শরণার্থী

মে মাসের শেষের দিকে ইন্ডিয়ায় শরণার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু আশ্চর্য কয়েকদিনের মধ্যেই এই সংখ্যাকে ষ্ফীত করে হাজার থেকে লাখ, লাখ থেকে কোটিতে নিয়ে আসা হয়। একদিন বা দু’দিনের ব্যবধানে সংখ্যার এমন তারতম্য কিভাবে ঘটতে পারে তা আমাদের বোঝা সাধ্যাতীত ছিলো। এই প্রপাগান্ডায় বিশ্বাস করতে হলে বিশ্বাস করতে হতো যে পূর্ব পাকিস্তানের রাস্তাঘাটে নদীপথ সর্বত্র শরণার্থীর ভীড়ে একটা জমাট বেঁধে গিয়েছিলো। এমন কিছু অন্তত আমার চোখে পড়েনি। তবে কয়েক লক্ষ লোক যে আর্মির ভয়ে ইন্ডিয়ায় পালিয়ে যায় তা অস্বীকার করার প্রশ্ন ওঠে না। 

বহু বিদেশী সাংবাদিক এই উদ্বাস্তুদের দেখতে ছুটে আসেন এবং এদের দুর্দশার কথা ফলাও করে প্রচার করেন। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তান সমস্যা যে পাকিস্তানের ঘরোয়া সমস্যা নয়, সে কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়। শরণাথীঁদের সাহায্যের জন্য ইন্ডিয়াকে প্রচুর সাহায্য দেয়া হয়। সেই সাহায্য কিভাবে ব্যবহৃত হয়েছে সে সম্বন্ধে অনেক গল্প শুনতাম। তবে সেগুলি কতটা সত্য বা মিথ্যা সে কথা আমি ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারবো না। তবে যে কথাটি উল্লেখ করা প্রয়োজন, তা হলো যে, একবার ইন্ডিয়ায় পা দিলে সহজে কারো পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসা সম্ভব ছিলো না। ইন্ডিয়ানরা নাকি তাতে রীতিমতো বাধা দিতো। ইয়াহিয়া খান কয়েক বার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। তাতে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি। তার আর একটা কারণ ছিলো এই যে ফেরৎ আসা শরণার্থীরা মাঝে মাঝে আর্মি এ্যাকশনের শিকার হতো। পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন জায়গায় শরণার্থীদের জন্য ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। দু’একটি দুর্ঘটনার পর এ সমস্ত ক্যাম্পে সহজে কেউ আসতে সাহস পেতো না। একদিকে কেন্দ্রীয় সরকার সাধারণ ক্ষমার নীতি যুক্তিযুক্তভাবেই গ্রহণ করেছিলেন, অন্যদিকে স্থানীয় আর্মির চরম হঠকারিতার জন্য সে নীতি বানচাল হয়ে যায়। 

সরকারী নির্দেশ মতো ইউনিভার্সিটি খোলা হলো। ছাত্র-ছাত্রী কেউ কেউ ফিরে এলো। ক্লাসও শুরু হলো। তবে এদের সংখ্যা ছিলো খুবই অল্প। অনেক ছাত্র-ছাত্রী আওয়ামী বাহিনীর ভয়েও ক্লাসে আসতে ভয় পেতো। যেমন অনেক সরকারী কর্মচারী কাজে যোগ দিতে ইতস্ততঃ করতো। কোলকাতা থেকে ঘোষণা করা হয়েছিলো যে স্কুল-কলেজ-অফিস-আদালত সবকিছু বর্জন করে প্রশাসনকে প্যারালাইজ করে ফেলতে হবে। তবে এটা মোটেই সম্ভব হয়নি। কাজকর্ম বিঘ্নিত হয়েছে সত্য কিন্তু প্রশাসনের কাজ রীতিমভোভাবে চলতে থাকে। তার একটা বড় প্রমাণ এই যে, বিদ্রোহী বাহিনী বহু চেষ্টা করেও কোন অঞ্চলে খাদ্য ঘাটতি ঘটাতে পারেনি। দেশের বাইরে থেকে খাদ্য আমদানী যেমন চালু ছিলো তেমনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চাল-ডাল এবং অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য পাঠানো হতো। চরম দুর্যোগের মধ্যেও কোন এলাকায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় নাই। হাট বাজারে মাঝে মাঝে বিদ্রোহী বাহিনীর লোকেরা এসে বোমা ফাটিয়ে অথবা গোলাগুলী করে ত্রাসের সৃষ্টি করেছে, কিন্তু সেটা সাময়িকভাবে।


অন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইন্ডিয়ার প্রপাগান্ডার ফলে পাকিস্তান খুব কাবু হয়ে পড়ে। কমনওয়েলথের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও একদিকে লন্ডন হয়ে উঠে আওয়ামীদের আশ্রয়স্থল। অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার সামরিক চুক্তি থাকা সত্ত্বেও ওয়াশিংটন সরকার পাকিস্তানের প্রতি সদয় ছিলো না। তখন বৃটেনের প্রাইম মিনিষ্টার এডওয়ার্ড হীথ। তাঁর ফরেন সেক্রেটারী ছিলেন স্যার এলেন ডগলাস হিউম। তিনি পার্লামেন্টে পাকিস্তানের ঘটনা সম্পর্কে এমন এক বিবৃতি দিলেন যাতে মনে হলো যে পাকিস্তানের প্রতি বৃটিশ সরকারের বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই। অথচ তখন পাকিস্তান কমনওয়েলথের সদস্য। তবে প্রথম পর্যায়ে বৃটেন পুরোপুরি ইন্ডিয়াকে বা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে সমর্থন করেনি। স্যার এলেন বলেছিলেন যে যুদ্ধ যখন বেঁধেছে এটার একটা ফয়সলা না হওয়া পর্যন্ত বৃটিশ সরকার কোনো স্পষ্ট নীতি গ্রহণ করতে পারছে না। লেবার পার্টির সদস্যরা অবশ্য চেয়েছিলেন আনুষ্ঠানিকভাবে পঁচিশ তারিখের ঘটনার জন্য পাকিস্তানের নিন্দাসূচক একটি প্রস্তাব পাশ করাতে। তবে লন্ডনে প্রবাসী বাংগালীদের মধ্যে একদল যেভাবে পাকিস্তান বিরোধী ষড়যন্ত্রে তৎপর হয়ে উঠে তাকে প্রতিহত করার চেষ্টা বৃটেন করেনি – পাকিস্তানের প্রবল প্রতিবাদ সত্ত্বেও। আসল কথা, বর্তমান যুগে পাবলিসিঢি যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এ সম্বন্ধে ইয়াহিয়া সরকার ছিলেন একেবারে উদাসীন। বলা হয় তো নিষ্প্রয়োজন ২৫ তারিখের এ্যাকশনের আগে ঢাকা থেকে জোর করে সব বিদেশী সাংবাদিককে তাড়িয়ে দেয়া হয়। এর ফল কি হতে পারে সেটা সরকার ভেবে দেখেনি। স্বভাবতঃই পূর্ব পাকিস্তানের খবর ভারতের মধ্যবর্তিতায় অতিরঞ্জিত হয়ে বিদেশে প্রচারিত হয়। কোলকাতা এবং দিল্লীতে বসে বাজারের গুজবের উপর নির্ভর করে বিদেশী সাংবাদিকেরা এমন চটকদার কাহীনি তৈরি করে যা পাঠ করে বিদেশী যে কোনো পাঠকের মনে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা ভয়াবহ ছবি আঁকা হয়ে যাবে। আমি এ কথা বলছি না যে পঁচিশ তারিখে এমনই কিছু ঘটেনি। কিন্তু ইয়াহিয়া সরকারের চরম নির্বুদ্ধিতার কারণে সত্য ঘটনা হাজার গুণ অতিরঞ্জিত হয়ে প্রচারিত হয়। পাকিস্তান কূটনৈতিক ক্ষেত্রে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পশ্চিম ইউরোপ এবং আমেরিকার কথা আলাদা, মুসলিম অধ্যূষিত মধ্যপ্রাচ্যেও পাকিস্তানের সমর্থন বিশেষ ছিলো না। শুধু সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সল পাকিস্তানের সমর্থনে জেহাদের আহ্বান দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও সাড়া পাওয়া যায়নি। মিসরও রীতিমতো পাকিস্তান বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ১৯৫৬ সালে যখন ইসরাইল, বৃটেন এবং ফ্রান্স সমবেতভাবে মিসরের উপর হামলা করে সেই সংকট মুহূর্তে তদানীন্তন পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রী জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী যে বিস্ময়কর উক্তি করেন মিসরীয় নেতারা সে জন্য কখনো পাকিস্তানকে ক্ষমা করতে পারেনি। সোহরাওয়ার্দী সাহেব বলেছিলেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের সব মুসলিম রাষ্ট্র আদতে শক্তিহীন। সুতরাং শূন্যের সঙ্গে যতোই শূন্য যোগ দেয়া হোক তার যোগ ফল শূন্যই দাঁড়াবে। মৌখিক সহানুভূতি দেখাতে পর্যন্ত পাকিস্তানের এই কার্পণ্যের কুফল থেকে পাকিস্তান এখনো ভুগছে। অথচ সেই সময় ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু মিসরের প্রতি তাঁর সর্বাত্মক সহানুভূতির কথা ব্যক্ত করেন। কার্যতঃ তিনি কিছুই করেননি, কিন্তু সংকট মুহুর্তের এই সহানুভূতির প্রয়োজন ছিলো। আমি পরে শুনেছি যে মিসর হয়ে ইউরোপ আমেরিকা থেকে অনেক অস্ত্র পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামীদের কাছে পৌছায়। ইসরাইলও আওয়ামীদের নৈতিক সমর্থন দিয়েছে। 

