অধ্যায় ৪: পাকিস্তানের ব্যর্থতার জন্য দায়ী কি শুধু পশ্চিম পাকিস্তানীরা?
এ নিয়ে দ্বিমত নেই, পাকিস্তান বহু ক্ষেত্রেই চরম ভাবে ব্যর্থ হয়ছে। কিন্তু সে ব্যর্থতার জন্য দায়ী কি শুধু পশ্চিম পাকিস্তানীরা? সে ব্যর্থতার জন্য পূর্ব পাকিস্তানীদের কি কোন দায়ভারই নাই? অথচ পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৬% ভাগ ছিল পূর্ব পাকিস্তানী। ফলে সকল ব্যর্থতা থেকে দেশকে বাঁচানোর বড় দায়িত্ব ছিল পূর্ব পাকিস্তানীদের। সমগ্র পাকিস্তানের শিক্ষা, শিল্প, কৃষি, বাণিজ্যের অগ্রগতিতে অংশ নেওয়া দূরে এমনকি নিজ প্রদেশের নিজস্ব রাজনীতিতেও তারা ক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানের মত পূর্ব পাকিস্তানে চারটি প্রদেশ ছিল না। নানা ভাষাভাষির বিভক্তিও ছিল না। কিন্তু আত্মঘাতি রাজনীতির কারণে নিজের ঘর গোছাতেই তারা চরম ভাবে ব্যর্থ হয়। কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধী আওয়ীম লীগ, শেরে বাংলার কৃষক শ্রমিক প্রজা পার্টি,নেজামে ইসলাম পার্টি, গণতন্ত্রি দল ও খেলাফতে রাব্বানী পার্টি ২১ দফার ভিত্তিতে যুক্ত ভাবে নির্বাচন করে। নির্বাচনে তারা বিপুল ভাবে বিজয় লাভ করে। ২৩৭টি আসনের মধ্যে তারা ২২৮টি আসন তারা লাভ করে। কিন্তু বিজয়ের পর পরই তারা লিপ্ত হয় আত্মঘাতি লড়াইয়ে।
অঙ্গদলগুলি একে অপরকে শত্রু মনে করতে থাকে। চেষ্টা করে অপরদলকে কিভাবে ক্ষমতার মঞ্চ থেকে দূরে রাখা যায়। যুক্তফন্টের পার্লামেন্টারী নেতা ছিলেন শেরে বাংলা। তাকেই সরকার গঠন করতে বলা হয়। ১৯৫৪ সালের ২রা এপ্রিল তিনি প্রথম মন্ত্রিসভা গঠন করেন মাত্র তিনজন মন্ত্রি নিয়ে। বাদ দিয়েছিলেন যুক্তফ্রন্টের প্রধান শরিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগকে। তিনজন মন্ত্রীর একজন ছিল তার ভাগিনেয় সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া। এটি কি কম স্বজনপ্রীতি? সরকার গঠনের প্রায় দেড় মাস পর ১৫ই মে তিনি মন্ত্রীসভায় আওয়ামী লীগের সদস্যদের শামীল করেন। এরপর শেরে বাংলার বিরুদ্ধে অনাস্থা আনে আওয়ামী লীগ। এরপর শেরে বাংলাকেও সরতে হয়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হন শেরে বাংলার দল থেকেই জনাব আবু হোসেন সরকার। ১৯৫৬ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর তাঁকেও যেতে হয়। ক্ষমতায় আসেন আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খান। তার ভাগ্যেও সরকারে থাকা বেশী দিন সম্ভব হয়নি। তাকে সরিয়ে ১৯৫৮ সালের ১৯শে জুন আবার ক্ষমতায় আসেন আবুল হোসেন সরকার। এবার তিন দিন পর ২২ জুন তারিখে আবার তাকে সরতে হয়। (সা’দ আহম্মদ,২০০৬)।
