অধ্যায় ৬: আমেরিকার অভিজ্ঞতা
আমেরিকার অভিজ্ঞতা
আমেরিকায় যে তিনটি এপয়েন্টমেন্টে যোগ দিতে পেরেছিলাম, তার একটি হচ্ছে কংগ্রেসের এক সদস্যের সঙ্গে সাক্ষাৎকার। দ্বিতীয়টি একজন প্রভাবশালী অধ্যাপকের সঙ্গে আলোচনা এবং তৃতীয়টি পাকিস্তানের প্রেস কাউন্সিলার-এর দেয়া এক লাঞ্চ। এই লাঞ্চে বেশ কিছু মার্কিন সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। কংগ্রেসম্যান (তাঁর নামটা এখন মনে পড়ছে না) পাকিস্তান সংকটে প্রচুর সহানুভূতি প্রকাশ করলেন এবং বললেন যে, তাঁর বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে পাকিস্তানের শত্রুরা এর পেছনে সক্রিয়। তিনি আরো বললেন যে পাকিস্তানের বক্তব্য যাতে আমেরিকান জনসাধারণের কাছে পৌছে দেয়া যায় তার চেষ্টা তিনি করবেন। তবে একথা বুঝতে আমার অসুবিধা হয়নি যে সোজাসুজি পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আগ্রহ কোনো আমেরিকান রাজনীতিকের ছিলো না। তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট মিঃ নিক্সন। পরবর্তীকালে যে সমস্ত দলিল বিশেষ করে তাঁর সেক্রেটারী অব ষ্টেট হেনরি কিসিঞ্জারের বই -‘দি হোয়াইট হাউজ ইয়ারস’-এ যে সমস্ত কথা প্রকাশিত হয়েছে তাতে মনে হয় যে যদিও প্রেসিডেন্ট নিক্সন নিজে অনেকটা পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন, তাঁর অধিকাংশ উপদেষ্টা ছিলেন ভারত সমর্থক। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করার আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইউরোপ ও আমেরিকা সফর করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাথেও তিনি দেখা করেন। সেই সাক্ষাৎকারের যে বিবরণ বেরিয়েছে তাতেও প্রমাণিত হয় যে প্রেসিডেন্ট নিক্সন মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন বটে, কিন্তু তার কারণ ছিলো এই যে তিনি বিশ্বাস করতেন যে অচিরেই পাকিস্তান ভেঙ্গে পড়বে। সুতরাং হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন কি? নিক্সন যদি জোরালো ভাষায় মিসেস গান্ধীকে বাধা দিতেন, বলা নিষ্প্রয়োজন যে, ভারত পাকিস্তানের উপর সশস্ত্র আক্রমণ করার সাহস পেত না এই ঘটনায় আরো প্রমাণিত হয় যে ভারতের প্রচারণার ফলে পাকিস্তান কতটা নিঃসঙ্গ ও অসহায় হয়ে পড়েছিলো। বড় শক্তিগুলির মধ্যে একমাত্র চীন শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের পক্ষ সমর্থন করে। কিন্তু চীনের পক্ষে সরাসরি সৈন্য পাঠিয়ে ভারতের মোকাবেলা করা সম্ভব ছিলো না। এই খবর চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌএন লাই পাকিস্তানকে গোপনে জানিয়ে ছিলেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের এক কূটনীতিক অতি কৌশলে সংবাদটি ভারতকেও জানিয়ে দেন। এবার ভারতের পক্ষে আর বাধা রইলো না। যদিও নির্বোধ ইয়াহিয়া খান শেষতক এই বিশ্বাস নিয়ে বসেছিলেন যে ভারত যদি পূর্ব পাকিস্তানের উপর হামলা করে আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষ গ্রহণ করবে।
যাক, এসব অনেক পরের কথা। আমি জুলাই মাসে ফিরে যাচ্ছি। নিউইয়র্ক থেকে আমরা দু’দিনের জন্য ওয়াশিংটন চলে আসি। এখানে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদুত ছিলেন আগা হেলালী, আগা শাহীর বড় ভাই। তিনি অনেক দিন পূর্ব পাকিস্তানে চাকূরী করেছেন। এ দেশের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে পরিচিত ছিলেন। সংকটের কোন সমাধানের কথা তিনি বলতে পারলেন না। শুধু আশা প্রকাশ করলেন যে পূর্ব পাকিস্তানবাসী মুসলমান বুঝতে পারবে যে এই আত্মঘাতী গৃহযুদ্ধের দ্বারা তারা নিজেদের সর্বনাশ করবে।
বিদেশেও যে আমাদের মধ্যে কোনো সংযম বোধ ছিলো না তার একটি প্রমাণ নিউইয়র্কে পেয়েছিলাম। প্রেস কাউন্সিলারের যে লাঞ্চের কথা বলেছি সেখানে বিদেশীরা স্বভাবতই আমাদের নানা প্রশ্ন করছিলেন এবং আমরা যথাসম্ভব তার জবাব দেবার চেষ্টা করছিলাম। আমার ঠিক মনে নেই, একঢি প্রশ্নের জবাব ডক্টর কাজী দীন মোহাম্মদ দিতে উদ্যত হলে জাস্টিস নূরুল ইসলাম অত্যন্ত রূঢ়ভাবে তাঁকে থামিয়ে দেন। বলেন যে কথা তিনিই বলবেন। এই ঘটনায় আমি অত্যন্ত বিস্মিত ও ব্যথিত বোধ করি। বিদেশীদের সামনে এই অসৌজন্যমুলক আচরণের কোনো যৌক্তিকতা ছিলো না এবং থাকতে পারে না। হাইকোর্টের একজন জাস্টিস ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষকের সঙ্গে এ রকম ব্যবহার করবেন স্বচক্ষে এই ঘটনা না দেখলে আমার পক্ষে বিশ্বাস করাই কঠিন হতো। নতুন করে অনুভব করলাম যে আমাদের মধ্যে সংযমবোধ এবং সহিষ্ণুতা কোনোটাই নেই। যে সমস্ত কারণে গৃহযুদ্ধের এ বিস্ফোরণ ঘটে, এটা তারই একটি। সামান্য ঘটনাকে বাঙালী মুসলমান ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগে পরিণত করতো। কোন কিছুই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারতো না। ভাবখানা এই যে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের লোকজন নয় দুনিয়াশুদ্ধ লোকজন বাঙালীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আওয়ামী লীগের লোকেরা আগাগোড়াই আমাদের বুঝিয়েছে যে ষড়যন্ত্রের কারণেই আমরা আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আছি। সি এস এস পরীক্ষায় আমাদের ছেলেরা ভালো না করতে পারলেও বলা হতো এটা ষড়যন্ত্রের ফল। ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চল কতটা অনগ্রসর ছিলো সেকথা কয়েক মাসের মধ্যে আমরা ভুলে গিয়েছিলাম। ঢাকার সঙ্গে লাহোর-করাচীর তুলনা করে আক্ষেপ করেছি যে ঢাকার অনুন্নত অবস্থার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলা এবং গাফলতি দায়ী। এর প্রতিবাদ করতে গেলেই প্রতিবাদকারীকে করাচী বা ইসলামাবাদের দালাল বলা হতো।