পাকিস্তানের কুটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার আর একটি প্রমাণ এ সময়েই আমাদের গোচরীভূত হয়। ফ্রান্সের বিখ্যাত লেখক আঁদ্রে মালরৌ ANDRE MALRAUX যিনি এককালে ফ্রান্সের সংস্কৃতি মন্ত্রী ছিলেন, ঘোষণা করেন যে বৃদ্ধ বয়সেও পূর্ব পাকিস্তানে যেয়ে তিনি বাংগালীদের পক্ষে লড়াই করতে প্রস্তুত। মালরৌ জেনারেল দ্যগলের এককালের বন্ধু। সারা পশ্চিম জগতে তাঁর প্রতিপত্তি ছিলো। সবাই তাঁকে সম্মান করতো। কিন্তু আশ্চর্য তাঁর ঐ ঘোষণার পরও তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্রকৃত অবস্থা তাঁকে বোঝাবার চেষ্টা পাকিস্তান করেছে বলে আমরা শুনিনি। ফ্রান্সে কর্মরত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত মালরৌর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বলে কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। বোধ হয় ইয়াহিয়া সরকারের ধারণা ছিলো যে আরো অনেক ব্যক্তি যেমন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিবৃতি জারী করতেন মালরৌর বিবৃতিটি তার আর বেশী কিছু নয়।

লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ, যেখানে এ অঞ্চলের অধ্যাপক এবং ছাত্র কিছু কিছু ছিলো, সেটাও পাকিস্তানের বিরোধী তৎপরতার একটি কেন্দ্রে পরিণত হয়। কর্মরত বৃটিশ অধ্যাপকদের মধ্যে অনেকে ধরে নিয়েছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তানে নির্মমতা যা হচ্ছিলো তার জন্য একতরফাভাবে পাকিস্তানই দায়ী। শত শত বিহারী এবং পাকিস্তানপন্থী বাংগালী মুসলমান আওয়ামীদের হাতে নির্মমতার শিকার হয়েছে, মনে হচ্ছিলো, সে খবর তাঁদের কানে পৌছায়নি। জুন মাসে এদের দু’একজনের সঙ্গে লন্ডনে আমার সাক্ষাৎ হয়। দেখলাম তাঁরা অত্যন্ত উত্তেজিত। পাকিস্তানের কোনো কৈফিয়ত থাকতে পারে তা তাঁরা শুনতেই রাজী নন।

আমি এবার আমার কাহিনীর মূলধারায় ফিরে যাচ্ছি। রাজশাহীতে অবস্থা স্বাভাবিক করবার প্রয়াসে আমি ইউনিভার্সিটি প্রশাসন চালু করার চেষ্টা করি। সিন্ডিকেটের মিটিং- এর জন্য তারিখ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু মিটিং-এর তিন চারদিন আগে – সঠিক তারিখগুলো আমার মনে নেই – ঢাকা থেকে চীফ সেক্রেটারী আমাকে ফোন করলেন যে আমার অবিলম্বে ঢাকা আসা প্রয়োজন। আমি জবাব দিলাম যে, সিন্ডিকেট মিটিং না করে আমার পক্ষে রাজশাহী ত্যাগ করা সন্তব নয়। আমাকে কেনো ঢাকা যেতে হবে এ প্রশ্নের জবাবে বলা হলো যে খুব জরুরী দরকার। আমি বলেছিলাম যে আট দশ দিন পর আমি ঢাকা আসবো। কিন্তু সিন্ডিকেট মিটিং-এর একদিন আগে আবার ফোন এলো যে কেন্দ্রীয় সরকার বিশেষ প্রয়োজনে আমাকে তলব করেছেন। আমাকে ইসলামাবাদ যেতে হবে। কেনো কি উদ্দেশ্যে তা বলা হলো না। তখন বাধ্য হয়ে সিন্ডিকেট মিটিং বাতিল করে আবার ঢাকা চলে আসি।


লন্ডন সফর


ঢাকা এসে শুনলাম যে সরকার ইউনিভার্সিটির কয়েকজন শিক্ষক, হাইকোর্টের একজন জাষ্টিস এবং কয়েকজন রাজনীতিবিদকে বিদেশ পাঠাবেন। পূর্ব পাকিস্তানে কি হয়েছে বা হয় নাই তার বিবরণ বাইরের দুনিয়ার কাছে তুলে ধরতে। রাজনীতিবিদ ছিলেন দু’জন। হামিদুল হক চৌধুরী ও মাহমুদ আলী। হাইকোর্ট থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন জাস্টিস নুরুল ইসলাম আর ঢাকা ইউনিভার্সিটি খেকে মনোনীত হয়েছিলেন বাংলা ডিপার্টমেন্টের ডঃ দীন মোহাম্মদ এবং হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের ডঃ মোহর আলী। আমি আপত্তি তুললাম এই বলে যে, যে কাজের জন্য সরকার আমাদের বিদেশে পাঠাতে চান সেটা বিশেষভাবে রাজনীতিবিদের কাজ, শিক্ষাবিদদের কাজ নয়। এবং আমাদের যদি বিদেশ যেতেও হয়, রাজনীতিবিদদের সঙ্গে একটু ডেলিগেশনে গেলে আমাদের বিশ্বস্ততা সাংঘাতিকভাবে ক্ষুণ্ণ হবে। সরকারী কর্মকর্তারা বললেন যে এসব কথা ইসলামাবাদে জানালে ভালো হবে। কিন্তু আমরা যদি একেবারেই যেতে অস্বীকার করি, চরম ভূল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হবে। বিবৃতি সই করাতে যেমন চাপ দেয়া হয়েছিলো এবার তেমনি চাপের মুখে পড়লাম। 

