ভিসে, কাউকে এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে, কাউকে অডিট সার্ভিসে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের কলেজে কলেজে রিক্রুটমেন্ট টিম ঘুরে বেড়িয়ে লোক সংগ্রহ করেন। এইভাবে হোসেন আলী পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগ দিয়েছিলেন। আমি আগে থেকেই স্থির করেছিলাম যে, আমি শিক্ষকতা করবো। সে জন্য কোনো ইন্টারভিউ দিতে রাজী হইনি। সেই হোসেন আলী নাটকীয়ভাবে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করলেন, এ আমি কখনো ভাবতে পারিনি।

আর এক পরিচিত ব্যক্তি যার ডিফেকশনে অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হই তিনি ছিলেন আবু সাঈদ চৌধুরী। তাঁকে যখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভাইস চান্সেলর নিযুক্ত করা হয় তখন থেকে তাঁর সঙ্গে আমার বিশেষ পরিচয়। আগেও তাঁকে চিনতাম। তিনি কোলকাতায় ছাত্র রাজনীতি করতেন। তাঁর বাবা ছিলেন লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঢাকায় একবার আমার প্রাক্তন ছাত্র নুরুল ইসলাম (যিনি পরে হাইকোর্টে জাস্টিস নিযুক্ত হন) তাঁর বাসায় নজরুল ইসলাম দিবস উপলক্ষে আবু সাঈদ চৌধুরীর বক্তৃতা শুনি। তিনি ভালো বাংলা বলতেন এবং লিখতেনও। পরবর্তীকালে তাঁকে কিছুকাল পেয়েছিলাম বেংগলীঁ ডেভলাপমেন্ট বোর্ড- এর চেয়ারম্যান হিসাবে। আমি ঐ বোর্ডের সদস্য ছিলাম। আবু সাঈদ চৌধুরী ডক্টর ওসমান গনির পর ঢাকা ইউনিভার্সিটির ভাইস চান্সেলর রূপে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। আমি তার কিছুদিন আগেই ১৯৬৯ সালে রাজশাহীতে যাই। সেই সময় একবার ইংলিশের এক্সপার্ট হিসাবে ঢাকা ইউনিভার্সিটির অনুরোধে সিলেকশন কমিটির সদস্যপদ গ্রহণ করতে হয়। ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে রিডার নিয়োগের পালা। সিলেকশন কমিটিতে স্বভাবতই আবু সাঈদ চৌধুরী সভাপতিত্ব করছিলেন। আরো ছিলেন মরহুম আবু হেনা, আর্টস ফ্যাকাল্টির ডিন (তার নাম আমার মনে নেই) এবং আরো দু’একজন। ক্যানডিডেট ছিলেন দু’জন, ডক্টর সিরাজুলে ইসলাম চৌধুরী এবং মিসেস মোহাম্মদ হোসাইন, আমারই এক বন্ধুর স্ত্রী। তাঁরও পিএইচডি ডিগ্রী ছিলো। খুব স্মার্ট মহিলা। আমি মিটিং শুরু হবার দুই মিনিট পরে এসে যোগ দিই। তখনও ইন্টারভিউ শুরু হয়নি। শুনে অবাক হলাম যে সিলেকশন কমিটির সদস্যরা প্রায় স্থির করে বসেছেন যে পদটি মিসেস হোসাইনকে দেওয়া হবে। ইন্টারভিউটা হবে ফরমালিটি মাত্র। আমি বললাম, যেখানে ডিপার্টমেন্টে একজন ভালো ক্যানডিডেট রয়েছেন সেখানে আপনারা আগে থেকেই এ রকম মনস্থির করে বসেছেন কেন? সিরাজুল ইসলাম আমাদেরই ছাত্র। আমিই তাকে বিদেশে পাঠিয়েছিলাম। তাকে বাদ দিয়ে বাইরের কোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ করা অত্যন্ত অন্যায় হবে বলে আমি মনে করি। সে যদি ইন্টারভিউতে একেবারেই কোনো কৃতিত্বের পরিচয় না দিতে পারে, সে আলাদা কথা। ইন্টারভিউতে প্রশ্ন আমাকেই করতে হলো। একেতো আবু সাঈদ চৌধুরী ইংরেজী সাহিত্যের লোক নন, দ্বিতীয়তঃ ইউনিভার্সিটির কাজকর্ম সম্পর্কে তাঁর তখন অভিজ্ঞতা হয় নাই। মিসেস হোসাইন ভেবেছিলেন তিনি এমন করে ইংরেজী বলবেন যে কেউ তাঁকে বিশেষ কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে সাহস পাবেন না। আমাকে তিনি অবশ্যই চিনতেন। হয় তো আশা করেননি যে আমি তাঁকে বিশেষ কিছু জিজ্ঞাসা করবো। কিন্তু প্রশ্ন করে দেখা গেলো যে তিনি পিএইচডি পেয়েছেন সত্য কিন্তু তার জ্ঞান গভীর নয়। তার তুলনায় সিরাজুল ইসলামের পারফরমেন্স অনেক ভালো হয়েছিলো। তা সত্ত্বেও সিলেকশন কমিটি মিসেস হোসাইনকে নিয়োগ করার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। কিন্তু আমি শক্তভাবে প্রতিবাদ করায় তাঁরা আর পীড়াপীড়ি করেননি এবং সিরাজুল ইসলামকেই রেকমেন্ড করা হয়।