আগা হেলালীর বাড়ীতে একদিন লাঞ্চে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। সেদিন বাইরের কোন লোক উপস্থিত ছিলো না। আমরা নিজেদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের সংকট নিয়ে আলোচনা করি এবং যদ্দুর মনে পড়ে আমরা সবাই এই মত প্রকাশ করি যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে জোরালো প্রচারণা হচ্ছে তার মোকাবেলা করতে সমর্থ না হলে কুটনীতির ক্ষেত্রে পাকিস্তান আরো অসহায় হয়ে পড়বে। এখানেও শুনলাম অমেরিকার কাগজপত্রে পাকিস্তানের কোন বিবৃতি ছাপা হয় না। ছাপা হয় শুধু শত্রুপক্ষীয় প্রচারণা। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ২৫শে মার্চ যে হত্যাকান্ড ঘটে তাকে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করা হয় যে পাকিস্তান আর্মি কয়েকশ’ বুদ্ধিজীবীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এর প্রতিবাদ পাকিস্তান অনেক বিলম্বে করে। কিন্তু ততদিনে আমেরিকার বুদ্ধিজীবী মহলে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, পাকিস্তান আর্মি এমন এক নির্মমতার অনুষ্ঠান করেছে যার তুলনা আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে নেই। ফলে আমেরিকার জনমত শুধু পাকিস্তান বিরোধীই হয়ে ওঠে না নিক্সন সরকারকে পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধ করতে বাধ্য করে। অর্থাৎ এটা পরিস্কার হয়ে উঠেছিলো যে রণক্ষেত্রের চেয়ে কূটনীতির ক্ষেত্রে পাকিস্তানের পরাজয় হচ্ছে বেশী।
বিবিসি
ওয়াশিংটনের পর আমরা আর কোথাও যাইনি। নিউইয়র্ক হয়ে সোজা লন্ডন চলে আসি। এখানে হাইকমিশনার সালমান আলীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় আমার এবং মোহর আলীর নামে টাইমস পত্রিকায় ৭ই জুলাই প্রকাশিত চিঠিটি দেখতে পেলাম। এ ঘটনার উল্লেখ আগেই করেছি। আমরা হাইকমিশনারকে জানিয়ে দিলাম যে আর কোনো এনগেজমেন্ট আমরা গ্রহণ করবো না। আমাদের অবিলম্বে ফেরা দরকার। এবার আমাদের রাখা হয়েছিলো অন্য এক হোটেলে। আমরা রিসেপশনকে বলে দিয়েছিলাম যে কোনো টেলিফোন কলেরও আমরা জবাব দেবো না। তবুও একদিন আমাদের দেশে রওনা হবার কয়েক ঘণ্টা আগে ফোন বেজে উঠলো। বিবিসির বাংলা সার্ভিসের এক হিন্দু কর্মকর্তা কথা বলছিলেন। আমাকে বললেন যে আমাদের বিবৃতি তিনি দেখেছেন এবং এ সম্বন্ধে আমার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করে কিছু প্রশ্ন করতে চান। আমি বললাম আমি কয়েক ঘন্টার মধ্যে দেশে রওয়ানা হচ্ছি, এখন ইন্টারভিউ দেয়ার সময় আমার হাতে নেই। কর্মকর্তাটি জিদ করে বললেন, আমার ফ্লাইট নম্বর জানিয়ে দিলে তিনি হিথ্রো বিমান বন্দরে আমার সঙ্গে আলাপ করবেন। কারণ তিনি বললেন আমি বাঙালী হয়ে গৃহযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ সমর্থন করছি কেনো সেটা তাঁর বুঝা দরকার। জবাবে আমি বলেছিলাম যে আমার বক্তব্য টাইমস-এ প্রকাশিত চিঠিটিতে তিনি পেতে পারেন। এর অধিক আমার বলার নেই। তাছাড়া ফ্লাইট নম্বর বলা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। আমাদের টিকেটগুলো ছিলো পাকিস্তান হাইকমিশন অফিসে।
খুব সম্ভব ১০ই জুলাই লন্ডন থেকে করাচী এসে পৌঁছুই। একবার মনে হয়েছিলো ইসলামাবাদে যেয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে আমাদের অভিজ্ঞতার কথা বলা প্রয়োজন। কিন্তু তাতে আরো তিন চার দিন সময় লাগতো। এদিকে ঢাকা থেকে যে সমস্ত উদ্বেগজনক খবর পাচ্ছিলাম তাতে মনে হলো আর কালক্ষেপণ না করে অবিলম্বে ঢাকায় ফেরত আসা উচিত।
ঢাকায় নিয়োগ
ঢাকায় এসে স্থির করেছিলাম যে কয়েকদিন বিশ্রামের পর রাজশাহীতে ফিরে যাবো। কিন্তু সে আর হলো না। কারণ এর মধ্যে সরকারের নির্দেশ পেলাম যে আমাকে ঢাকা ইউনিভার্সিটির ভাইস চান্সেলর নিযুক্ত করা হয়েছে। গভর্নরের আদেশ। তবুও আমি আপত্তি করে বললাম যে জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী যদি আনুষ্ঠানিকভাবে এ পদে ইস্তফা না দিয়ে থাকেন তবে আমার পক্ষে এ কার্যভার গ্রহণ করা অনুচিত হবে। সরকার আমাকে জানালেন যে ১৫ই মার্চ থেকে আবু সাঈদ চৌধুরী পদত্যাগ করেছেন। সুতরাং আইনত ভাইস চান্সেলরের পদটি শূণ্য। এই আশ্বাসের ভিত্তিতে আমি কার্যভার গ্রহণ করতে রাজী হই। পরে মিঃ চৌধুরীর পদত্যাগ পত্রের কপিও আমাকে দেখানো হয়। মজার কথা এই যে পাকিস্তানের পতনের পর মিঃ চৌধুরী আবার এসে এই পদ দখল করেন এবং তিনি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত না হওয়া পর্যন্ত ঐ পদে বহাল ছিলেন।
ইউনিভার্সিটিতে সে সময় ছাত্র নেই বললেই চলে। শিক্ষকরাও ক্লাস নিতে ভয় পেতেন। আর্টস বিল্ডিং-এ দু’একবার বোমা ফাটিয়ে ছাত্র-শিক্ষক সমাজকে আরো আতঙ্কিত করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সরকারী নির্দেশ ছিলো যে ক্লাস খোলা রাখতে হবে।
আমার নিজের ডিপার্টমেন্ট-এ কোনো প্রধান ছিলো না। ডক্টর খান সারওয়ার মোর্শেদ ইন্ডিয়া চলে গিয়েছিলেন। রিডার সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের ভার গ্রহণ করার অনুরোধ করলে সে অব্যাহতি চাইলো। তখন মিঃ আবদুল মোনেমকে সাময়িকভাবে ডিপার্টমেন্টের চার্জে বসানো হয়।