হামিদুল হক চৌধুরী এবং মাহমুদ আলী আমাদের আগেই ইসলামাবাদ গিয়েছিলেন। ডঃ দীন মোহাম্মদ এবং ডঃ মোহর আলী আমার সঙ্গে যাত্রা করলেন। আমার যদ্দুর মনে পড়ে জাস্টিস নুরুল ইসলামও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। পিন্ডিতে আমাদের রাখা হলো ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে। পিন্ডি সরকারের নিম্নপদস্থ এক অফিসার এসে খবর দিলেন যে ফরেন অফিসে যেয়ে ফরেন সেক্রেটারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে। আমি বললাম যে, আমি সরকারের আমন্ত্রণক্রমে পিন্ডি এসেছি। সুতরাং আমার পক্ষে অফিসে যেয়ে ফরেন সেক্রেটারীর সঙ্গে মোলাকাত করার প্রশ্নই উঠতে পারে না। আমি কোথাও যেতে রাজি নই। আমার এই অনমনীয় ভাব দেখে পরেরদিন এসিসট্যান্ট ফরেন সেক্রেটারী সৌজন্যমূলক সাক্ষাতের জন্য হোটেলে এসেছিলেন। তিনি বললেন যে ফরেন সেক্রেটারীর অফিসে আরো অনেকে জমায়েত হবেন। তিনি সেই সভায় যেতে আমাকে অনুরোধ করতে এসেছেন। তখন যেতে রাজী হয়েছিলাম। হোটেলে আর যাঁদের সাথে দেখা হয়েছিলো তাঁদের মধ্যে ছিলেন বেগম আখতার সোলায়মান – জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একমাত্র মেয়ে। উচ্চ শিক্ষিত এবং পরিশীলিত। বোধ হয় তাঁর কাছেই শুনলাম যে সরকার জনাব হামিদুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি পূর্ব পাকিস্তানী ডেলিগেশন পাঠাতে মনস্থির করেছেন। আমি আবার বললাম যে বিদেশে সরকারের পক্ষে প্রচার কার্য চালনা শিক্ষকের কাজ নয়। আমরা রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনো কথা বললে তার গুরুত্ব থাকবে না, লোকেরা ভাববে আমরা সরকারের চর হয়ে এসেছি। একজন রাজনীতিবিদের নেতৃত্বে কোনো প্রতিনিধি দলে যোগ দিতে আমি রাজী নই। ব্যক্তিগতভাবে হামিদুল হক চৌধুরী এবং মাহমুদ আলী সাহেবকে আমি চিনি। তাঁদের অসম্মান করার কোনো হেতু আমার নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের সাহচর্যে বিদেশ সফরে গেলে মিশনের আসল উদ্দেশ্য পন্ড হবে। আমাদের যদি যেতেই হয় আমরা শিক্ষকরা আলাদাভাবে যাবো। তাছাড়া বিদেশে সভাসমিতি বা রেড়িওতে বক্তৃতাও আমরা করতে পারবো না। যদি কেউ আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন আমরা আমাদের কথা বলবো।

ফরেন সেক্রেটারীর অফিসে ১৫-২০ জনের মতো লোক উপস্থিত ছিলেন। এঁদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ এবং শিক্ষাবিদও ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের তরফ থেকে কথা বললেন প্রধানতঃ হামিদুল হক চৌধুরী। সেক্রেটারী তাঁর ভাষণে বললেন যে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা সম্পর্কে অনেক গুজব এবং মিথ্যা কাহিনী প্রচারিত হচ্ছে। পাকিস্তানের নাগরিক হিসাবে আমরা যদি সত্য ঘটনা তুলে ধরি দেশ উপকৃত হবে। কারণ পূর্ব পাকিস্তানে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রাম শুরু হয়েছে সেটা যে পরিচালিত হচ্ছে সীমান্তের ওপার থেকে এক শত্রু দেশের সাহায্যে সে সম্পর্কে আর কোনো সন্দেহ নেই।

এ সমস্ত কথা যখন আলোচিত হয় তখন আমি প্রশ্ন তুলেছিলাম যে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে যে প্রচারপত্র ৭০ সালেই বিলি করা হচ্ছিলো, পাকিস্তান সরকার তার জবাব দেননি কেন? ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ এই শিরোনাম দিয়ে পাশাপাশি কতগুলো হিসাব বিন্যস্ত করে দেখানো হয়েছিলো যে পাকিস্তানে ব্যবহৃত সব জিনিসের জন্য পূর্ব পাকিস্তানীদের বেশী মুল্য দিতে হয়। কাগজ, সরিষার তেল ইত্যাদি যে সমস্ত বস্তু পূর্ব পাকিস্তানে উৎপাদিত হতো তার দামও নাকি পশ্চিমাঞ্চলে ছিলো অপেক্ষাকৃত সস্তা। অথচ আমরা জানতাম, অভিযোগ প্রায় সবটা মিথ্যা। যাক, আমার প্রশ্নের উত্তরে সরকারের সেক্রেটারী আজগুবী এক কৈফিয়ত দিলেন। তিনি বললেন জবাব একটা তৈরি করা হয় তাতে সরকারী কাগজপত্রে প্রকাশিত তথ্যাদি দিয়ে প্রমাণ করা হয় যে, আওয়ামী লীগের অভিযোগ ভিত্তিহীন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উচ্চপদস্থ জনৈক বাঙালী অফিসারের পরামর্শে সেটা প্রকাশ করা হয় নাই। ঐ অফিসার নাকি বুঝিয়েছিলেন যে, এ রকম বিবৃতিতে এ সময়ে আরো ভূল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হবে। 

শেষ পর্যন্ত সরকার আমাদের কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করে বিদেশ পাঠাতে রাজী হলেন। হামিদুল হক চৌধুরী এবং মাহমুদ আলী সাহেব ছিলেন বোধ হয় এক গ্রুপে, দীন মোহাম্মদ এবং জাস্টিস ইসলামকে নিয়ে হলো আর এক গ্রুপ। আমার গ্রুপে রইলেন ডঃ মোহর আলী।

এরপর আমাদের আরো কয়েকদিন ইসলামাবাদে থাকতে হয়েছিলো। কারণ বৃটিশ সরকার আমাদের ভিসা দিতে টালবাহানা করছিলো। এই সময়ে একদিন আমি মারীতে যাই আমার মেয়েকে দেখতে। এর আগে কখনো মারী আসিনি। শুনলাম আমার জামাতা ওয়ালী আহমদ মেজর পদে উন্নীত হয়েছে। ওদের বাসা ছিলো এক ছোট পাহাড়ের উপর। জুন মাস হলেও আবহাওয়া ছিলো বেশ ঠান্ডা। ঘরে বসার পর এক পর্যায়ে জানালা বন্ধ করে দিতে হলো। কারণ টুকরো মেঘ ভেসে আসছিলো। এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। মারীর রাস্তাঘাট বেশ পরিচ্ছন্ন, অনেকটা সুইজারল্যান্ডের গ্রামাঞ্চলের মতো। চারদিকে অসংখ্য পাইন গাছ। ইসলামাবাদ থেকে আসার পথে গভীর খাদের পাশে পাহাড় ঘেষা রাস্তা থেকে যে দৃশ্য চোখে পড়লো তার তুলনা হয় না। শুনলাম, মাঝে মাঝে এ সময়ে দু’দিক থেকে আসা গাড়িতে সংঘর্ষ হলে বাঁচবার আর কোন উপায় থাকে না। কয়েকশ, ফুট নীচে খাদের মধ্যে পড়তে হবে। মারীর আগে আরো কতগুলো ছোট জনবসতির নাম পেলাম। সবগুলোকেই বলা হয় গলি। এ গলিগুলির মধ্যে বিখ্যাত হচ্ছে নাথিয়াগলি। মাঝে মাঝে ফেরিওয়ালারা ফল বিক্রি করছে আপেল, এপ্রিকট, প্লাকস, আঙ্গুর ইত্যাদি। 