আর একবার আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ ঘটে। সেটা করাচীতে। আমরা ইন্টার-ইউনিভার্সিটি বোর্ডের এক মিটিং-এ গিয়েছিলাম। কোনো এক ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে আমার মতভেদ হয়। তাঁর কোনো এক যুক্তির জবাব দিতে গিয়ে মুশকিলে পড়া গেলো। তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন যে তাঁর কথায় বাধা দিলে তিনি আর মুখ খুলবেন না। আমি বিশেয লজ্জিত হয়েছিলাম। পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্যদের সামনে ও রকম অসৌজন্যমূলক দৃশ্যের অবতারণা করবেন এ ছিলো আমার ধারণাতীত।

যাক সে কথা। আবু সাঈদ চৌধুরী ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ দিকে ঢাকা ত্যাগ করেন সপরিবারে। তিনি তখন পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসাবে জেনেভায় জুরিষ্টদের সভায় যোগ দিতে গিয়েছিলেন। পরিবারের সবাইকে কেনো নিয়ে গেলেন সেটা বুঝা গেলো যখন ২৫শে মার্চের অব্যবহিত পর তিনি বিবিসিতে এক ইন্টারভিউতে বলেন যে, পাকিস্তান আর্মি তাঁর ইউনিভার্সিটির হাজার হাজার শিক্ষক ও ছাত্রকে খুন করেছে। এরপর তিনি আর ঐ সরকারের আনুগত্য স্বীকার করতে পারেন না তাঁর এই চাঞ্চল্যকর বিবৃতিভে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি বিশেষভাবে ক্ষুণ্ণ হয়। কারণ ভাইস চান্সেলর পদের মর্যাদা পাশ্চাত্য জগতে খুব বেশী। তাঁর মতো উচ্চপদস্থ ব্যক্তি অতিশয়োক্তি করতে পারেন এটা ওরা ভাবতে পারে না। আশ্চর্যের কথা ২৫শে মার্চের ঘটনার পর শুধু বিদেশী পাকিস্তান বিরোধী প্রপাগান্ডার উপর নির্ভর করে আবু সাঈদ চৌধুরী যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তাতে সন্দেহ হলো যে পূর্বাহ্নেই তিনি টের পেয়োছিলেন যে দেশে একটা গৃহযুদ্ধ বাঁধবে এবং‌ তিনি কোন পক্ষ গ্রহণ করবেন তাও আগে থেকেই স্থির করা ছিলো। আরো বিস্ময়ের কথা ২৫ তারিখের আগেই তিনি তাঁর ইস্তেফাপত্র পাঠিয়েছিলেন। এই ঘটনায় আমার মনে এ সন্দেহ বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা গৃহযুদ্ধ ঘটাবে বলে আগে থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। শুধু আর্মির এ্যাকশনের আকস্মিকতায় তারা কিছুটা হতভম্ব হয়ে পড়ে।