এভাবে তারা সমগ্র পাকিস্তানের কি নেতৃত্ব দিবে, দারুন ভাবে ব্যর্থ হয় নিজ প্রদেশ শাসনে। ঘন ঘন সরকার গঠন ও ভাঙ্গা দেখে ভারতীয় নেতারা তখন ব্যঙ্গ করে বলত, ভারতীয় রমনীরা যেরূপ শাড়ী বদল করে ঢাকায় তেমন সরকার বদল হয়। যুক্তফ্রন্টের অঙ্গদলগুলির মাঝে সংঘাত এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে প্রাদেশিক পরিষদের মধ্যেই তারা খুনোখুনী করে। পরিষদের ডিপুটি স্পীকার জনাব শাহেদ আলীর মাথায় গুরুতর ভাবে আঘাত করে। পরে তিনি হাসপাতালে মারা যান। স্পীকারের অনুপস্থিতিতে সেদিন তিনিই সভাপতিত্ব করছিলেন। উল্লেখ্য, সেদিন প্রাদেশিক সংসদের সে খুনোখুনির জলসায় কোন অবাঙ্গালী ছিল না,কোন পশ্চিম পাকিস্তানী বা পাঞ্জাবী আমলা বা সেনাকর্মকর্তাও ছিল না। এ খুনোখুনির কান্ডটি ঘটেছিল প্রকৃত অর্থেই সম্পূর্ণ বাঙালী সদস্যদের হাতে।যেহেতু বাঙালীর সকল দূর্ভোগের জন্য পাঞ্জাবীদের দায়ী করা হয়,এ বিষয়টিও এজন্য লক্ষ্য করার মত। আরো দুঃখজনক হল, এ হত্যকান্ডটি ঘটেছিল প্রকাশ্য দীবালোকে,অথচ তার কোন বিচার বিভাগীয় তদন্তও তারা করেনি। ফলে এ গুরুতর অপরাধের জন্য কারো শাস্তি হয়নি,কাউকে গ্রেফতারও করা হয়নি। আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা দেশটিকে যে কতটা মগের মুল্লুকে পরিণত করেছিল এ হল তার নমুনা।আর লজ্জাজনক কথা, একবার তো তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের ভোটে স্পীকারকে পাগল রূপে ঘোষণা দিয়েছিল।যেন ভোট দিয়ে একজন মানুষকে পাগলও বানানো যায়! পাকিস্তানের গণতন্ত্র চর্চা তাদের কাছে যে কতটা তামাশায় পরিণত হয়েছিল এ হল প্রমাণ। সত্তরের দশকে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা যেমন বাংলাদেশের মুখে কালিমা লেপন করেছিল– অর্জন করেছিল তলাহীন ভিক্ষার ঝুলির খেতাব,তারা কালিমা লেপন করেছিল পাকিস্তানের মুখেও। সেটি সংসদে ডিপুটি স্পীকার হত্যা ও গণতন্ত্র চর্চায় নিদারুন ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে। দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ (৫৬%) বাঙালী নাগরিকগণ পূর্ব পাকিস্তানে অনেক অবাঙ্গালীর পূজি ও মেধা বিণিয়োগ করতে দেখেছে। কিন্তু নিজেরা পশ্চিম পাকিস্তানে একখানি কারখানাও নির্মাণ করেনি। নিজেরা নিজেদের সীমানাও যথাযত পাহারা দিতে পারেনি, সে ব্যর্থতার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত পরিণত হয়েছিল চোরাকারকারীদের স্বর্গরাজ্য। কি প্রশাসন, কি রাজনীতি, কি পার্লামেন্টারী বিতর্ক, কি সীমান্ত প্রতিরক্ষা, কি শিল্পায়ন – সব কিছুতে বাঙালীর ব্যর্থতা শুধু একাত্তর-পরবর্তী বিষয়ই নয়, ষোল কলায় বিকশিত হয়েছিল পাকিস্তানী আমলেও। আরো দুঃখজনক হলো, এত ব্যর্থতার পরও নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে কোন আত্মসমালোচনা নাই। বরং সব সময়ই সকল ব্যর্থতার দায়ভার অন্যদের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্ঠা হয়েছে সর্বাত্মক ভাবে। প্রচন্ড অহংকার চেপেছিল এ নিয়ে যে, সমগ্র পাকিস্তানে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আওয়ামী লীগের আত্মঘাতী রাজনীতির আরো উদাহরণ দেয়া যাক। শুরু থেকেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে যে ব্যর্থতাটি প্রকট ভাবে দেখা দেয় তা হল, একটি শাসনতন্ত্র তৈরীর ব্যর্থতা। অবশেষে সে কাজে সফলতা আসে ১৯৫৬ সালে। এবং সেটি অবাঙালী প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে। অথচ সে সময়ও আওয়ামী লীগের ভূমিকা আদৌ সহায়ক ছিল না। সে সময়ের আওয়ামী লীগ নেতা জনাব অলি আহাদ তার বই “জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫” লিখেছেনঃ