আমার মেয়ে মোহসিনার কাছে মারী অঞ্চলের একটি মেয়ে কাজ করতো। দেখলাম মোহসিনা ওর সঙ্গে খুব ভাব জমিয়েছে। মেয়েটার পরিবার অসম্ভব রকম গরীব। নতুন কাপড়-চোপড় পেয়ে সে মহাখুশী। কিন্তু এক ব্যাপারে কৌতুহল হল। ১৪-১৫ বছরের এই মেয়েটি আমার সামনে আসছিলো না। মোহসিনা বললো মেয়েটা বেগানা লোকের সামনে আসতে লজ্জা পাচ্ছে। মেয়েটি বাবুর্চিখানায় বসে চা তৈরি করে দিলো। মোহসিনা ট্রেতে করে সেটা আমাদের সামনে আনলো। বেশীক্ষণ থাকতে পারলাম না। কারণ পিন্ডিতে অনেক কাজকর্ম বাকী। বিদায় নেয়ার সময় মোহসিনা কেঁদেই ফেললো। দেশের যা পরিস্থিতি তাতে আমার সঙ্গে দ্বিতীয়বার দেখা হবে তার নিশ্চয়তা ছিলো কোথায়?

লন্ডনে আমাকে এবং মোহর আলীকে যে হোটেলে রাখা হয়, সেটা ছিলো কেনসিংটন অঞ্চলে। বাকিংহাম প্রাসাদের কাছেই। জানি না কিভাবে আমাদের লন্ডনে উপস্থিতির খবর ছড়িয়ে পড়েছিলো। কারণ পরদিন সকালে পূর্ব পাকিস্তানের বেশ কিছু লোক এসে হাজির। এর মধ্যে ছিলো আমার প্রাক্তন ছাত্র মকসুদুর রহমান হিলালী, সে তখন পিএইচডি করছে। এরা সবাই জানতে চাইলো পূর্ব পাকিস্তানে কি হয়েছে? এদের নিয়ে লাউঞ্জে বসরাম। কথা বলা শুরু করতেই ম্যানেজমেন্ট থেকে আপত্তি উঠলো। ওরা বললেন আপনারা লাউঞ্জে রাজনৈতিক সভা করতে পারবেন না। আমরা বললাম আমরা মিটিং করছি না। দেশবাসী আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছে। তাদের সঙ্গে আলাপ করার অধিকার আমাদের অবশ্যই আছে। লোক জমায়েত হয়েছিলো প্রায় কুড়িজন। গত্যন্তর না দেখে মোহর আলী এবং আমি এদের দু’ভাগ করে লাউঞ্জের দু’এলাকায় বসালাম। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যে ম্যানেজমেন্ট আবারো আপত্তি করতে শুরু করলো। শেষ পর্যন্ত আগন্তুকদের বিদায় দিতে আমরা বাধ্য হলাম। বিদায় নেবার আগে সিলেটের এক ভদ্রলোক তারস্বরে ম্যানেজমেন্টকে গালাগালি করলেন। বললেন তোমরা পাকিস্তান বিরোধী চক্রে শামিল হয়েছো। 

ডঃ মোহর আলী এবং আমি এক সঙ্গে হাইকমিশনে গিয়েছিলাম। পাকিস্তান হাইকমিশন নাইটসব্রিজ এলাকায় অবস্থিত। সেখানে দেখলাম যে প্রচুর বাংগালী অফিসার রয়েছেন, প্রায় শতকরা পঞ্চাশ ভাগ। হাইকমিশনার ছিলেন সালমান আলী; উর্দূভাষী। কিন্তু ডেপুটি হাইকমিশনার বাংগালী, সলিমুজ্জামান। এডুকেশনাল আটাশে ছিলেন তানবির আহমদ (ইনি পরে বাংলাদেশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হয়েছিলেন )। তানবির আহমদকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। ইতিহাসের লোক- এক সময় শিক্ষকতা করতেন। সলিমুজ্জামান সাহেবের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেলো – যে পাকিস্তানের প্রতি তাঁর আনুগত্যে ফাটল ধরেনি, তার কোনো সম্ভাবনাও ছিলো না। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। বললেন, পূর্ব পাকিস্তানবাসী যে আত্মঘাতী সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে তার কুফল তারা অচিরেই টের পাবে। জুনিয়র বাংগালী অফিসার যাদের সঙ্গে কথা হলো তাদের আচরণে আমি সংশয়াপন্ন হয়ে পড়লাম। মনে হলো শুধু চাকরীর খাতিরে দূতাবাস ত্যাগ করেননি – সুযোগ পেলেই করবেন। আমাদের সঙ্গে তারা খোলা মন নিয়ে আলাপ করতে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করলেন না।


সালমান আলী 

সালমান আলীর সঙ্গে যখন পরিচয় হলো তিনি অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন যে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলী সম্পর্কে ইসলামাবাদ সরকার তাঁকে বিশেষ কোন তথ্য সরবরাহ করছেনা। তাঁকেও নির্ভর করতে হয় শোনা কথা এবং গুজবের উপর। আমরা যখন বললাম যে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ২৫শের রাতে ৯ জন শিক্ষক নিহত হয়েছেন এবং ছাত্র দু’একজন, তিনি বিস্ময় প্রকাশ করলেন। তিনি আবু সাঈদ চৌধুরীর বক্তৃতা শুনেছিলেন এবং তাঁর ধারণা ছিলো সত্যি বুঝি কয়েকশ’ শিক্ষক এবং ছাত্র ২৫-শের রাত্রে নিহত হয়। সালমান আলী সানডে টাইমস পত্রিকার একটা সংখ্যা দেখালেন। পড়ে তো আমি অবাক। মৃতের তালিকার মধ্যে ছিলেন আমার বন্ধু-সহকর্মী কে এম মুনিম, মুনীর চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক-এ রকম আরো কয়েকজন। আমি যখন বললাম যে লন্ডন যাত্রার প্রাক্কালে আমি মুনিম সাহেবের সঙ্গে ফোনে আলাপ করে এসেছি, সালমান আলীর বিস্ময় আরো বৃদ্ধি পেল। তাঁকে আরো বললাম যে আমি বিশ্বস্ত সুত্রে খবর নিয়ে এসেছি যে মুনীর চৌধুরী এবং আবদুর রাজ্জাক জীবিত। সালমান আলীকে আরো বলা হয়েছিলো যে ঢাকায় নাগরিক জীবন বলে কিছু নেই।