এদিকে রাজশাহী থেকে তাগিদ আসতে লাগলো আমি যেনো শিগগির ফিরে যাই। আমার আত্মীয়-স্বজন আমাকে আবার রাজশাহী ফিরে যেতে দিতে বিশেষ রাজী ছিলেন না। তারা ভাবছিলেন আমি আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বো। কিন্তু আমি স্থির করি যে প্রত্যাবর্তন না করা চরম কর্তব্যবিমুখতা হবে। ক্যান্টমেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো আর্মি কনভয়ের সঙ্গে যাবো বলে মনস্থির করলাম। কিন্তু তার আগে ইউনিভার্সিটি কখন খুলবে সে সম্বন্ধে সরকারী মতামত জেনে নেয়া ভালো্। তখন এসব ব্যাপার পরিচালনা করছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। তিনি বসতেন গভর্মেন্ট হাউজে যেটাকে আজকাল বঙ্গভবন বলা হয়। ইন্টারভিউ-এর একটা টাইম পেলাম কিন্তু আমাকে ১০-১৫ মিনিট অপেক্ষা করতে হলো। ওয়েটিং রুমে তাহা বিন হাবীব নামক এক ব্যক্তির সাথে দেখা। তার নাম শুনেছিলাম, চিনতাম না। শুনেছিলাম যে আর্মির সঙ্গে জনসাধারণের লিয়াজোঁ তিনি করছেন। নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি আমার সঙ্গে কথা বললেন। এবং আমি যখন রাও ফরমান আলীর কামরায় ঢুকলাম তিনিও আমার সঙ্গে সঙ্গে এলেন। রাও ফরমান আলীর সঙ্গে আমার এই প্রথম দেখা। বাইরে থেকে মনে হলো তিনি খুব শান্ত প্রকৃতির লোক। ইউনিভার্সিটি খোলার ব্যাপারে তিনি আমাকে বিশেষ কিছু বলতে পারলেন না। বললেন, এ সিদ্ধান্ত আপনাদের উপর ছেড়ে দেয়া হবে। আমি বলেছিলাম যে আরো দু’এক মাসের মধ্যে ইউনিভার্সিটি খোলা সঙ্গত হবে না। মনে হলো তিনি আমার সে যুক্তি মেনে নিয়েছেন। কিন্তু আশ্চর্য ঐ ইন্টারভিউ-এর মাত্র দু’দিন পর আমাদের সঙ্গে পরামর্শ না করেই নির্দেশ জারী করা হলো যে ইউনিভার্সিটি অবিলম্বে খুলতে হবে এবং স্বাভাবিকভাবে শিক্ষাদান শুরু হবে। রাজশাহীতে এসে দেখলাম যে আরো শিক্ষক এবং অফিসার ক্যাম্পাসে ফিরে এসেছেন। ঢাকায় যে সমস্ত শিক্ষক আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন, তারাও কেউ কেউ ফিরে এলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন, ফজলুল হালিম চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমদ এবং জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। তবে এরা ঠিক কোন তারিখে ক্যাম্পাসে প্রত্যাবর্তন করেন সে কথা আমার স্মরণ নেই।

আর একটা কথা বোধ হয় বলা দরকার। আমি ঢাকা পৌঁছাবার দু’দিন পরই জামাতা ক্যাপটেন ওয়ালী আহমদকে তার সিগন্যালস ইউনিট সহ পশ্চিম পাকিস্তানে বদলী করা হয়। সঙ্গে আমার মেয়েকেও নিয়ে গেলো। আর দু’দিন দেরী হলেই ওদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হতো না। করাচী হয়ে এদের মারী যাওয়ার কথা। করাচীতে যাতে অসুবিধা না হয় সেজন্য ডক্টর আলী আশরাফকে ফোন করি। তিনি তখন করাচী ইউনিভার্সিটির ইংলিশের হেড। কথা খুব স্পষ্ট শোনা গেলো না। তবে খবরটা দিতে পেরেছিলাম। আশরাফ এবং তার স্ত্রী এসে ওদের এয়ারপোর্ট থেকে তুলে নিয়ে একদিন বা দু’দিন তাঁদেরই বাসায় রেখেছিলেন। এটা একদিকে যেমন স্বস্তির কারণ হলো অন্যদিকে নতুন এক দুশ্চিন্তার আকর হয়ে উঠলো। কারণ তখন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিয়মিত চিঠিপত্র আসতো না। আমি যখন জুন মাসে মারী যাই তখনি ওদের ঢাকা ত্যাগের পর ওদের সঙ্গে প্রথম দেখা। সিগনালস ইউনিটকে হঠাৎ করে পশ্চিম পাকিস্তানে ট্রান্সফার করার কারণ শুনলাম, ঐ ইউনিটে একদিন এক বিষ্ফোরণ ঘটে। কে এর জন্য দায়ী সেটা আবিষ্কার করা না গেলেও আর্মি সারা ইউনিটকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। ১৬ই ডিসেম্বরের পর অন্যান্য বাংগালী অফিসারদের মতো ওয়ালী আহমদকেও অন্তরীণ করে রাখা হয়। তার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলো। মাঝে মাঝে পশ্চিম জার্মানী থেকে ওয়ালী আহমদের এক আত্মীয় খোঁজ-খবর পাঠাতেন।

রাজশাহীতে তখন পূর্ণ উদ্যমে হিন্দুরা পদ্মা পেরিয়ে মুর্শিদাবাদ চলে যাচ্ছে। এদের মধ্যে বহু মুসলমানও ছিলো। আর্মি গ্রামাঞ্চলে সারা সারা গ্রাম জ্বালিয়ে দিতো। এর ফলে সর্বত্রই একটা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। আমি আগেই বলেছি যে আর্মির বিশ্বাস ছিলো যে হিন্দুদের তাড়িয়ে দিলেই দেশে শান্তি ফিরে আসবে। এ রকম একটা ঘটনার বিবরণ ডক্টর বারী দিয়েছিলেন। তাঁরই জানাশোনা এক গ্রামে দুষ্কৃতিকারী বলে চিহ্নিত বহু লোককে আর্মি হত্যা করে। এদের মধ্যে এক ব্যক্তি ছিলো বাবরী ও দাড়ীওয়ালা। আর্মি বলে বসলো ‘ইয়ে শিখ হ্যায়।’ ডঃ বারী নিজে বহু চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারেননি।

(বইটির pdf version download করুন এখানে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>