“১৯৫৬ সালে প্রধানমন্ত্রী চৌধুরি মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে পাকিস্তান মুসলিম লীগ, শেরে বংলা এ, কে, ফজলুল হকের নেতৃত্বে পরিচালিত যুক্তফ্রন্টভূক্ত কৃষক শ্রমিক পর্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (আব্দুস সালাম খান পরিচালিত), সিডিউল কাষ্ট ফেডারেশন, পাকিস্তান কংগ্রেস, ইউনাইটেড প্রোগেসিভ পার্টি ও গণতন্ত্রী দলভূক্ত সদস্যবৃন্দের সমবেত ভোটে সংবিধান গৃহীত হয়। কিন্তু জনাব সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পরিচালিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সদস্যবৃন্দ প্রতিবাদে গণ-পরিষদ হল হইতে “ওয়াক আউট করে ও চুড়ান্তভাবে গৃহীত শাসনতন্ত্রে স্বাক্ষরদানে বিরত থাকে।” -(অলি আহাদ)।
স্বাক্ষর না করার কারণ, পূর্ব পাকিস্তানকে পর্যাপ্ত স্বায়ত্বশাসন দেওয়া হয়নি। অথচ এই সোহরাওয়ার্দীই যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন তখন সে কথা সম্পূর্ণ ভূলে যান। ১৯৫৭ সালের ১৪ই জুন ঢাকার পল্টনে অনুষ্ঠিত জনসভায় দৃপ্তকন্ঠে ঘোষণা করেন, ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানকে ৯৮ ভাগ স্বায়ত্বশাসন দেওয়া হয়েছে। আর তাঁর গণতান্ত্রিক মানসিকতার কথা? আওয়ামী লীগে তখন চরমঅভ্যন্তরীণ বিরোধ। জনাব সোহরাওয়ার্দী তখনও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি জনাব ভাষানীর সাথে তাঁর বিরোধ তখন তুঙ্গে। বিষয়, পররাষ্ট্র নীতিসহ আরো বেশ কিছু বিষয়। মন্ত্রীত্ব বনাম এসব সাংগাঠনিক মনবিরোধ সম্পর্কে জনৈক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে জনাব সোহরাওয়ার্দী বলেন,
“আওয়ামী লীগ আবার কি? আমিই আওয়ামী লীগ।” অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বিস্ময়করভাবে অবলীলাক্রমে বলেন, “আমিই আওয়ামী লীগের মনিফেস্টো।”-(অলি আহাদ)।
১৯৪৭ সালের ৫ই আগষ্ট পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারী পার্টি বৈঠকে খাজা নাজিমুদ্দীন ৭৫-৩৯ ভোটে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পরাজিত করে পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা নির্বাচিত হলেন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী এ পরাজয় সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেননি। সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের পক্ষ থেকে প্রচার চালানো হয়, এটি নাকি ষড়যন্ত্র। তিনি ও তাঁর সদস্যগণ নিজ দলের গণতান্ত্রিক রায়ের প্রতিও যে কতটা গোস্বা হয়েছিল এ হল তার নমুনা। মনের দুঃখে প্রথমে তিনি ভারতে থেকে যাওয়ার মনস্থ্য করেন। পরে পাকিস্তানে আসেন, তবে ঢাকাতে নয়। তিনি কোলকাতা থেকে লাহোর অভিমুখে রওনা দেন। কথা হল, গণতান্ত্রিক রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাহীন এমন নেতাদের হাতে কি গণতন্ত্র চর্চা নিরাপদ হয়? গণতন্ত্রের রায়কে তারা তখনই মানতে রাজী যখন সেটি নিজেদের