তানবির আহমদের রুমে যখন গেলাম, পুরানা পরিচয় সুত্রে অনেক আলাপ হলো। তিনি ড্রয়ার থেকে বড় হরফে ইংরেজীতে লেখা একটা লিফলেট বা প্রচারপত্র দেখালেন। বললেন তাঁর পরিচিত এক বাংগালী মহিলা ওটা লন্ডনের রাস্তায় বিলি করছিলেন। প্রচারপত্রে লেখা ছিলো, ‘আপনাদের মধ্যে বিবেক বলে যদি কিছু থাকে তবে পাশবিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন।’ এরপর ছিলো কয়েকটি লোমহর্ষক কাহিনী এক পিতার বরাত দিয়ে বলা হয়েছিলো যে ২৫শের রাত্রে আর্মি ঢাকায় মেয়েদের হলে ঢুকে শুধু গুলী করে অনেক মেয়েকে হত্যা করেনি, তাদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছে। সমকামী পাঠান সৈন্যরা মেয়েদের ঐ জঘন্য প্রকারেও ধর্ষণ করেছে। বক্তা পিতা আরো আরো বরেছিলেন যে এ সমস্ত ঘটনা নীচের তলায় যখন হচ্ছিলো তখন জন পঞ্চাশেক মেয়ে উপর তলা থেকে এ সমস্ত কান্ড দেখছিলো। তারা যখন বুঝতে পারলো যে এর পরেই তাদের পালা তখন তারা উপর থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে। ওর মধ্যে বক্তার কন্যাও ছিলো। তানবির আহমদ যখন বর্ণনার বীভৎসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ঐ মহিলাকে বলেছিলেন যে আপনি নিজেই বুঝতে পারছেন যে এ ঘটনার মূলে কোন সত্যতা নেই। মহিলা জবাব দিয়েছিলেন Every thing is fair in love and war অর্থাৎ যুদ্ধ এবং প্রেমের ব্যপারে অন্যায় বলে কিছু নেই।

তানবির সাহেবকে আমি বললাম যে ঢাকায় আমি নিজে মেয়েদের হলের প্রভোস্ট মিসেস আলী ইমামের সঙ্গে ফোনে কথা বলে এসেছি। তাঁর কাছে যা শুনেছি তা হলো এই ৭ই মার্চের পর অধিকাংশ মেয়ে হল ছেড়ে চলে যায়। ২৪ তারিখে ৫ জন মেয়ে মাত্র হলে ছিলো। ২৪ তারিখের দিকে যখন আর্মি এ্যাকশনের সন্তাবনা সম্বন্ধে ঢাকায় গুজব ছড়াতে থাকে তখন মিসেস ইমামের নির্দেশে এই মেয়েগুলোও হল ছেড়ে জনৈকা হাউজ ঢিউটরের বাসায় আশ্রয় নেয়। সুতরাং হলের মেয়েদের উপর অত্যাচার বা ধর্ষণের কোনো কথাই উঠতে পারে না। হলের চারদিকে ছিলো চতুর্থ শ্রেণীর কোয়াটার্স। এদের কেউ কেউ আর্মির গুলী খেয়ে মারা পড়ে। আমার বর্ণনা শুনে তানবির তো অবাক।

তানবির আহমদের অফিসেই আমাদের লন্ডন থাকার খরচপত্রের প্রথম কিস্তি দেওয়া হয়। যে রশিদ আমরা সই করেছিলাম তার ফটোকপি বাংগালী অফিসাররা গোপনে আওয়ামী লীগ পন্থী লোকজনের হাতে পাচার করে। তবে এটা করা হয়েছিলো এতো কৌশলে যে রসিদে সই করার সময় যদিও কোন বাংগালী অফিসার উপস্থিত ছিলেন না, তবু এর কপি তারা সংগ্রহ করে ফেলেন। তানবির আহমদ এবং তাঁর সহকর্মীদের অসতর্কতার জন্য কোনো কিছুই গোপন খাকতো না। তা ছাড়া আরো লক্ষ্য করেছি যে সালমান আলী বা সলিমুজ্জামান তখন পর্যন্ত বিশ্বাস করেননি যে বাংগালী অফিসাররা কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। আমরাই পরে সালমান আলীকে জানিয়ে ছিলাম যে আমাদের সন্দেহ হয় জুনিয়ার বাংগালী অফিসার অনেকে আওয়ামী লীগের সমর্থক। 

সালমান আলী বললেন যে পাবলিসিটির অভাবে পাকিস্তানের ইমেজ এমনভাবে নষ্ট হয়েছে, এমপিরা পর্যন্ত তাঁকে কুৎসিত ভাষায় গালাগালি করে চিঠিপত্র লিখতে বা ফোন করতে শুরু করেছিলেন। তাঁরা সালমান আলীর কোন জবাবই শুনতে চাইতেন না। এই এমপির দলে ছিলেন লেবার পার্টির জনস্টোন হাউজ। সালমান আলী হাই কমিশনার হিসাবে খবরের কাগজে বিবৃতি পাঠিয়েছেন, কিন্তু সে বিবৃতি কোনো পত্রিকায়ই ছাপা হয়নি। এক পর্যায়ে সালমান আলী বললেন, আপনারা যে সমস্ত তথ্য আমাকে জানিয়েছেন তা লিখিতভাবে দিলে আমি বিশেষভাবে উপকৃত হবো। বলতে পারবো যে এটা পূর্ব পাকিস্তানের দু’জন শিক্ষিত লোকের কথা। একটা ছোট বিবৃতি খাড়া করা হলো। এটায় আমার ও মোহর আলীর স্বাক্ষর ছিলো। আমরা লিখেছিলাম যে ২৫শের রাতে অনেক নির্মম এবং অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু লন্ডনের কাগজে যা প্রচারিত হচ্ছে তার শতাংশের একাংশও সত্য নয়। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে নিহত হয়েছিলেন ৯ জন শিক্ষক। এর মধ্যে আমরা জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, ডঃ জিসি দেবের নাম উল্লেখ করে বলি যে, এই অপ্রীতির ঘটনার জন্য আমরা শুধু দুঃখিতই নই, এর নিন্দা করতেও আমাদের কুণ্ঠা নেই। মেয়েদের হলের ব্যাপার উল্লেখ করি এবং লন্ডনে বিলিকৃত লিফলেটের নিন্দা করে বলি যে এ রকম প্রচারণায় পূর্ব পাকিস্তানীদের দুঃখের লাঘব হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। যারা এই প্রচারণা চালাচ্ছেন তারা চান না যে পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি ফিরে আসুক। 

বিবৃতিটি লেখা হয়েছিলো সালমান আলীর ব্যবহারের জন্যে। তিনি বললেন এটা তিনি খবরের কাগজে পাঠাতে চান। আমরা আপত্তি করিনি। কারণ এতে এমন কোনো কথা ছিলো না যা অসত্য। অথচ এই বিবৃতি বিকৃত হয়ে ভারতবর্ষে প্রচারিত হয়। এটা প্রথম বের হয়েছিলো লন্ডন টাইমস পত্রিকায়। আমি যখন জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষে দেশে ফিরে আসি, আমার এক আত্মীয়, সৈয়দ আলী আহসানের ছোট ভাই সৈয়দ আলী রেজা এসে বললো যে, সে পূর্ব পাকিস্তানের কাগজে পড়েছে যে আমরা নাকি টাইমসকে জানিয়েছিলাম যে দেশে ২৫ তারিখের রাতে কেউ মারা পড়েনি। রেজা আমাকে বললো, সাজ্জাদ ভাই, আপনি এমন কথা বলতে পারলেন কিভাবে? আমি বললাম, তুমি কি আমার মূল চিঠি দেখেছো? সে বললো না। আমি বললাম, তা হলে তুমি কেমন করে বিশ্বাস করলে যে ঐ রকম জঘন্য একটা মিথ্যা আমি উচ্চারণ করতে পারি। ক্যাম্পাসে ২৫ তারিখে কি হয়েছিলো সে সম্বন্ধে কয়েকটি গুজবের জবাব দিয়েছি মাত্র। কোথায়ও কিছু হয়নি এমন কথা কস্মিনকালেও বলিনি। 