একদিন অধ্যাপকদের আমার অফিসে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, দেশে যে সংকট দেখা দিয়েছে সে সম্বন্ধে তাঁদের করণীয় বা বক্তব্য কিছু আছে কিনা। কারণ যে আত্মঘাতী সংগ্রামে আমরা লিপ্ত হয়েছিলাম তার পরিণাম যে অশুভ হবে সেটা সবাই জানেন। কিন্তু কেউ মুখ খুলে স্পষ্টভাবে কোন কথা বললেন না। আমি জানতাম যে এঁদের মধ্যে অনেকের সহানুভূতি অন্য দিকে কিন্তু তবুও মনে করেছিলাম যে দেশকে অবশ্যম্ভাবী ধ্বংস থেকে কিভাবে রক্ষা করা যায় সে সম্বন্ধে দু’একটা কথা বলবেন। অবশ্য তাঁদের ভয়ের কারণও ছিলো। কারণ যাঁরাই পুরাপুরি বিরোধীদের সমর্থন করেননি তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিদিন কোলকাতার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হতো। আমার বিরুদ্ধেও। একদিন এক চিঠি পেলাম। তাতে লেখা ছিলো যে মুক্তিযোদ্ধারা স্থির করেছে যে আমার অফিসেই আমাকে হত্যা করবে। এ পর্যন্ত আমি আমার নাজিমুদ্দিন রোডের বাসা থেকে অফিস করতাম। সরকার জানালেন আমাকে পাহারা দেয়ার জন্য তাঁরা এক দল সৈন্য পাঠাবেন। কিন্তু আমার ছোট বাসায় তাদের রাখবো কোথায়? বাধ্য হয়েই ভাইস চান্সেলরের সরকারী ভবনে যেতে হলো। আমার বেশ কিছু বইপত্র এবং তৈজসপত্র নিয়ে গেলাম।
টিক্কা খান
একদিন জেনারেল টিক্কা খান আমাকে ডেকে পাঠালেন, এই প্রথম জেনারেল টিক্কা খানের সাথে আমার পরিচয়। তাঁর সম্বন্ধে আগে অনেক আজগুবি কাহিনী শুনেছিলাম। এপ্রিল মাসেই আমার বড় মেয়ের শ্বশুর আমাকে বলেছিলেন যে টিক্কা খান খান নিজেকে সামরিক নির্মমতার জন্য প্রস্তুত রাখতে এতটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে তিনি জেনারেল আইয়ুব খানের অনুরোধেও বিয়ে করতে রাজী হননি। কারণ তিনি নাকি মনে করতেন যে সন্তান-সন্ততি হলে মানুষের মন কোমল হয়ে পড়ে।
এই প্রচারণা ছিলো সর্বৈব মিথ্যা। গভর্নমেন্ট হাউজেই টিক্কা খানের ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয়। শুনলাম তার কয়েকজন ভাই বোন আছে। তখন অবাক হয়ে ভাবলাম আমার মেয়ের শ্বশুর মিঃ আনসারী একজন উঁচু পদের পুলিশ অফিসার হয়েও কিভাবে বিশ্বাস করতে পেরেছিলেন যে টিক্কা খানের মধ্যে মানবতার কোন বৈশিষ্ট্য নেই। আমি টিক্কা খানের ২৫ শে মার্চ তারিখের সামরিক অভিযানের সমর্থনের কথা বলছি না, তার নিন্দা বহুবার করেছি, কিন্তু টিক্কা খানকে দানব হিসাবে চিত্রিত করে যে ভয়াবহ আতংক সৃষ্টি করা হয়েছিলো সেটা সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা প্রচারণার ফল।
টিক্কা খান আমাকে বললেন যে তিনি স্থির করেছেন যে ইউনিভার্সিটির যে সমস্ত শিক্ষক ইন্ডিয়া পালিয়ে গেছেন অথবা দেশে বসে বিদ্রোহীদের সমর্থন করছেন তিনি তাদের বরখাস্ত করবেন। এদের নামের লিস্ট যেনো আমি তৈরী করে দিই। আমি বললাম যে, যে অভিযোগের কথা তিনি বলেছেন তার সত্যতা প্রমাণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এ সমস্ত খবর তিনি গোয়েন্দা বিভাগ থেকে পেতে পারেন। তাছাড়া বর্তমান অবস্থায় কোন শিক্ষককে বরখাস্ত করলে তার প্রতিক্রিয়া অশুভ হবে বলে আমার বিশ্বাস। চান্সেলর হিসেবে অনেক কিছু করার ক্ষমতা গভর্নরের আছে। এর মধ্যে ভাইস চান্সেলর হিসাবে আমি জড়িত হতে চাই না। মনে হলো আমার কথার মর্ম তিনি কিছুটা উপলব্ধি করলেন।
এর কিছুদিন পর চান্সেলরের এক হুকুমনামা আমাদের হাতে এসে পৌছালো। তার মধ্যে দু’রকম হুকুম ছিলো। কয়েকজন শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয় এবং কয়েকজনকে তাঁদের কার্যকলাপ সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়। চাকুরীচ্যুত শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন, ইসলামী হিস্ট্রি এ্যান্ড কালচার ডিপার্টমন্টের প্রফেসর এ বি এম হবিবুল্লাহ এবং যাঁদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছিলো তাদের মধ্যে ছিলেন মুনীর চৌধুরী। সবগুলো নাম আমার মনে নেই বলে উল্লেখ করতে পারছি না। যদ্দুর মনে পড়ে মিসেস নীলিমা ইব্রাহিমকে হয় বরখাস্ত করা হয়েছিল কিংবা হুশিয়ার করে দেয়া হয়েছিলো।
আমি মহা সমস্যায় পড়লাম। চান্সেলরের এই আদেশ আমার নামে উল্লিখিত শিক্ষকদের পৌঁছে দিতে গেলে তাঁরা অবশ্যই মনে করবেন যে এই অর্ডারটি জারী করা হয়েছে আমার পরামর্শে। আমি প্রফেসর নাজমুল করিমকে ডেকে তাঁর পরামর্শ চাইলাম। তিনি বললেন এর মধ্যে আপনার করার কিছুই নেই। আপনি চান্সেলরের আদেশ অমান্য করতে পারেন না। অর্ডারের কপি শিক্ষকদের কাছে পৌছে দিন। তাই করা হয়।
আমার মনে আছে সাক্ষাৎকারের সময় আমি টিক্কা খানকে বিশেষ অনুরোধ করি তিনি যেনো সৈয়দ আলী আহসানের ছোট ভাই সৈয়দ আলী তকীকে ঢাকা জেল থেকে ছেড়ে দেন। এই ছেলেটি বাংলায় এম এ পাস করে ময়মনসিংহের এক কলেজে চাকরী নিয়েছিলো। কিভাবে যে পঁচিশে মার্চের গন্ডগোলের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিলো আমরা জানিনা। কিন্তু শুনেছিলাম যে আর্মি তাকে এমনভাবে মারধর করে যে তার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে। ঐ অবস্থায় তাঁকে ঢাকা জেলে আটক রাখা হয়। ছেলেটিকে আশৈশব চিনতাম বলে আমি জোর করে বলতে পেরেছিলাম যে তার মতো নিরীহ নিরুপদ্রব ব্যক্তির পক্ষে রাষ্ট্র বিরোধী কর্মে লিপ্ত হওয়া অসম্ভব বলে আমার মনে হয়। গভর্নর তাঁর নোট বই-এ তার নাম টুকে রাখলেন এবং বললেন যে এ সম্বন্ধে তিনি অনুসন্ধান করে দেখবেন। শেষ পর্যন্ত ১৬ই ডিসেম্বরের আগে আলী তকী রেহাই পায়নি। ১৬ই ডিসেম্বরের পর যখন বাংলাদেশের সব জেলের দরোজা খুলে দেয়া হয় তখন সবার সাথে সেও বেরিয়ে পড়ে।