পক্ষে যায়। এ এমন অসুস্থ্য চেতনার কারণেই, ১৯৫৩ সালে গভর্নর জেনারেল গোলাম মহম্মদ যখন জনাব নাজিম উদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে বরখাস্ত করেন তখন তার সে অগণতান্ত্রিক, অন্যায় ও অবৈধ পদক্ষেপকে জনাব সোহরাওয়ার্র্দী পল্টনের জনসভায় সমর্থন জানান। অথচ তখন দেশের গণপরিষদে জনাব নাজিম উদ্দিনের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থণ ছিল। বরখাস্ত করার আগে জনাব গোলাম মুহম্মদ প্রধানমন্ত্রী জনাব নাজিম উদ্দিনকে সংসদে সেটি প্রমাণেরও সুযোগ দেননি। লক্ষ্যনীয় হল, জনাব সোহরাওয়ার্দীই পাকিস্তানের রাজনীতিতে মুজিবের ন্যায় পাকিস্তানের শত্রুদের পুনর্বাসিত করেন।
দেখা যাক শেখ মুজিবের গণতন্ত্র চর্চার নমুনা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হয়। আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্টের শরীক দল দিল। ১৯৫৬ য়ের সেপ্টম্বরে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান মন্ত্রী সভার মন্ত্রি হন। তখন প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন আতাউর রহমান খান। শেখ মুজিব তখন আওয়ামী লীগেরও সাধারণ সম্পাদক। ১৯৫৫ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অধিবেশনে গৃহীত গঠনতন্ত্রের ৬৬ ধারা মোতাবেক শেখ মুজিবের উপর অবশ্য পালনীয় ছিল যে মন্ত্রী হওয়ার সাথে সাথে দলীয় পদ থেকে ইস্তাফা দিবেন। উক্ত ধারায় সুস্পষ্ট ছিল যে, অন্যথায় এক মাস পরে উক্ত কর্মকর্তার পদ শূণ্য বলে গণ্য হবে। দলের অন্য মন্ত্রী যেমন আতাউর রহমান খান,আবুল মনসুর আহম্মদ ও খয়রাত হোসেন দলীয় পদ থেকে পদত্যাগ করলেও তিনি তা করেননি। -(অলি আহাদ)।
মানুষের আসল চরিত্র ধরা পড়ে ক্ষুদ্র বিষয়ে তার আচরণে। এমন কি অতিশয় দুর্বৃত্তও দুর্বৃত্তির বিশাল কান্ডটি জনসম্মুখে ঘটায় না। কারো বাড়ীতে আগুন লাগা দেখে অতি ডাকাত প্রকৃতির ব্যক্তিও মহল্লার অন্যদের সাথে মিলে সেটি নেভাতে যায়। কারণ এটি বিশাল ব্যাপার। এ কাজে এগিয়ে না আসলে তার বিবেকহীন পশু চরিত্রটি জনসম্মুখে প্রকাশ পায়। সমাজে কেউ কি এরূপ বিবেকহীন রূপে চিত্রিত হতে চায়? এমন কি অতিশয় দূর্বৃত্তও নয়। কিন্তু খুঁটিনাটি বিষয়ে এমন দুর্বৃত্তরা ততটা সতর্ক থাকে না বলেই তাদের আসল চরিত্র ক্ষুদ্র বিষয়ে বেরিয়ে আসে। তাই ব্যক্তির গুণাগুণ যাচায়ে উত্তম উপায় হল মামূলী বিষয়ে তার আচরনটি দেখা। মহান নেতাদের মাঠ পর্যায়ে নেমে কর্মীদেরকে নিজের নামে প্লাকার্ড লিখতে বলার সময় হয় না।এমন কাজে রুচীও বোধ করেন না। কিন্তু শেখ মুজিব এমন তুচ্ছ কাজেও ময়দানে নেমেছেন। ঢাকা থেকে ভৈরবের ন্যায় মফস্বলের শহরে ছুটে গেছেন। তার উদাহরণ দেওয়া যাক। আগারতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী ও শেখ মুজিবের অতি ভক্ত আব্দুর রউফ তার বইতে লিখেছেন,