লন্ডনে আমাদের একমাত্র পাবলিক অ্যাপয়েনমেন্ট ছিলো প্রফেসর যায়েদীর অনুরোধে লন্ডন স্কুল অব এশিয়ান এ্যান্ড আফ্রিকান ষ্টাডিজ-এ লাঞ্চের নিমন্ত্রণ। যায়েদী সাহেবকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। ইতিহাসের লোক। উত্তর ভারত থেকে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে যখন এসে উপস্থিত হই তখন করাচীর বাংলার অধ্যাপক নুরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা। করাচীতে তাঁকে চিনতাম। কিন্তু এখানে মনে হলো তিনি আমাকে এবং মোহর আলীকে দেখে বেশী সন্তুষ্ট হলেন না। যায়েদী সাহেব তাঁর সহকমীঁ দু’জন বৃটিশ অধ্যাপককে আমাদের সঙ্গে লাঞ্চে ডেকেছিলেন। আমি আগেই উল্লেখ করেছি এঁদের মনে হলো খুব উত্তেজিত। আমাদের কথা শুনলেন কিন্তু প্রতিবাদ করে বলতে লাগলেন যে আর্মি অনেক নৃশংসতার জন্য দায়ী। আমরা বলেছিলাম যে নৃশংসতার নিন্দা আমরা অবশ্যই করি কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদের সমর্থন আমরা করতে পারি না। আমাদের বিশ্বাস পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ লোক পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় না, তারা চায় স্বাধিকার। 

লন্ডনে আমাদের আর কারো সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। হাইকমিশনে আমাদের জিজ্ঞাসা করা হলো, আমরা ইউরোপের অন্যান্য দেশে সফর করতে রাজী কি-না। আমি এ প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাখান করি। সালমান আলীকে বলি যে বিদেশে আমরা পাকিস্তানের সমর্থনে যাই বলি না কেনো তা বিকৃত হয়ে দেশে প্রচারিত হবে। এর ফলে আমাদের পরিবারের লোকজন বিপন্ন হবে। কারণ সরকার যতোই বলুন কারো নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারছিলেন না। সালমান আলীর বিশেষ অনুরোধে আমরা শুধু আমেরিকা যেতে রাজী হলাম। মোহর আলী, জাস্টিস নুরুল ইসলাম, ডঃ কাজী দীন মোহামদ এবং আমি লন্ডন থেকে নিউইয়র্ক যাত্রা করি। 

প্লেন লন্ডন থেকে আয়ারল্যান্ডের শ্যানন এয়ার পোর্টে এসে প্রথম নামলো। সেখানে প্রায় ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। লাউঞ্জে দেখলাম অনেক আইরিশ পরিবার। তারা ঐ প্লেনে আমেরিকা যাবে । প্রত্যেক দলেই অনেক ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। তখন মনে হলো আয়ারল্যান্ড ক্যাথলিক দেশ। এখানে কেউ জন্মনিয়ন্ত্রণে বিশ্বাস করে না। 


নিউইয়র্কের ঘটনা

চার ঘন্টায়, আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে নিউইয়র্কের আকাশে এসে পৌছলাম। কিন্তু নিউইয়র্কের বিখ্যাত আইডল ওয়াইল এয়ারপোর্টে প্লেন নামতে পারলো না (এই এয়ারপোর্ট বর্তমানে জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্ট নামে পরিচিত)। নিউইয়র্কে তখন ঝড় হচ্ছিলো। নিউইয়র্ক স্টেটের অন্য একটি এয়ারপোর্টে আমরা নামি এবং সেখানে কাস্টম চেকিং হয়ে যায়। কিছুকাল বাদে আবহাওয়া শান্ত হলে আমাদের নিউইয়র্কে নিয়ে আসা হয়। পাকিস্তানী এমব্যাসির লোকজন এয়ারপোর্ট থেকে এক হোটেলে নিয়ে গেলো। হোটেলের চেহারা দেখে আমরা সবাই অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বললাম যে সরকারী অতিথি হিসাবে আমরা চতুর্থ শ্রেণীর এ হোটেলে থাকতে রাজী নই। এমব্যাসির লোকজনেরা বুঝাতে চেষ্টা করলেন যে অন্ততঃ পক্ষে প্রথম রাতটা এখানে যেনো কাটাই। আমরা চারজনই বললাম সে হতেই পারে না। শেষ পর্যন্ত ওরা আমাদের একটা ভালো হোটেলে নিয়ে গেলো। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ডিনার খেয়ে আমরা শুয়ে পড়লাম। আমার যদ্দুর মনে পড়ে আমি এবং মোহর আলী একই হোটেলে ছিলাম। জাস্টিস নুরুল ইসলাম এবং কাজী দীন মোহাম্মদের জন্য অন্য ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। পরদিন সকাল বেলা আমাদের এক আমেরিকান প্রফেসরের সঙ্গে আপয়েনমেন্ট ছিলো। গোসল করে কাপড়-চোপড় পরে ব্রেকফাস্ট খেতে নীচে নামবো এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। মোহর আলীর গলা। সে বললো কয়েকজন নিউইয়র্কবাসী বাংগালী ছেলে তাকে কামরায় আটক করে রেখেছে। তাকে বেরুতে দিচ্ছে না এবং বলছে তক্ষুণি তাদের দলে গিয়ে যোগ দিতে। আমি নিজের কামরা থেকে বেরিয়ে এসে মোহর আলীর কামরায় নক করলাম। দেখলাম, সত্যি তিন চারজন বাংগালী উপস্থিত। আমাকে দেখেও তারা বলে উঠলো আপনাদের আমরা কাজে বেরুতে দেবো না। আপনারা এখনই আমাদের সঙ্গে চলুন। এখানে আমরা বাংগালীরা দেশের মুক্তির জন্য যে আন্দোলন চালিয়েছি তাতে আপনাদের যোগ দিতে হবে। আমাদের কোনো কথাই তারা শুনবে না।

এই দলে একজন প্রবাসী ডাক্তারও ছিলো। এরা নাছোড়বান্দা, আমাদের একবারেই বেরুতে দেবে না। আমি বললাম, আমরা সকাল বেলা নাশতা পর্যন্ত করিনি। এখন প্রায় ৮টা বাজে। আমাদের ব্রেকফাস্ট রুমে যেতে দিন। এ প্রস্তাবে ওরা রাজী হলো। কিন্তু আমাদের টেবিলেই দু’জন ব্রেকফাস্ট অর্ডার দিলো। আমাদেরকে দৃষ্টির আড়াল হতে দেবে না। ব্রেকফাস্টের পর আবার সেই কথা, আপনারা বাংগালী হয়ে বাংগালীদের স্বার্থবিরোধী কাজ করছেন কেনো? আপনাদের ইয়াহিয়া খানের দালালী করতে দেয়া হবে না। আমরা বললাম, আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। পূর্ব পাকিস্তানে কি হচ্ছে সেটা স্বচক্ষে দেখে এসেছি। এ সম্বন্ধে আমাদের নিজস্ব মতামত আছে। পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলে বাংগালী পান্জাবী সবারই দুর্গতি হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আমাদের কখা বলার অধিকার নিশ্চয়ই আছে। ওরা এসব কিছুই শুনতে রাজী নয়। 