কারদার
একদিন খবর পেলাম পাকিস্তানের বিখ্যাত ক্রিকেটার আব্দুল হাফিজ কারদার ঢাকায় এসেছেন। তিনি তখন কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন। কারদারের সঙ্গে আমার পরিচয় বহুদিনের। তিনি এক সময় পূর্ব পাবিস্তানে পাটের ব্যবসা করতেন। তখন তাঁর বাসায় দাওয়াতও খেয়েছি। এর আগে বা পরে ১৯৬২ সালে নয়াদিল্লীতে পক্ষকাল ব্যাপী যে ‘কমনওয়েলথ শিক্ষা সম্মেলন’ হয়েছিলো সেখানেও কারদারকে দেখেছি। তিনি খবর পাঠালেন যে আমার সঙ্গে কোন এক জরুরী ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করা দরকার। তাঁকে ইউনিভার্সিটি এলাকায় আসতে বলা বিপজ্জনক হতে পারে মনে করে আমি নিজেই ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে গেলাম। কারদার পকেট থেকে একখানা কাগজ বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন এ সস্পর্কে আপনার পরামর্শ চাই। পড়ে দেখি এটি ডক্টর আহমদ শরীফের একটি আবেদনপত্র। দেশদ্রোহিতার অভিযোগে আর্মি তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল এই ভয়ে তিনি আত্মগোপন করে ছিলেন। আবেদনপত্রে জানিয়েছিলেন যে, তিনি তো দেশদ্রোহী নন বরঞ্চ ইসলাম সম্পর্কে সারা জীবন তিনি গবেষণা করেছেন এবং অনেকগুলো প্রকাশিত প্রবন্ধ বা রচনার নামও আবেদন পত্রে ছিলো। কারদার জানতে চাইলেন ডক্টর আহমদ শরীফ সত্যি সত্যি ইসলাম ভক্ত কিনা। এর জবাব দিতে যেয়ে মুশকিলে পড়লাম। আহমদ শরীফ পুঁথি নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং তাঁর রচিত পুঁথি ক্যাটালগ-এর ইংরেজী তরজমা আমিই করেছিলাম। সেখানে স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছিলাম যে পুঁথি সম্বন্ধে ডক্টর আহমদ শরীফের চাইতে বেশী জ্ঞান আর কেউ রাখেন না বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু এর সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক কি? ইসলাম সম্পর্কে তাঁর বিশেষ কোনো আগ্রহ ছিলো বলে আমার জানা ছিলো না। অবশ্য বাংলাদেশ পরবর্তী কালে ইসলাম সম্পর্কে যে সমস্ত উক্তি তিনি করেছেন বলে শুনেছি সে রকম কোনো কথা পাকিস্তান আমলে তিনি বলতেন না। কিন্তু দেশের এ সংকট মুহুর্তে তাঁর ধমীঁয় মতামত নিয়ে কোনো বিরূপ মন্তব্য সরকারী কর্মচারীকে জানাতে গেলে তাঁর সমুহ বিপদ ঘটবে এই মনে করে আমি কারদারকে বলেছিলাম যে ইসলাম সম্পর্কে কে কখন কি বলেছে তা যাচাই করে যদি সেটিকে দেশপ্রেমের মাপকাঠি করা হয় তা হলে বহু লোকই বিপদে পড়বে। এ রকমের বাড়াবাড়ি করা মোটেই উচিত হবে না। শুনেছি পরে তাঁকে আর খোজাখুজি করা হয়নি।
কারদার প্রস্তাব করেন যে তিনি শিক্ষকদের এক সভায় বক্তৃতা করবেন। আমি তাঁকে নিরস্ত করলাম এই বলে যে, প্রথমত অনেক শিক্ষক এ রকম সভায় হাজির হবেন না। দ্বিতীয়তঃ তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী বলে তাঁর কথার কদর্থ করা হতে পারে। তাতে অবস্থার আরো অবনতি ঘটবে। আর একটা কথা মনে আছে আমার। কারদার এক পর্যায়ে আমাকে বললেন যে পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান সংকটের মূল কারণ এই যে, স্কুল-কলেজে শিক্ষকদের আশি-নব্বই ভাগই হিন্দু। পাকিস্তান বিরোধী প্রচারণা করে মুসলিম তরুণদের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। আমি জবাবে বলেছিলাম যে তার এই হিসাব মোটেই ঠিক নয়। ‘৪৭ সালের আগে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকের প্রাধান্য ছিলে, এ কথা সত্য। কিন্তু এই শ্রেণীর হিন্দুরা অনেকে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে পশ্চিম বাংলা বা আসামে চলে যায় এবং এ শূন্যতা পূরণ হয় মুসলমান শিক্ষক দিয়ে। ঠিক তেমনি ১৯৪৭-৪৮ পর্যন্ত ঢাকা ইউনিভার্সিটির অধিকাংশ শিক্ষক ছিলেন হিন্দু। আমি যখন ১৯৩৮ সালে ফার্স্ট ইয়ারে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হই তখন আর্টস বা কলা-ফ্যাকালটিতে আরবী এবং উর্দু-ফার্সি ডিপার্টমেন্টকে বাদ দিলে মুসলমান শিক্ষক ছিলেন মাত্র ৩ জন। ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে ডক্টর মাহমুদ হাসান, বাংলার ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং ইতিহাসের ডক্টর মাহমুদ হোসেন। আমার যদ্দুর মনে পড়ে এই বছরই মাজহারুল হক জুনিয়র লেকচারার হিসাবে ইকনমিকস ডিপার্টমেন্টে যোগ দেন। এবং অনুরূপ পদ নিয়ে আব্দুর রাজ্জাক (বর্তমানে জাতীয় অধ্যাপক) পলিটিক্যাল সায়েন্স ডিপার্টমেন্টে নিযুক্ত হন। সায়েন্স বিভাগগুলোতে একমাত্র মুসলমান শিক্ষক ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কিছু কিছু হিন্দু শিক্ষক ঢাকা ছেড়ে চলে যান। আর ১৯৫০ সালে যখন কোলকাতা এবং ঢাকায় নতুন করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেঁধে যায় তখন রাতারাতি প্রায় সব হিন্দু শিক্ষক কোলকাতা চলে যান। ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমি যখন শিক্ষক হিসাবে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে যোগ দিয়েছি তখনও আমার নিজের পুরোনো শিক্ষকবৃন্দের মধ্যে মিস চারুপমা বোস ডিপার্টমেন্টে ছিলেন। আরো দুই জন নতুন হিন্দু শিক্ষক আমি ছাত্র হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করার পর এই ডিপার্টমেন্টে যোগ দিয়েছিলেন। এরা হচ্ছেন ডক্টর এস এন রায় (আমার শিক্ষক পুরনো এস এন রায় নন) এবং অমিয় চক্রবর্তী। এরা সবাই ‘৫০সালের দাঙ্গার পর পদত্যাগ করে চলে যান। তখন ডিপার্টমেন্টের হেড ছিলেন মিস এ জি স্টক। একদিন তার মুখে শুনলাম যে মিস চারুপমা বোস তার অসুস্থ পিতাকে দেখতে কোলকাতায় যাচ্ছেন। আমি বলেছিলাম তিনি হয়তো আর ফিরবেন না। মিস স্টক তো বিশ্বাসই করলেন না। কিন্তু সত্যই মিস বোস আর ফিরলেন না। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ পত্র পাঠিয়েছিলেন কিনা তা আমার জানা নেই। এ অবস্থায় ইউনিভার্সিটি চালু রাখা বেশ মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং এই যে শূন্যতা সৃষ্টি হলো এটা পূরণ করতে বেশ কয়েক বছর সময় লাগে। ১৯৪৯ সাল থেকেই কিছু কিছু করে নতুন মুসলমান শিক্ষককে বিলাতে পাঠানো হয়। আবদুর রাজ্জাক সাহেব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার সাথে সাথে ১৯৪৫ সালে কার্গো জাহাজে লন্ডন যান। ১৯৪৯ সালে আর্টস এবং ‘ল’ ফ্যাকালটি থেকে যে চারজন শিক্ষক বিলাত যাত্রা করেন তারা হচ্ছেন ‘ল’ ডিপাটর্মেন্টের শফিউল্লাহ এবং ইংরেজী ডিপার্টমেন্টের সৈয়দ আলী আশরাফ। আমি এবং বাংলার আবদুল হাই বিলাত যাই ১৯৫০ সালে। তখন বিভিন্ন বিভাগ থেকে আরো অনেক শিক্ষককে বিলাত পাঠানো হয়েছিলো। ‘৫১-৫২ সালে এসব শিক্ষক উচ্চ ডিগ্রী নিয়ে ফিরে আসতে শুরু করলে অবস্থার একটা আমূল পরিবর্তন ঘটে।
মোদ্দা কথা, শিক্ষায়তনে হিন্দু প্রাধান্যের কারণে ১৯৭১ সালে বিস্ফোরণ ঘটেছিলো বলে কারদার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মনে যে ধারণা ছিল সেটা সত্য নয়। পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পর্কে এঁরা যে বিশেষ খবর রাখতেন না এই ধারণা তার অন্যতম প্রমাণ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচারণা হয়েছিলো এবং হচ্ছিল সে কথা মোটেই অসত্য নয়। শিক্ষা ব্যবস্থা এ জন্য অনেকখানি দায়ী। পাকিস্তানের ইতিহাস এবং পটভূমিকা আমরা তরুণদের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারিনি এবং অনেকটা মনে করতাম এ রকম ব্যাখ্যার আর বিশেষ প্রয়োজন ছিলো না। এটা যে কত বড় ভুল সে কথা ৬৯-৭০ সালে ভালো করে টের পাই। সে সময় বিলম্বে হলেও পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাস সম্বলিত একটি পাঠ্য পুস্তক চালু করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তখন পাকিস্তান বিরোধীরা ছাত্র সমাজকে এমনভাবে ক্ষেপিয়ে তুলছে যে পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি নামক এই বইটির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী এক বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এ ছিলো এক আশ্চর্য ঘটনা। দেশের ইতিহাস জানতে চাইবো না এরকম উদ্দেশ্য নিয়ে পুথিবীর আর কোথাও এ ধরনের আন্দোলন হয়েছে বলে আমার জানা নেই। শেষ পর্যন্ত প্রবল চাপের মুখে ইয়াহিয়া সরকার বইটি প্রত্যাহার করে নেন। আমি কারদারকে বলি যে হিন্দু শিক্ষকদের প্রাধান্যের কারণে নয় আমাদের নিজেদের গাফলতির কারণে বর্তমান সংকটের উদ্ভব হয়েছে। যে তরুণেরা পাকিস্তান ধ্বংস করার উন্মত্তায় মেতে উঠেছিলো তাদের জানাই ছিলো না কেনো আমরা বর্ণ হিন্দু কবলিত ভারত থেকে বচ্ছিন্ন হতে চেয়েছি।
জুলাই মাস থেকে পূর্ব বঙ্গে বর্ষাকাল শুরু হয় এবং প্রায় সারা অঞ্চলই বন্যায় প্লাবিত হয়ে যায়। একাত্তর সালেও এ রকম ঘটেছিলো। তখন বিদেশী পত্র-পত্রিকায় প্রায়ই মন্তব্য করা হতো যে পাকিস্তান আর্মি জেনারেল রেইনের কাছে অথবা জেনারেল বর্ষার কাছে হার মানতে বাধ্য হবে। পাঞ্জাবী সৈন্যরা সাঁতার জানে না। তার উপর আর্মির হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ নৌযান ছিলো না যা দিয়ে সহজে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সৈন্য সরানো যায় কিন্তু কার্যতঃ এ আশংকা সম্পূর্ণ অমূলক প্রমাণিত হয়। অবশ্য দু’একটি ঘটনায় গেরিলারা সৈন্যবাহী নৌযান ডুবিয়ে দিতে পারলেও সামরিকভারে যুদ্ধ পরিচালনায় তারা কোন সংকট সৃষ্টি করতে পারেনি। শুনতাম যে এর ফলে বিদ্রোহী নেতাদের মধ্যে হতাশার সঞ্চার হয়েছিলো।
গেরিলা আক্রমণে চট্টগ্রাম এবং মংলা বন্দরের কর্মকান্ড কিছুটা ব্যহত হয়েছিল। খাদ্যবাহী জাহাজ দু’একটি ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিলো। উদ্দেশ্য ছিলো এভাবে দেশে খাদ্য সংকট সৃষ্টি করা দূর্ভিক্ষ দেখা দিলে অবশ্যম্ভাবী রূপে গণ অসন্তোষ বৃদ্ধি পেতো। কিন্তু যুদ্ধের নয় মাস কোনো এলাকায়ই খাদ্যের ঘটতি হয়নি।
নয় মাস যুদ্ধের সময় কয়েকবার আমার পুরোনো ছাত্র যারা বিদেশী দূতাবাসে কাজ করতো তারা চিঠি লিখে জানতে চাইতো দেশের অবস্থার কথা। এ রকম দুটো চিঠির কথা আমার বেশ মনে আছে। একটা আসে কায়রো থেকে এবং অন্যটি বৈরুত থেকে। এ সব চিঠির জবাব খুব সতর্কতার সঙ্গে দিতে হয়েছে। কারণ বাঙালী কূটনীতিক প্রায় প্রতিমাসেই শেখ মুজিবের আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে বিভিন্ন বিদেশী দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছে। এদের মধ্যে কে পাকিস্তানের সমর্থক এবং কে সমর্থক নয় তা ঠাহর করা দুষ্কর ছিল। খোলা মন নিয়ে এদের কিছু বললে সে চিঠির অপব্যবহারের আশংকা ছিলো। তাই এসব চিঠিতে খুব সংযত ভাষা ব্যবহার করতে চেষ্টা করতাম। আমার আশংকা যে অমূলক ছিলো না তার প্রমাণ একাত্তরের শেষ দিকে পেয়েছিলাম। যে দু’জন কূটনীতিকের উল্লেখ করলাম তারা পাকিস্তানের প্রতি আনূগত্য প্রত্যাহার করে নেয় এবং এখনো সরকারী চাকুরীতে বহাল রয়েছে।