“১৯৫০ সালে আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা শেখ মুজিবর রহমানের সাথে আমার প্রথম দেখা হয় ভৈরবে। আমি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। আওয়ামী লীগের জনসভা উপলক্ষ্যে ব্যাপক প্রস্তুতি ছলছে তখন ভৈরবে। ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় নেতার আসবেন। তাই আমরা সবাই একই সাথে প্রচুর উৎসাহ আর দারুণ উদ্বেগের মধ্যে কাজ করে চলেছি। কলেজ হোষ্টেলে হল আমাদের কাজের প্রধান কেন্দ্র। একদিন পোষ্টার লেখা,প্লাকার্ড বানানো আর অন্যান্য প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনার মুহুর্তে এক দীর্ঘাদেহী সুদর্শন যুবক ঢুকলেন রুমে। … মুজিব ভাইকে কাছে পেয়ে আমাদের সকলের কাজের উৎসাহ কয়েকগুণ বেড়ে গেল। ..যাওয়ার সময় ছাত্রকর্মী হায়দারের হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললেন,“তোরা কিছু খেয়ে নিস”। ..যেতে যেতে তিনি হেসে আমাদেরকে বললেন,“তোরা এত পোষ্টার-প্লাকার্ড বানাচিছস,তোদের মুজিব ভাইয়ের নামে কি একটাও করবি না”।ইঙ্গিতেই কাজ হয়েছিল। জনসভার দিন দেখা গেল মওলানা ভাষানীর নামে প্লাকার্ড ছিল,শেখ মুজিবের নামে তার থেকে কম ছিল না,জিন্দাবাদ ধ্বনিও তার নামে কম দেয়া হয়নি।”-(আব্দুর রউফ, ১৯৯২)।
এই হল মুজিবের চরিত্র। নিজের ইমেজ তৈরীতে মেধা নয়, এরূপ নীচু মানের সহজ পথ বেছে নিয়েছিলেন। শেখ মুজিব ও ভাষানীর ন্যায় ব্যক্তিদের আত্মঘাতী রাজনীতিই সামরিক শাসন ডেকে এনেছিল ১৯৬৯ সালে। সে সময় শাসন ক্ষমতায় ছিল আইয়ুব খান। তার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের ঊভয় প্রদেশে শুরু হয় চরম গণ-আন্দোলন। আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান সর্বদলীয় গোলটেবিল বৈঠক ডাকে। তখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হত ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের ভোটে। আইয়ুব খান একে নাম দিয়েছিলেন মৌলিক গনতন্ত্র । সম্মিলিত বিরোধী দলের দাবী ছিলঃ সকল প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার এবং পার্লামেন্টারী পদ্ধতির শাসন। আইয়ুব খান এদুটি দাবী মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিব দাবী করে বসলেন, ৬ দফাও মেনে নিতে হবে। নির্বাচনে যাওয়ার ধৈয্য তার ছিল না। অথচ ৬ দফা নিয়ে বিরোধী দলগুলি মধ্যে ঐকমত্য ছিল না। ফলে আইয়ুব খানেরও সেটি মেনে নেওয়ায় আগ্রহ ছিল না। সৃষ্টি হলো চরম রাজনৈতিক অচলাবস্থা। অথচ মুজিব জেল থেকে মুক্তি পেলেন এবং তার বিরুদ্ধে আনা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নেওয়া হয়েছিল সম্মিলিত বিরোধীদলের জোট PDM এবং DAC আন্দোলনের প্রেক্ষিতে। নইলে শেখ মুজিবসহ বহু আওয়ামী নেতা তখন জেলে ছিল। তখন আওয়ামী লীগের একার পক্ষে তেমন জোরদার অন্দোলন গড়ে তোলাও সম্ভব ছিল না। অথচ আওয়ামী লীগ সম্মিলিত বিরোধী দলের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে পিছন থেকে চাকু ডুকিয়ে দেয়। পরের বছরেই প্রমাণ হলো,পাকিস্তানের জন্য এটিই ছিল গনতন্ত্রের শেষ ট্রেন। মুজিবের কারণে সেটিও হাতছাড়া হয়ে যায়। দেশ আবার নিক্ষিপ্ত হলো অস্থিতিশীল অবস্থায়। এমন অবস্থায় একমাত্র বিদেশী শত্রুরাই খুশি হয়। আর পাকিস্তানের জন্য এমন শত্রুর অভাব ছিল না। ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট এবং ইসরাইল তেমন এক অবস্থার জন্য পূর্ব থেকেই অপেক্ষায় ছিল। আইয়ুব চলে গেলেন কিন্তু জাতি ব্যর্থ হলো শান্তিপূর্ণ ভাবে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ফিরে যেতে। ক্ষমতায় এল আরেক সামরিক জান্তা জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ফলে পরের দিনগুলি আরো রক্তাত্ব হলো। তাই এ করুণ পরিণতির জন্য শুধু কি সামরিক বাহিনীকে দায়ী করা যায়? দেখা যাক নেতাদের নীতি ভ্রষ্টতার বিষয়টি। শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক পুর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ১৯৫৪ সালের ৩০শে এপ্রিল তারিখে কলকাতায় এক সংবর্ধনা সভায় অত্যন্ত আবেগজড়িত বলেন,“রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ বিভক্ত করা যেতে পারে, কিন্তু বাঙালীর শিক্ষা, সংস্কৃতি আর বাঙালিত্বকে কোন শক্তিই কোনদিন ভাগ করতে পারবে না।”-(সা’দ আহম্মদ, ২০০৬)।
তিনিই ভূলেই গেলেন, ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ লাহোরের মিন্টো পার্কে মুসলিম লীগের সম্মেলনে তিনিই পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। তখন পাকিস্তান সৃষ্টির পিছনে মূল যু্ক্তিটি হিন্দুদের সাথে মুসলমানদের রাজনৈতিক বিবাদ ছিল না, বরং সেটি ছিল দুটি ভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক, আদর্শিক, শিক্ষাগত ও জীবনলক্ষ্যের ভিন্নতা। বাঙালী রূপে বেড়ে উঠার বিষয়টিই মুসলমানদের জীবনে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় নয়, বরং তাদের রাজনীতির মূল এজেন্ডা হল নিজ দেশে মুসলমান রূপে বেড়ে উঠার বিষয়টি নিশ্চিত করা। আম গাছের জলবায়ু বা আবহাওয়াগত প্রয়োজনটি যেমন আঙ্গুর গাছ থেকে ভিন্নতর, তেমনি একজন মুসলমানের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত পরিবেশটি একজন অমুসলিম থেকে ভিন্নতর। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনটি দেখা দিয়েছিল এ ভিন্নতর প্রয়োজন মেটাতে। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার পিছনে এটিই ছিল মূল দর্শন বা ফিলোসফিকাল কনসেপ্ট। মুসলমানগণ তাই স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। শেরে বাংলার মত একজন প্রথম সারির নেতার সেটি বুঝা উচিত ছিল। এমন বিভ্রান্তিকর চেতনা নিয়ে তিনি কি ইসলামের নামে অর্জিত পাকিস্তানের ন্যায় বিশ্বের সর্ব বৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের নেতা হওয়ার যোগ্য বিবেচিত হতে পারেন? এমন বক্তব্যর জন্যই পাকিস্তানের রাজনীতিতে তাঁর স্থান অতি সংকীর্ন হয়ে যায়। কলিকাতায় দেওয়া তাঁর ভাষণের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মাদ আলী বগুরা পর্যন্ত তাঁকে ভারতের দালাল বলেছেন। এ বিভ্রান্ত চেতনার কারণে তাঁকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসানো এমনকি অনেক বাঙালী মুসলিম নেতাও বিপদজনক মনে করেন। ফল দাঁড়ালো, পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল তাঁকে মুখ্যমন্ত্রির পদ থেকেই বরখাস্ত করলেন। এর পূর্বেও তিনি সে বিভ্রান্তিকর চেতনার স্বাক্ষর রেখেছিলেন মুসলিম বিদ্বেষী চরম হিন্দু সাম্প্রদায়ীক দল হিন্দু মহাসভার সাথে স্বাধীনতা-উত্তর অবিভক্ত বাংলার কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। তখন তিনি কোমর বেঁধে লেগেছিলেন, মুসলিম লীগ যাতে ক্ষমতায় যেতে না পারে।