বাইরের কাউকে আমাদের অবস্থার কথা জানাবো তার উপায় ছিলো না। আমি শেষ পর্যন্ত বললাম, আমাকে বিশেষ কারণে আমার কামরায় যেতে হবে। আমাকে ছেড়ে দিন। মোহর আলী অপনাদের কাছে জিম্মি হয়ে রইলো। আমি উপরে এসে পাকিস্তানের ইউএন এমব্যাসেডর আগা শাহীকে ফোন করে সব ঘটনা বলি। উনি বললেন, আমি লোক পাঠিয়ে আপনাদের উদ্ধার করার ব্যবস্থা করছি। তখন প্রায় ৯টা বাজে। পাকিস্তান এমব্যাসি থেকে আমাদের নেবার জন্য লোক এসেছিলেন, কিন্তু আমাদের ওদের সঙ্গে বেরুবার উপায় ছিলো না। আমি কামরায় অপেক্ষা করতে লাগলাম। ১৫/২০ মিঃ মধ্যেই নিউইয়র্কের পুলিশ এসে হাজির হলো। বিরাট লম্বা চওড়া জোয়ান। তারা অনায়াসেই বাংগালীদের সরিয়ে দিয়ে আমাদের উদ্ধার করলো। কাপড়-চোপড় যা ওয়ার্ডরোবে ছিলো তার কিছু কিছু ফেলে আসতে হলো। কারণ এখন এ সব প্যাক করার সময় নেই। এভাবে পুলিশ এসে পড়বে বাংগালী ছেলেরা তা ভাবতে পারেনি। তারা এজন্য প্রস্তুত ছিলো না। তা ছাড়া নিউইয়র্কের পূলিশের সঙ্গে লড়াই করে আমাদের হাইজ্যাক করার ক্ষমতাও তাদের ছিলো না। লিফটে নামবার সময় আমাদের দিকে কটমট করে তাকিয়ে একজন বিড়বিড় করে বললো We will see you around অর্থাৎ দেখে নেবো। আরো বললো আমি গভর্ণর মুনেমের দালাল। রাজশাহীর ভাইস চান্সেলর হওয়ার কোনো যোগ্যতাই আমার ছিলো না। পাঞ্জাবীদের পদলেহন করে আমি এই পদ করায়ত্ত করেছি। এসব কথার জবাব দেওয়া মনে করলাম সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন। 

ট্যাক্সি করে আমাদের নিউইয়র্কের অন্য প্রান্তের এক নিরালা এলাকায় নিয়ে আসা হলো। সেদিনের কোনো এপয়েন্টমেন্ট রক্ষা করা সম্ভব হলো না। হোটেলের সামনে একটা ছোট্ট পার্ক ছিলো। এখানে হিপিদের আড্ডা। নর-নারী মিলে সারাদিন মদ খেতো এবং নানা দুষ্কর্ম করতো। এমব্যাসির লোকেরা সাবধান করে দিলেন আমরা যেনো একা পার্কে না যাই। হিপিরা নাকি ছুরি দেখিয়ে দরকার হলে তা ব্যবহার করে মদ এবং গাঁজা খাওয়ার পয়সা জোগাড় করতো। এই হোটেলে বাংলাদেশ আন্দোলনের কেউ এসে আর উৎপাত করতে পারেনি। সবচেয়ে আশ্চর্য হলাম এ ভেবে যে, আমেরিকায় আমাদের প্রোগ্রামের খুঁটিনাটি লন্ডন থেকে বাংলাদেশ আন্দোলনের লোকজনের কাছে এসেছে। 

আগা শাহীর সঙ্গে যখন দেখা হলো, তিনি দুঃখ করে বললেন যে তাঁর বাংগালী কর্মচারী সবাই বিশ্বাসঘাতকতা করছে। তাদের কাউকে তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। কিছু গোপন থাকে না। সে জন্য বাধ্য হয়ে খুব জরুরী cipher তিনি নিজ হাতে টাইপ করেন। লন্ডনে যেমন দেখেছিলাম দূতাবাসের কর্মচারী প্রায় অর্ধেক বাংগালী, নিউইয়র্কেও তাই এবং সম্ভবতঃ বাংগালী কর্মচারীদের অনুপাত এখানে আরেকটু বেশী ছিলো। আগা শাহীর নীচের পদটিতে ছিলেন আতাউল করিম বলে এক বাংগালী ভদ্রলোক। তিনি আগা শাহীর উপস্থিতিতে পাকিস্তানের সংহতির কথা বলতেন কিন্তু আমার মনে হতো যে তাঁর বিশ্বাসে ভাঙ্গন ধরেছে। আরো কিছুকাল পর তিনি স্বপক্ষ ত্যাগ করে আওয়ামী দলে যোগদান করেন। 

লন্ডনে ও নিউইয়র্কে এবং পরে ওয়াশিংটনেও বাংগালী কর্মচারীর যে অনুপাত লক্ষ্য করেছিলাম তাতে মনে হয়েছিলো যে বাংগালীরা ডিপলোমেটিক সার্ভিস-এ বিশেষ পাত্তা পাচ্ছে না বলে যে প্রচারণা চালানো হতো তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। হয়তো এ কথা সত্য যে যোগ-বিয়োগের হিসাব করে দেখা যেতো ১৯৭০-৭১ সালে অবাংগালী কর্মচারীর সংখ্যাই বেশী ছিলো কিন্তু তার কারণ ঐতিহাসিক। ‘৪৭ সালের পর যে সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানী যুবক সেন্ট্রাল সার্ভিস-এ যোগদান করে তাদের মধ্য থেকেই বাংগালী কূটনীতিক নির্বাচন করতে হতো। অপর পক্ষে ভারতীয় অবাংগালী মুসলমান যারা অপশন দিয়ে পাকিস্তানে যোগদান করেন তাঁরা ছিলেন বয়সে এবং অভিজ্ঞতায় অনেক বেশী প্রবীণ। তাঁদের দাবী উপেক্ষা করে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে অন্ধভাবে সমতা রক্ষা করা সম্ভব ছিলো না। এ রকম প্রস্তাব কোনো সুস্থ-মস্তিষ্ক ব্যক্তি দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। 