আর্মির বহু বাঙালী অফিসার এবং জওয়ান যারা পূর্ব পাকিস্তানে কার্যরত ছিলো তারাও বিদ্রোহ করে গেরিলা বাহিনীতে যোগ দেয়। এরা কিন্তু সবাই পবিত্র কোরআন শরীফের উপর হাত রেখে পাকিস্তানের প্রতি অনূগত থাকবে বলে হলফ নিয়েছিলো। যে সমস্ত বাঙালী অফিসার পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলেন তারা ক্রমান্বয়ে সরকারের আস্থা হারিয়ে ফেলেন এবং তাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিলো। এদের মধ্যে আমার বড় জামাতা মেজর ওয়ালী আহমদও ছিলো। এসব অফিসারের মধ্যে সবাই যে পাকিস্তানের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে তা নয় কিন্তু তাদের সহকমীঁদের আচরণের কারণে সবাইকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এই শ্রেণীর অফিসারের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছিলেন পাকিস্তানের বিমান বাহিনীর এস আলম। ১৯৬৫ সালের পাকভারত যুদ্ধে তিনি বহু ইন্ডিয়ান বিমান ধ্বংস করে কৃতিত্ব লাভ করেন এবং একাত্তর সালে পাকিস্তানের প্রতি তাঁর আনুগত্যে কোনো ফাটল ধরা পড়েনি। শুনেছি যে একাত্তরের পর তিনি পাকিস্তানে থেকে যান।
আরেকজন এ রকম উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি কবির চৌধুরীর ভাই আর্মি অফিসার কাইয়ুম চৌধুরী পাকিস্তানের প্রতি তার আনুগত্যে পরিবর্তন করেননি। আমার যদ্দুর জানা আছে তিনি এখনো পাকিস্তানে বাস করছেন। বেসামরিক দপ্তরে যে সমস্ত বাঙালী কর্মচারী কর্মরত ছিলেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ আফগানিস্তান হয়ে পালিয়ে আসে, সে কথা আগে উল্লেখ করেছি। কিন্তু আবার বহু অফিসার শেষ পর্যন্ত আনুগত্যের সঙ্গে পাবিস্তানে কর্যরত ছিলেন। এদের মধ্যে একজন হচ্ছেন আমার শিক্ষা জীবনের বন্ধু মুহম্মদ হোসেন। আমরা একই বছর ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে এম এ পাস করি। একাত্তর সালে মুহম্মদ হোসেন খুব সম্ভবত সরকারের পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্টে কাজ করতো। জুলাই মাসে যখন সেন্ট্রাল পাবলিক সার্ভিস কমিশনে একটি পদ খালি হয় সে আমাকে জানিয়ে ছিলো যে দরখাস্ত করলে অতি সহজেই আমি এই চাকুরীটি পেতে পারি; কিন্তু যুদ্ধের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার খোঁজে অন্য কোথায়ও যাওয়ার ইচ্ছা আমার ছিলো না। আমি বললাম যে এখানে থেকেই আমার কর্তব্য পালন করা প্রয়োজন। যদি অদৃষ্টে মৃত্যূ থাকে সেটা যেনো মাটিতেই হয়।
আগস্ট মাসে নির্দেশ এলো আমরা যেনো স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করি। পাকিস্তান আমলে প্রতিবছরই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ১৪ই আগস্ট উদযাপিত হতো। তবে এবার এ উদযাপনের বিশেষ তাৎপর্য ছিলো। টিএসসি মিলনায়তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ছাত্রদের সভা হয়। দু’-এক জন শিক্ষক বক্তৃতা করলেন। সভাপতির অভিভাষণে আমি বললাম যে স্বাধীনতা রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য এবং আমি আশা করি দলমত নির্বিশেষে সকলেই দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষা করতে সচেষ্ট হবেন। আমি জানতাম আমার প্রতিটি বাক্যের বিকৃত ব্যাখ্যা করা হতে পারে সে জন্যে ইচ্ছা করেই দেশের গৃহযুদ্ধের উল্লেখ করিনি। শুধু সাধারণভাবে স্বাধীনতা রক্ষার কথা বলেছিলাম। আশ্চর্যের কথা ১৯৭২-৭৩ সালে যখন আমরা কলাবরেটর আইনে আটকা পড়ি, আমার কার্যাবলী সম্পর্কে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের জনৈক শিক্ষক পুরিশের কাছে অভিযোগ করে যে, সে স্পষ্টভাবে শুনেছে যে আমি সবাইকে আর্মির সঙ্গে সহযোগিতা করতে বলেছি। সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের এক হিন্দু শিক্ষক যিনি ঐ সভায় উপস্থিত ছিলেন না, তিনিও এই অভিযোগ সমর্থন করেন। ১৯৭১ সালের ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই ছিলো না। তবুও মনঃক্ষুন্ন হয়েছিলাম এই ভেবে যে ইউনিভার্সিটির শিক্ষকরা কিভাবে এ রকমের মিথ্যা কথা বলতে পারলেন। আমি পাকিস্তান আদর্শবাদে বিশ্বাস করতাম এটা কোনো গোপন কথা নয়। ছাত্র জীবন থেকেই পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলাম। ‘৪০ সাল থেকে ঢাকা এবং কোলকাতার বহু পত্রিকায় এই সম্বন্ধে বহু প্রবন্ধ লিখেছি এবং এই সূত্রে যে তরুণ সমাজ পাকিস্তান আন্দোলনকে সাফল্যমন্ডিত করে তুলেছিলো, আমি নিজেকে তাদেরই অন্যতম মনে করতাম। আমারই চোখের সামনে আমাদের সেই বাস্তবায়িত স্বপ্ন ধূলিস্যাত হয়ে যাবে এটা আমরা কামনা করতে পারি সে তো ছিলো অসম্ভব। কিন্তু ‘৭১ সালে ১৪ই আগস্টের অনুষ্ঠানে আমি পরিষ্কারভাবে আর্মির পক্ষে ওকালতি করেছিলাম এই অভিযোগ ছিলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এ রকম আরো অভিযোগ আমাকে শুনতে হয়েছে যার মূলে লেশমাত্র সত্য নেই।
গভর্নর মালেক