দেখা যাক আওয়ামী লীগের মুসলিম প্রীতির নমুনা। ১৯৫৬ সালে যখন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, তখন ইসরাইল, বৃটেন ও ফ্রান্স একযোগে মিশরের উপর হামালা করে। হামলার কারণ, মিশর সরকার সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করেছিল। সমগ্র মুসলিম বিশ্ব সে হামলার নিন্দা করে। নিন্দা করে এমনকি তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশ। প্রবল ভাবে নিন্দা করে ভারত। এমনকি সে যুদ্ধের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিনীদের চাপেই অবশেষে সে যুদ্ধ থেমে যায়। হামলাকারি ইসরাইল, বৃটেন ও ফ্রান্স তখন লেজগুটিয়ে সুয়েজ খাল এলাকা থেকে পালাতে বাধ্য হয়। অথচ সে সময় আওয়ামী লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দীর সিদ্ধান্তটি ছিল সম্পূর্ণ কান্ডজ্ঞান বিবর্জিত। তিনি সে আগ্রাসনের নিন্দা না করে বলেছিলেন, ইসরাইল, বৃটেন ও ফ্রান্সের মোকাবেলার শক্তি মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর নাই। তখন তিনি অভিনব সূত্র শুনান, “শূন্যের সাথে শূন্যের যোগে শূন্যই হয়।” এভাবে তিনি রাজনীতিতে পাটিগণিতের যোগবিয়োগের অংক নিয়ে আসেন। অথচ মুসলমান যত দূর্বলই হোক তাদের মধ্যে একতা গড়া ও একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া নিছক রাজনীতি নয়, পাটি গণিতের অংকও নয়, এটি পবিত্র ইবাদত। কিন্তু সোহরাওয়ার্দীর চেতনায় তার লেশ মাত্র ছিল না। সাম্রাজ্যবাদীদের হামলার নিন্দা করার জন্য যে ণ্যূনতম মূল্যবোধ দরকার তিনি সেটুকুও দেখানে পারেননি। তাঁর এ নীতির ফলেই আরব বিশ্বের সাথে বিশেষ করে মিশরের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কের দারুন অবনতি ঘটে। আওয়ামী লীগের আত্মঘাতি রাজনীতির এ হল এক নমুনা।
ইসলামী চেতনার কথা না হয় বাদ দেওয়া গেল, কিন্তু যে গণতান্ত্রিক চেতনা নিয়ে আওয়ামী লীগের আজও অহংকার সে চেতনাই বা তাদের কতটা ছিল? সে উদাহরণও দেওয়া যাক। ১৯৫৪ সালের কথা । মোহাম্মদ আলী বগুড়া তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তখন পাকিস্তানের রাষ্ট্র প্রধানকে প্রেসিডেন্ট না বলে ব্রিটিশ আমলের খেতাব অনুযায়ী গভর্নর জেনারেল বা বড় লাট বলা হত। পার্লামেন্টকে বলা হত গণপরিষদ। গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা ছিল তিনি ইচ্ছা করলে পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিতে পারতেন। প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী গভর্নর জেনারেলের এ ক্ষমতা রহিত করে গণপরিষদে একটি বিল আনেন। বিল চুড়ান্ত বিবেচনার জন্য গণপরিষদে পেশ করার পর প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় সফরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভোটে গণপরিষদে সেটি পাশও হতে যাচ্ছিল। পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের পথে উত্তরণের এটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তখন গভর্নর জেনারেল ছিলেন প্রাক্তন আমলা জনাব গোলাম মোহম্মদ। প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করে গভর্নর জেনারেল এ বিল আইনে পরিণত হওয়ার আগেই ২৩শে অক্টোবর গণপরিষদই ভেঙ্গে দেন। তখন তাকে সহয়তা দেন সামরিক বাহিনী প্রধান জেনারেল আইউব খান। পাকিস্তানী গণতন্ত্র চর্চার বিরুদ্ধে এটি ছিল গুরুতর ছুরিকাঘাত। এর পর আর গণতন্ত্রচর্চা তার হৃত স্বাস্থ্য আর ফিরে পায়নি। সে সময় গণপরিষদের মূল দায়িত্ব ছিল শাসনতন্ত্র প্রণয়ন। এটিই ছিল পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদ। কিন্তু সে কাজটি সমাধা করার সময় পায়নি। তখন গণপরিষদের স্পীকার ছিলেন ফরিদপুরের মৌলবী তমিজ উদ্দীন খান। তিনি আদালতে গভর্নর জেনারেলের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করেন। সিন্ধুর হাইকোর্টে জিতলেও তিনি সুপ্রিম কোর্টে হেরে যান। সুপ্রিম কোর্টের এ রায়টি পাকিস্তানের বিচার-ইতিহাসে আজ বিতর্কিত। কিন্তু গভর্নরের সে অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপের প্রতি অতি দ্রুত সমর্থণ নিয়ে এগিয়ে আসে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। তখন দলটির নাম ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। “দলের কেন্দ্রীয় সাধারন সম্পাদক মাহমুদুল হক ওসমানী করাচী থেকে এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক শাখার সহ-সভাপতি আতাউর রহমান খান ঢাকা হতে প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে গভর্নর জেনারেলের অগণতান্ত্রিক কাজকে সমর্থণ করেন। শেখ মুজিব তখন জেলে, তিনি তখন দলের পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক কমিটির সেক্রেটারি। ঢাকার সেন্ট্রাল জেল থেকে শেখ মুজিব টেলিগ্রাম যোগে পাকিস্তান গণপরিষদের অন্যায় ও অবৈধ বিলুপ্তিকে স্বাগত জানান। এমনকি গোলাম মোহাম্মদের এই বিধি বহির্ভূত অন্যায় ফরমানের পক্ষে সমর্থন আদায়ের লক্ষে আতাউর রহমান ঢাকা থেকে এবং মাহমুদুল হক ওসমানি করাচী থেকে বিদেশে অবস্থানরত শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও লন্ডনে অবস্থানরত মাওলানা ভাসানীর সমীপে গমন করেন।.. ১৪ই নভেম্বর গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদের ঢাকা আগমন উপলক্ষে পদচ্যুত মুখ্যমন্ত্রী ও রাজনীতি হতে অবসর গ্রহণের সুস্পষ্ট ঘোষণাকারী শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক ও জনাব আতাউর রহমান খান ঢাকা বিমান বন্দরে স্বৈরাচারী গভর্নর জেনারেলকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ন হলেন। বিমান বন্দরে তাঁহাকে কে মাল্যভূষিত করবেন এই সমস্যায় জর্জরিত দুই নেতাকে উদ্ধার করলেন গভর্নর জেনারেল স্বয়ং। অর্থাৎ তিনি শেরে বাংলা ও আতাউর রহমান খানের দুই হাত একত্রিত করিয়া যুগপাৎ মাল্যদানের সুযোগ করিয়া দিয়া উভয়েরই ধন্যবাদার্হ হইলেন।”-(অলি আহাদ)