অনেক বাংগালী শিক্ষকও এ্যাডহক অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়ে রাতারাতি ডিপলোমেট পদে উন্নীত হন। বর্মায় পাকিস্তানের প্রথম এ্যামবেসেডর ছিলেন বগুড়ার সৈয়দ মোহাম্মদ আলী। তিনি পরে ওয়াশিংটনে এ্যামবেসেডর নিযুক্ত হন। বার্মায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত যিনি হন তিনি ঢাকার আর্মানিটোলা হাই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক কমর উদ্দিন আহমেদ। পরে ইনি আওয়ামী লীগের পক্ষ গ্রহণ করে সোশাল হিস্ট্রি অব ইস্ট পাকিস্তান নামক ইংরেজীতে একটি বই লেখেন। ভাযা অত্যন্ত কাঁচা। তাঁর মতামতে আমি অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছিলাম। কারণ তিনি লিখেছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের সামাজিক ইতিহাসে ইসলামের স্থান বিশেষ নেই। এর মধ্যে বাংগালী জাতীয়তাবাদের কথা প্রথম উচ্চারিত হতে দেখা যায়। তিনি আরো লিখেছিলেন যে মুসলিম লীগের আন্দোলনে বাংলার মুসলমানের সমর্থন বিশেষ ছিলো না। তার প্রমাণ স্বরূপ তিনি এমন এক ঘটনা উল্লেখ করেন যার প্রত্যক্ষদর্শী আমি নিজে। ১৯৩৬ সালে জিন্নাহ সাহেবের প্রথম ঢাকা সফরের সময় সলিমুল্লাহ মুসলিম হল মিলনায়তনে যে সভা হয় তাতে নাকি বিশেষ কেউ যায়নি, হলের অনেকাংশ খালি পড়ে ছিলো। আমি তখন ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্র। এই সভায় উপস্থিত ছিলাম। মিলনায়তনে চেয়ার একটিও খালি ছিলো না। আমি এবং আমার সঙ্গে আর যে দু’জন ছিলেন- আমরা দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুনি। অথচ কমর উদ্দিন সাহেবের বিবরণ পাঠ করলে মনে হবে যে জিন্নাহ সাহেবের কথা শোনার আগ্রহ মুসলিম ছাত্র সমাজের মোটেই ছিলো না। আমার আরো মনে আছে যে, সলিমুল্লাহ হলের এই সভায় জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে স্যার মোহাম্মদ আজিজুল হক এবং মৌলবী তমিজ উদ্দিন ছিলেন। তাঁরাও বক্তৃতা করেছিলেন। 

বার্মায় পাকিস্তানের তৃতীয় এ্যামবেসেডর ছিলেন ঢাকার প্রখ্যাত উকিল সুলতান উদ্দিন আহমদ। তিনি ঢাকা ইউনিভার্সিটি ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের প্রাক্তন ছাত্র। আমি যখন ১৯৫৪ সালে চারজন ছাত্র সমভিব্যাহারে বার্মা যাই তখন সুলতান উদ্দিন সাহেব তার বাড়িতেই আমাদের রাখেন। তাঁর ব্যক্তিগত মেহমান হিসেবে। 

১৯৭০-৭১ সালে চীনের মতো দেশে এ্যামবেসেডরের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটির আর এক প্রাক্তন ছাত্র খাজা কায়সার। ১৯৩৯ সালে ইতিহাসে ডিগ্রী নিয়ে ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসে যোগ দেন। ইউনিভার্সিটিতে তাঁর সঙ্গে পরিচয় ছিলো। আমার চেয়ে দু’বছরের সিনিয়র। ১৯৭০ সালে মাও সেতুং-এর কম্যুনিস্ট রেভুলুশনের বিজয় দিবস উপলক্ষে পাকিস্তান থেকে যে ডেলিগেশন পিকিং- এ যায় আমি তার সদস্য ছিলাম। পাকিস্তানের লেফটেন্যান্ট জেনারেল আতিকুর রহমান ছিলেন দলের নেতা। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আমার সঙ্গে ছিলেন ইত্তেফাকের মুঈনুল হোসেন। খাজা কায়সার আমাদের সঙ্গে সঙ্গে থেকে আমাদের বিশেষভাবে আপ্যায়িত করেন। আমার মনে আছে যে ১লা অক্টোবর তিয়েন আনমেন স্কোয়ারে যে প্যারেড হয় সে প্যারেড দেখার সময় খাজা কায়সার আমাকে বিশেষভাবে বলেন যে, আপনাদের ভাগ্য ভালো হলে চেয়ারম্যান মাও অন্যান্য বছরের মতো গ্যালারির সামনে একবার ঘুরে যেতে পারেন। যদি তিনি আসেন বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে সামনের দিকে ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে দিবেন। তিনি করমর্দন করবেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ সে বছর স্বাস্থ্যগত কারণে চেয়ারম্যান মাও গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে সামরিক বাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করলেন, কোনো দিকে গেলেন না। 

‘৭০ সালের শেষ দিকে বা ‘৭১ সালে – আমার ঠিক তারিখ মনে নেই – কেনিয়াতে পাকিস্তানের হাইকমিশনার ছিলেন ডঃ ওসমান গনি। ঢাকা ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন ভাইস চান্সেলর। এমন কি ‘৭১ সালেও যুদ্ধ আরম্ভ হবার পরও আরো কয়েকজন বাংগালীকে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয়। একজনের নাম বিশেষ করে মনে পড়ছে। রেজাউল করিম। লন্ডনে তানবির আহমদের অফিসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিলো। তিনি বলেছিলেন যে তিনি কিছুদিনের মধ্যেই রাষ্ট্রদূত হিসেবে পুর্ব ইউরোপের একটি দেশে যাচ্ছেন। যদ্দুর মনে পড়ে সে দেশটি হলো চেকোশ্লোভাকিয়া। আমি এ সব নাম উল্লেখ করলাম এ কথা বুঝাতেই যে ডিপলোমেটিক সার্ভিসে ‘৭০-‘৭১ সালের দিকে উচ্চতম পদে বিশেষ কোনো বাংগালী ছিলেন না, এ কথা আদৌ সত্য নয়। 

লন্ডন এবং নিউইয়র্কের ঘটনায় আমার মনে একটা সন্দেহ বদ্ধমূল হয়ে উঠছিলো। এখন আর সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। রাজশাহীতে যেমন দেখেছিলাম যে রাস্তায় গাছের গুড়ি দিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করার জন্য ২৫শে মার্চের অনেক আগে কনট্রাকটর নিযুক্ত করা হয়, তেমনি কূটনৈতিক সার্ভিসেও বাংগালী আফিসার সবাই গৃহ যুদ্ধ বাঁধলে কি করতে হবে সেজন্য তৈরি হয়েছিলেন। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে আমার পক্ষে এ কথা বিশ্বাস করাই সত্য যে, পঁচিশ তারিখ রাতের ঘটনার আকস্মিকতায় ক্ষুদ্ধ হয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই এতবড় একটা আন্দোলন orchestrate করা সম্ভব হতে পারে না। সবাই যেনো জানতো কখন কি হবে এবং তার প্রতিরোধ কিভাবে করতে হবে। এইভাবেই আমাদের লন্ডন এবং নিউইয়র্কের প্রোগ্রাম ফাঁস করে দেয়া হয়। তার মানে লন্ডনে যাঁরা কাজ করছিলেন তাঁদের সঙ্গে নিউইয়র্ক এবং ওয়াশিংটনে কর্মরত কর্মচারীদের রীতিমতো যোগাযোগ ছিলো। দিল্লীর আমজাদ হোসেন, কোলকাতার হোসেন আলী, আবু সাঈদ চৌধুরী, নিউইয়র্ক এবং ওয়াশিংটনের বাংগালী কর্মচারীরা মনে হচ্ছিলো একই মাষ্টার প্ল্যান বাস্তবায়িত করে চলেছেন। এই প্ল্যানের প্রয়োজনেই নানা প্রকারের উস্কানী দিয়ে আর্মিকে এ্যাকশনে নামতে প্ররোচিত করা হয়। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট অবরোধের আর কি অর্থ হতে পারে? আর যে নির্বোধ আর্মি অফিসারদের উপর দেশ রক্ষার ভার ছিলো, তারা এই ফাঁদে পা দিয়ে পূর্বাপর কোনো ভাবনা না করে ২৫ তারিখের রাত্রে কতকগুলো নিরপরাধ এবং নিরীহ লোক হত্যা করে। এদের অধিকাংশের সঙ্গে রাজনীতির কোনো সংশ্রব ছিলো না।

(বইটির pdf version download করুন এখানে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>