সেপ্টেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে তাদের নীতি পরিবর্তন করেন। টিক্কাখান-এর বদলে নিয়াজী ইষ্ট পাকিস্তান বাহিনীর সর্বাধিনায়ক পদে অধিষ্ঠিত হন। ডঃ মালেককে গভর্নর নিয়োগ করা হয়। টিক্কা খানের নিয়োগ নিয়ে ইষ্ট পাকিস্তানের চিফ জাস্টিস বি, এ, সিদ্দিকী মার্চ মাসে যে সমস্যার সৃষ্টি করেন, ডক্টর মালেককে নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি। অনেকেরই হয়তো মনে আছে যে জনাব সিদ্দিকী এই বলে আপত্তি করেন যে কসাই বলে পরিচিত এই ব্যক্তিটির শপথ তিনি গ্রহণ করতে পারবেন না। দেশে নিয়ম-শৃংখলা কতটা ভেঙ্গে পড়েছিলো, এই ঘটনা ছিলো তারই একটি নমুনা। ডক্টর মালেককে আগে থেকে চিনতাম। তিনি একদিন ফোন করে বললেন যে, তিনি ইউনিভার্সিটির শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে চান। এ রকম একটি সভা আয়োজন করা সম্ভব হবে কি? আমি বললাম যে, আনুষ্ঠানিক সভায় তিনি মত বিনিময় করতে পারবেন না। কারণ পরিবেশ তার অনুকূলে নয়। বরঞ্চ তিনি রাজী হলে আমার বাসায় চা চক্রে কয়েকজন শিক্ষককে আমি আমন্ত্রণ করতে পারি। গভর্নর মালেক আমার এই প্রস্তাবে স্বীকৃত হলেন।
এই চা চক্রের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের অধ্যক্ষ এবং হলগুলির প্রভোস্টদের ডেকেছিলাম। কয়েকজন এডমিনিসট্রেটিভ অফিসারও উপস্থিত ছিলেন। ডক্টর মালেক সবাইকে বললেন আপনারা মন খুলে আমার সাথে কথা বলতে পারেন। যদ্দুর মনে পড়ে প্রথম মুখ খুললেন মিসেস আখতার ইমাম। তিনি ছিলেন মেয়েদের হলের প্রভোস্ট এবং দর্শন বিভাগের শিক্ষয়িত্রী। তিনি নিরাপত্তার কথা তুলেছিলেন এবং বলেছিলেন যে আর্মি যেভাবে লোকজনকে গ্রেফতার করছে তাতে লোকের মনে এক আতংকের সৃষ্টি হয়েছে। ডক্টর মালেক বললেন যে, তাঁকে নিয়োগ করার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে যে এ অঞ্চলের লোকজনকে এ আশ্বাস দেয়া যে, পূর্ব পাকিস্তানের শাসনের দায়িত্ব এ অঞ্চলের লোকের উপর ন্যস্ত। তারপর তিনি যে কথা বললেন সেটা ছিলো খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বিদ্রোহীরা যেভাবে ধ্বংসাত্মক কার্য চালিয়ে যাচ্ছিল তার উল্লেখ করে তিনি প্রশ্ন তুললেন যে, এরা যদি সত্যিই দেশ প্রেমিক হয়ে থাকে তাহলে দেশকে এভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে কেনো? যদি বিদ্রোহী বাহিনী জয়লাভ করে, দেশের শাসনভার তাদেরই নিতে হবে। দেশটার সর্বনাশ করে তারা কোন ধরণের স্বাধীনতা অর্জন করবে? গত বিশ বাইশ বছরে এই অনুন্নত অঞ্চলে রাস্তাঘাট-পুল, মিল, ফ্যাক্টরী, ইলেকট্রিসিটি, পাওয়ার হাউজ যা নির্মিত হয়েছে সব কিছুর উপরই হামলা চলেছে, ব্যাংক লুট হচ্ছে। ভাবখানা এই যে এ সমস্ত কিছু ভেঙ্গে চুরমার করে দিলে আর্মি পরাজিত হবে। কিন্তু আর্মি পরাজিত হলেও দেশ তো আমাদেরই থাকবে। এগুলো আবার নতুন করে গড়বো কিভাবে?
ডক্টর মালেকের উক্তির যথার্থতা কেউ অস্বীকার করতে পারলেন না, কিন্তু এর জবাবও কেউ দিভে পারলেন না। আগেও দেখেছি এবং ডক্টর মালেকের উক্তি শুনে এই বিশ্বাসই জন্মায় যে পূর্ব পাকিস্তানে যে সংকট পতিত হয়েছে সেটা কোন সাধারণ গৃহযুদ্ধ নয়, কোনো অদৃশ্য অশুভ শক্তি এর পেছনে সক্রিয়। যেনো তেনো প্রকারে এ অঞ্চলে এমন অবস্থার সৃষ্টি করা হয় যাতে অদূর ভবিষ্যতে এরা মাথা তুলবার শক্তি না পায়।
একদিন ভোর রাত্রির দিকে মিসেস আখতার ইমাম ফোন করে জানালেন যে মেয়েদের হলে ডাকাতি হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে খবর দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। ভোরের দিকে যখন পুলিশ অফিসাররা আসেন আমিও তাঁদের সাথে হলে গেলাম। মিসেস ইমামের বাসা থেকে রেডিও এবং অলংকারাদি খোয়া গিয়েছিলো। মেয়েদের টাকা-পয়সা ও জিনিসপত্র হারিয়েছিলো। তারাও তাদের অভিযোগের কথা বর্ণনা করলো। মিসেস ইমাম বললেন যে, যে দল ডাকাতি করতে এসেছিলো তারা নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু তারা ছিলো আসলে অশিক্ষিত ও ঢাকাইয়া গুন্ডা। তারা নাকি ঢাকাইয়া বাংলায় মিসেস ইমামদের বলে, আমরা দেশের লাইগা লড়াই করতাছি। দ্যান, আপনাগো যা আছে আমাগো দ্যান। পুলিশ তদন্ত করে ডাকাতদের কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি এবং আমি যদ্দুর শুনেছি ডাকাতরা যে সমস্ত জিনিস লুট করে তার কোনো কিছুই উদ্ধার হয়নি।
তখন অনবরত এ রকম ঘটনা ঘটতো। দেশের চোর-ডাকাত, বদমাশ মুক্তিযুদ্ধের নাম করে শহরে গ্রামে গঞ্জে প্রায়ই ডাকাতি করতো এবং বলে বেড়াতো যে দেশ উদ্ধারের কাজে তারা নেমেছে। এ রকমের ঘটনা শুধু প্রাইভেট বাড়ীঘরে নয়, সরকারী অফিস আদালতে ব্যাংকে ট্রেজারীতে প্রায়ই হতো। একদিন দিনে দুপুরে টিএসসিতে অবস্থিত ব্যাংক থেকে কয়েক হাজার টাকা এভাবে লুট হয়ে যায়। দু’তিন জন ছোকরা নাকি মটর গাড়ী করে এসে পিস্তল দেখিয়ে এই ডাকাতি করে। টিএসসি’র ডিরেক্টর বেবি জামান আমাকে বললেন, স্যার এ ব্যাপারে আমরা কিছুই করতে পারবো না। পুলিশকে খবর দিয়ে রাখা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
আমি আগেই বলেছি যে ইউনিভার্সিটিতে ছাত্র বিশেষ ছিলো না। তবে কিছু কিছু ছাত্র-ছাত্রী হলে ফিরে এসেছিলো এবং এরা ক্লাস করতে যেতো। যদিও প্রায় দিনই শুনতাম শিক্ষকের অনুপস্থিতি। কিন্তু কোনো কোনো শিক্ষক এর মধ্যে ক্লাস করেছেন। আর একটা ঘটনা মনে পড়ছে। জিন্নাহ বা মহসিন হল থেকে একদল ছাত্র আমার সাথে দেখা করে। তাদের দাবী আমি যেন সরকার থেকে কিছু অস্ত্রশস্ত্র আনিয়ে তাদের দেওয়ার ব্যবস্থা করি। এ দিয়ে তারা বিদ্রোহীদের মোকাবেলা করবে এবং যে সমস্ত ছাত্র আওয়ামী লীগ দলভুক্ত ছিলো তাদের শায়েস্তা করবে। আমি তাদের বলেছিলাম যে, ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে গুন্ডামীর অভিযোগ আমরা শুনেছি কিন্তু তার প্রত্যূত্তর গুন্ডামী দিয়ে করার ব্যবস্থা আমি করতে পারবো না। শিক্ষাঙ্গনে গুন্ডামী যদি অন্যায় হয়, তোমরা যদি সন্ত্রাসবাদের সমর্থন না করো তাহলে অন্য একটি দলকে মারপিট করে অন্য প্রকারে গুন্ডামীর কথা বলছো কিভাবে?
এতে ঐ ছাত্রদল আমার উপর খুব অসন্তুষ্ট হয়। পরের সপ্তাহে ঢাকা থেকে আজিজ আহমদ বিলিইয়ামিনী ইয়াং পাকিস্তান নামে যে ইংরেজী সাপ্তাহিক প্রকাশ করতেন তাতে বড় অক্ষরে এই অভিযোগ প্রকাশ করা হয় যে ভাইস চান্সেলর দেশ প্রেমিকদের সাহায্য করতে অস্বীকার করছেন। ঘটনাটি আমার কাছে তখনো খুব তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে এবং এখনো হয়। আমরা নৈর্ব্যক্তিকভাবে ন্যায়-অন্যায়ের বিচার করতে অসমর্থ। যে কাজটি অপরে করলে চিৎকার করে প্রতিবাদ করি আমার দলের কোনো ব্যক্তি সেরকম ঘটনায় জড়িত হলে তার প্রশংসা করতে কুণ্ঠিত হই না। এদেশে বাক স্বাধীনতার অর্থ শুধু নিজের বা নিজের দলের স্বাধীনতা। বিপরীত কোনো মতবাদ কেউ প্রকাশ করলে তাকে কালপাত্র নির্বিশেষে দেশের শক্র বলতে আমাদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয় না।
১৯৭১ সালে অনেক লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে যাকে কোলকাতা স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে দেশ প্রেমের অত্যুৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরা হতো। শুনেছি এক পরিবারের বাপ ছিলেন পাকিস্তান সমর্থক আর ছেলে যোগ দিয়েছিলো বিদ্রোহী বাহিনীতে। একরাত্রে এসে সে বর্শা দিয়ে বাপকে হত্যা করে। এবং পরদিন তারই প্রশংসা কোলকাতা থেকে প্রচারিত হয়। আর একটি ঘটনার কথা শুনেছি, সেটা ঐ রকমই লোমহর্ষক। ফরিদপুরের এক ব্যক্তি এক বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিলো। তার শ্বশুর ছিলেন মুসলিম লীগের লোক। দেশে সে স্ত্রী এবং ছোট একটি মেয়েকে রেখে গিয়েছিলো। একদিন সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে শ্বশুর বাড়ীতে চড়াও হয়। নিজ হাতে প্রথমে শ্বশুরকে হত্যা করে। পরে অনুরূপভাবে স্ত্রী ও কন্যাকেও খতম করে। এসব জঞ্জাল (?) থাকলে দেশ উদ্ধারের কাজে বাধার সৃষ্টি হবে এজন্য সে পথের কন্টক দূর করে দিয়েছিলো। তার বাবা-মা র্বেঁচেছিলেন কিনা জানি না, তবে আরো শুনেছি ঘরে এক বোন ছিলো তাকে টেনে নিয়ে তার সহকর্মী একহিন্দুর হাতে স্ত্রী হিসেবে সঁপে দেয়। সে যে সত্যিকার অর্থে বাঙালী এবং কোনো রকমের সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ মানে না দুনিয়ার সামনে সে কথা প্রমাণ করার প্রকৃষ্ট উপায় হিসাবে এই পন্থা অবলম্বন করে। এই হত্যাকারীকে পরে রাষ্ট্রীয় উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
এই রকম ঘটনা আরো বহু হয়েছে। তার আর একটি উল্লেখ করছি। একরাত্রে একব্যক্তি এসে তার ভাইকে খুন করে। কারণ ভাই ছিল পাকিস্তানের সমর্থক। কিন্তু হত্যাকান্ড ঘটিয়ে পর মুহুর্তে সে এর লোমহর্ষকতা উপলব্ধি করে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায়।
এই যে শাশ্বত মুল্যবোধের প্রতি অবজ্ঞা, পিতামাতা, ভাইবোন, স্ত্রী-পুত্র এদের কারো প্রতি কোন রকম মমতা বা আনুগত্য রাখা চলবে না- এ শিক্ষাই আওয়ামী লীঁগ থেকে প্রচার করা হচ্ছিলো। এ প্রসঙ্গে প্রাচীন গ্রীক নাট্যকার সফোক্লিজ-এর এক নাটকের কথা মনে পড়ে। থীবস নগরে রাজা ক্লেয়ন-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ছিলেন এটিওক্লিস নামে এক ব্যক্তি। তিনি দাবী করছিলেন যে থীবস-এর সিংহাসন তাঁরই প্রাপ্য। কিন্তু তার ভাই পলিনাইসিস এ দাবী সমর্থন করেননি। তিনি ছিলেন ক্লেয়ন-এর পক্ষে। দুই ভাইয়ের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয় এবং দুই জনই মারা পড়েন। ক্লেয়ন ঘোষণা করেন যে পলিনাইসিসকে সসম্মানে সমাহিত করা হবে এবং এটিওক্লিস-এর শব কাক-শকূনকে বিলিয়ে দেওয়া হবে। রাজার এ ঘোষণার পর কেউ এর বিরুদ্ধাচরণ করতে সাহস পেলো না। বিরুদ্ধাচরণ করলো ক্লেয়নের পুত্রের বাগদত্তা এন্টিগনি। সে ছিলো এটিওক্লিসের বোন। সে স্থির করলো যে রাজার আদেশ অমান্য করলে মৃত্যূদন্ড হবে সত্য কিন্তু ভাইয়ের প্রতি তার এমন একটি কর্তব্য রয়েছে যেখানে সে কোনো রাষ্ট্রের আদেশ মানতে বাধ্য নয়। মৃত ভ্রাতাকে সমাহিত করা তার কর্তব্য। কারণ এটা একটা চিরন্তন নীতি, যার বিরুদ্ধাচারণ করার ক্ষমতা কোনো রাষ্ট্রের থাকা উচিত নয়। মৃত্যু ভয় না করে এন্টিগনি এটিওক্লিসকে সমাহিত করে এবং পরে তার নিজের মৃত্যূদন্ড হয়।
সফোক্লিজ যে কথাটি বুঝাতে চেয়েছেন তা হলো যে সভ্যতার মূলে এমন কতগুলি চিরন্তন মূল্যবোধ থাকে যা লংঘন করতে গেলে মানুষ পশুরও অধম হয়ে যায়। অথচ ‘৭১ সালে বহুবার শুনেছি যে স্বাধীনতার স্বার্থে নাকি খুন ডাকাতি ব্যভিচার সবকিছুই বৈধ। পিতামাতা শিক্ষক কেউ বিপরীত মত অবলম্বন করলে তাকে খতম করে দেশ উদ্ধারের যে চেষ্টা এ সময় শুরু হয়েছিলো তার জের আমরা কখনো কাটাতে পারবো কিনা সন্দেহ।
(বইটির pdf version download করুন এখানে)